যতই টানাটানি করি আর চেঁচিয়ে গলা ফাটাই, দরজা আর কিছুতে খোলে না। শেষ পর্যন্ত হাবুল সেন থপ করে মেজের ওপরে বসে পড়ল।
—এই কাগামাছি অখন আমাগো মাছির মতন টপাটপ কইরা ধইরা খাইব।
—চার-চারটে লোককে গিলে খাবে-ইয়ার্কি নাকি? ক্যাবলা কখনও ঘাবড়ায় না। সে বললে–পুবদিকের জানলার কাছে বড় একটা গাছ রয়েছে টেনিদা। একটু চেষ্টা করলে সেই গাছ বেয়ে আমরা নেমে যেতে পারি।
আমি বললুমআর নামবার সঙ্গে সঙ্গে কাগামাছি আমাদের এক একজনকে–
–রেখে দে তোর কাগামাছি! সামনে আসুক না একবার, তারপর দেখা যাবে। টেনিদা তুমি আমাদের লিডার, তুমিই এগোও।
কনকনে শীত, বাইরে অন্ধকার, তার ওপর এই সব ঘোরতর রহস্যময় ব্যাপার। জানালা দিয়ে গাছের ওপর লাফিয়ে পড়াটড়া সিনেমায় মন্দ লাগে না, কিন্তু টেনিদার খুব উৎসাহ হচ্ছে বলে মনে হল না। মুখটাকে বেগুনভাজার মতো করে বললে–তারপর হাত-পা ভেঙে মরি। আর কি? ওসব ইন্দ্রলুপ্ত—মানে ধাষ্টামোর মধ্যে আমি নেই।
ক্যাবলা বললে–ইন্দ্রলুপ্ত মানে টাক। ধাষ্টামো নয়।
টেনিদা আরও চটে বললে– শাট আ। আমি বলছি ইন্দ্রলুপ্ত মানে ধাষ্টামো। আমাকে বাসনি ক্যাবলা, আমি এখন খুব সিরিয়াসলি সবটা বোঝবার চেষ্টা করছি।
ক্যাবলা বিরক্ত হয়ে বললে–তা হলে তুমি বোঝবার চেষ্টাই করো। আর আমি ততক্ষণে গাছ বেয়ে নামতে চেষ্টা করি।
টেনিদা বললে–এটা তো এক নম্বরের পুঁইচচ্চড়ি—মানে পুঁদিচ্চেরি বলে মনে হচ্ছে। এই প্যালা, শক্ত করে ওর ঠ্যাং দুটো টেনে ধর দিকি। এখুনি গাছ থেকে পড়ে একটা কেলেঙ্কারি করবে।
পত্রপাঠ আমি ক্যাবলাকে চেপে ধরতে গেলুম আর ক্যাবলা তক্ষুণি পটাং করে আমাকে একটা ল্যাং মারল। আমি সঙ্গে সঙ্গে হাবুলের ঘাড়ের ওপর গিয়ে পড়লুম আর হাবুল হাঁউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল–খাইছে—খাইছে।
টেনিদা চিৎকার করে বললে–অল কোয়ায়েট! এখন সমূহ বিপদ। নিজেদের মধ্যে মারামারির সময় নয়। বালকগণ, তোমরা সব স্থির হয়ে বসো, আর আমি যা বলছি তা কান পেতে শোনো। দরজা বন্ধ হয়ে আছে থাকুক-ওতে আপাতত আমাদের কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি। হচ্ছে না। আমরা আপাতত কম্বল গায়ে চড়িয়ে শুয়ে থাকি। সকাল হোক—তারপরে
টেনিদা আরও কী বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনি বাইরে থেকে বিকট আওয়াজ উঠল—চ্যাঁ চ্যাঁ চ্যাঁ–
হাবুল বললে–প্যাঁচা!
আওয়াজটা এবার আরও জোরালো হয়ে উঠল : চ্যাঁ—চ্যাঁ-ঘ্যাঁচ-ঘ্যাঁচ-ঘ্যাঁচা–
ক্যাবলা বললে––প্যাঁচা তো অত জোরে ডাকে না, তা ছাড়া ঘ্যাঁচা ঘ্যাঁচা করছে যে!
আমি পটলডাঙার প্যালারাম, অনেক দিন পালাজ্বরে ভুগেছি আর বাসকপাতার রস খেয়েছি। পেটে একটা পালাজ্বরের পিলে ছিল, সেটা পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খেতে-খেতে কোথায় সটকে পড়েছিল। কিন্তু ওই বিকট আওয়াজ শুনে কোত্থেকে সেটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল, আবার গুরুগুরু করে কাঁপুনি ধরে গেল তার ভেতর।
তখনি আমি বিছানায় উঠে পড়ে একটা কম্বল মুড়ি দিলুম। বললুম—আমি গোবরডাঙায় পিসিমার বাড়ি ও-আওয়াজ শুনেছি। ওটা হাঁড়িচাঁচা পাখির ডাক।
বাইরে থেকে সমানে চলতে লাগল সেই ঘ্যাঁচাঘ্যাঁচা শব্দ আর হাবুল ঝুমুরলালের সেই প্রায় কবিতাটা আওড়াতে লাগল :
গান ধরেছে হাঁড়িচাঁচায়,
কুণ্ডুমশাই মুণ্ডু নাচায়!
সবাই চুপ, আরও মিনিটখানেক ঘ্যাঁচার ঘ্যাঁচার করে হাঁড়িচাঁচা থামল। ততক্ষণে আমাদের কান ঝাঁ ঝাঁ করছে, মাথা বনবন করছে, আর বুদ্ধিসুদ্ধি সব হালুয়ার মতো তালগোল পাকিয়ে গেছে একেবারে। বেপরোয়া ক্যাবলা পর্যন্ত স্পিকটি নট। জানালা দিয়ে নামবার কথাও আর বলছে না।
হাবুল অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে বললে–খুবই ফ্যাসাদে পইড়া গেলাম দেখতাছি! অখন কী করন যায়?
আমি আরও ভালো করে কম্বল মুড়ি দিয়ে বললুম–বাপ রে! কী বিচ্ছিরি আওয়াজ। আর-একবার হাঁড়িচাঁচার ডাক উঠলে আমি সত্যিই হার্টফেল করব, টেনিদা।
টেনিদা হাত বাড়িয়ে টকাস করে আমার মাথার ওপর একটা গাঁট্টা মারল।
—খুব যে ফুর্তি দেখছি, হার্টফেল করবেন। অঙ্কে ফেল করে করে তোর অভ্যেসই খারাপ হয়ে গেছে। আমরা মরছি নিজের জ্বালায় আর ইনি দিচ্ছেন ইয়ার্কি। চুপচাপ বসে থাক প্যালা! হার্ট-ফার্ট ফেল করাতে চেষ্টা করবি তো এক চাঁটিতে তোর কান–
এত দুঃখের মধ্যেও হাবুল বললে– কানপুরে উইড়া যাইব।
ক্যাবলা গম্ভীর হয়ে বসেছিল। ডাকল—টেনিদা?
–বলে ফেল।
রাত্তিরে হাঁড়িচাঁচা ডাকে নাকি?
আমি বললুম–কাগামাছি–স্পেশাল হাঁড়িচাঁচা। যখন খুশি ডাকতে পারে।
—দুত্তোর।–ক্যাবলা বিষম ব্যাজার হয়ে বললে–আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে, টেনিদা।
–কী সন্দেহ শুনি?
–কাগামাছি-টাছি সব বোগাস। ওই সবুজদাড়ি সাতকড়ি লোকটাই সুবিধের নয়। রাত্তিরে ইচ্ছে করে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে। প্রকৃতিকে ভালোবাসলেই সবুজ রঙের দাড়ি রাখতে হবে—এমন একটা যা-তা ফরমুলা বলছে—যার কোনও মানেই হয় না। থিয়োরি অভ রিলেটিভিটির সঙ্গে জোয়ানের আরক? পাগল না পেট-খারাপ ভেবেছে আমাদের।
টেনিদা বললে–কিন্তু সেই মিচকেপটাশ লোকটা?
—আর সিনে ক্যামেরা দিয়া আমাগো ছবিই বা তুলল কেডা? হাবুলের জিজ্ঞাসা।
–আর ছুঁচোবাজিই বা ছুঁড়ল কে? আমি জানতে চাইলাম।
ক্যবলা বললে–। তবে সাতকড়ির পকেটে আমি দেশলাইয়ের খড়খড়ানি ঠিকই শুনতে পেয়েছিলুম। আমার মনে হয় সাতকড়িই কুয়াশার ভেতর থেকে ওটা ছুঁড়ে দিয়ে—
বলতে বলতেই আবার :
—চ্যাঁ-চ্যাঁ-ঘ্যাঁচ-ঘ্যাঁচা-ঘ্যাঁচা—
হাবুল বললে–উঃ-সারছে!
আমি প্রাণপণে কান চেপে ধরলুম।
ক্যবলা তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। বললে–বুঝেছি—জানলার নীচ থেকেই শব্দটা আসছে। আচ্ছা, দাঁড়াও।
বলেই আর দেরি করল না। টেবিলের ওপর কাচের জগভর্তি জল ছিল, সেইটে তুলে নিয়ে জানালা দিয়ে গব-গব করে ঢেলে দিলে। ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচা-ঘ্যাঁচ করে আওয়াজটা থেমে গেল মাঝপথেই। তারপরেই মনে হল, বাইরে কে যেন হুড়মুড় করে ছুটে পালাল। আরও মনে হল, কে যেন অনেক দূরে ফ্যাঁচো করে হেঁচে চলেছে।
ক্যাবলা হেসে উঠল।
—দেখলে টেনিদা, হাঁড়িচাঁচা নয়—মানুষ। এক জগ ঠাণ্ডা জলে ভালো করে নাইয়ে দিয়েছি, সারা রাত ধরে হেঁচে মরবে এখন। রাত্তিরে আর বিরক্ত করতে আসবে না।
হাবুল বললে–কাগামাছি হাঁচতে আছে। আহা ব্যাচারাম শ্যাষকালে নিমোনিয়া না হয়।
টেনিদা বললে–হোক নিউমোনিয়া, মরুক। ফিলিম দেখাচ্ছে, সমানে ঘ্যাঁচা-ঘ্যাঁচা করছে—একটু ঘুমুতে দেবার নামটি নেই। চুলোয় যাক ওসব। দরজা যখন খুলবেই না—তখন আর কী করা যায়। তার চাইতে সবাই শুয়ে পড়া যাক। কাল সকালে যা হোক দেখা যাবে।
ক্যবলা বললে, হুঁ, তা হলে শুয়েই পড়া যাক। আবার যদি হাঁড়িচাঁচা বিরক্ত করতে আসে, তা হলে ওপর থেকে এবার চেয়ার ছুঁড়ে মারব।
কম্বল জড়িয়ে আমরা বিছানায় লম্বা হলুম, মিনিট পাঁচেকের ভেতরেই টেনিদার নাক কুরকুর করে ডাকতে লাগল, হাবুল আর ক্যাবলাও ঘুমিয়ে পড়ল বলে মনে হল। কিন্তু আমার ঘুম আসছিল না। বাইরে রাত ঝমঝম করছে, ঝিঝি ডাকছেজানালার কাচের ভেতর থেকে কালোকালো গাছের মাথা আর আকাশের জ্বলজ্বলে একরাশ তারা দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল বেশ ছিলুম দার্জিলিঙে, খামকা কাগামাছির পেছনে এই পাহাড়-জঙ্গলে এসে পড়েছি। কাছাকাছি জন-মানুষ নেই, এখন যদি কাগামাছি ঘরে ঢুকে আমাদের এক-একজনকে মাছির মতোই টপাটপ গিলে ফেলে, তা হলে আমরা ট্যাঁ-ফোঁ করবারও সুযোগ পাব না। তার ওপর এই শীতে এক-জগ ঠাণ্ডা জল গায়ে ঢেলে দেওয়ায় কাগামাছি নিশ্চয় ভয়ঙ্কর চটে রয়েছে। যদিও হাবুল আমার পাশেই শুয়েছে। তবু সাহস পাবার জন্যে ওকে আমি আস্তে আস্তে ধাক্কা দিলুম।
—এই হাবলা, ঘুমুচ্ছিস নাকি?
আর হাবুল তক্ষুনি হাঁউমাউ করে এক রাম-চিকার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল।
নাকের ডাক বন্ধ করে টেনিদা হাঁক ছাড়ল—কী—কী–হয়েছে?
ক্যাবলা কম্বলসুষ্ঠু নেমে পড়তে গিয়ে কম্বলে জড়িয়ে দড়াম করে আছাড় খেল একটা।
টেনিদা বললে– কী হয়েছে রে হাবুল, চেঁচালি কেন?
–কাগামাছি আমারে তো মারছে।
–কাগামাছি নয়, আমি।–আমি এই কথাটা কেবল বলতে যাচ্ছি, ঠিক তখন—
তখন সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটল।
বড় আলো দুটো নিবিয়ে একটা নীল বাতি জ্বেলে আমরা শুয়ে পড়েছিলুম। হালকা আলোয় ছায়া-ছায়া ঘরটার ভেতর দেখা গেল এক রোমহর্ষক দৃশ্য।
আমরাই চোখে পড়েছিল প্রথম। আমি চেঁচিয়ে উঠলুম-ও কী?
ঘরের ঠিক মাঝখানে–শুন্যে কী ঝুলছে ওঠা!
আবছা আলোতেও স্পষ্ট দেখা গেল—ঠিক যেন হাওয়ায় একটা প্রকাণ্ড কাটামুণ্ডু নাচছে। তার বড় বড় দাঁত, দুটো মিটমিটে চোখ—ঠিক যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে সে।
আমরা চারজনেই এক সঙ্গে বিকট চিৎকার ছাড়লুম। তৎক্ষণাৎ ঘরের নীল আলোটাও নিবে গেল, যেন বিশ্রী গলায় হেসে উঠল, আর আমি–
আমার দাঁতকপাটি লাগল নির্ঘাত। আর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগেই টের পেলুম, খাটের ওপর থেকে একটা চালকুমড়োর মতো আমি ধপাস করে মেঝেতে গড়িয়ে পড়েছি।