কথা ছিল, আমরা পটলডাঙার চারজন—টেনিদা, হাবুল সেন, ক্যাবলা আর আমি শ্রীমান্ প্যালারাম-গরমের ছুটিতে দার্জিলিং বেড়াতে যাব। কলকাতায় একশো সাত ডিগ্রি গরম চলছে, দুপুর বেলা মোটর গাড়ির চাকার তলায় লেপটে যাচ্ছে গলে যাওয়া পিচ, বাতাসে আগুন ছুটছে। গরমের ধাক্কায় আমাদের পটলডাঙার গোপালের মতো সুবোধ কুকুরগুলো পর্যন্ত খেকি হয়ে উঠেছে। একটাকে তাক করে যেই আমের আঁটি ছুঁড়েছি, অমনি সেটা ঘ্যাঁক করে তেড়ে এল। আমের আঁটিটা একবার চাটা তো দূরে থাক, খুঁকে পর্যন্ত দেখলে না!
এরপর আর থাকা যায় কলকাতায়? তোমরাই বলো?
আমরা চারজনেই এখন সিটি কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছি, আর ছেলেমানুষ নই। তায় সামার ভ্যাকেশন। কাজেই বাড়ি থেকে পারমিশন পেতে দেরি হল না। খালি মেজদার বকবকানিতেই কানের পোকা বেরিয়ে যাওয়ার জো। নতুন ডাক্তার হয়েছে সব সময়ে তার বিদ্যে ফলানো চাই! আরও বিশেষ করে মেজদার ধারণা, আমি একটা জলজ্যান্ত হাসপাতাল। পৃথিবীর সমস্ত রোগের মূর্তিমান ডিপো হয়ে বসে আছি, তাই যত বিটকেল ওষুধ আমার গেলা দরকার। সারাদিন ধরে আমাকেই পুটুস-পুটুস করে ইনজেকশন দিতে পারলে তবেই মেজদার আশা মেটে!
মেজদা বলল—যাচ্ছিস যা, কিন্তু খুব সাবধান! তোর তো খাবার জিনিস দেখলেই আর মাথা ঠিক থাকে না। সে চীনেবাদামই হোক আর ফাউল কাটলেটই হোক। হুঁশিয়ার হয়ে খাবি, সিঞ্চল লেক থেকে দার্জিলিঙে যে-জল আসে, সেটা এমনিতেই খারাপ, তার সঙ্গে যদি যা-তা খাস, তাহলে স্রেফ হিল-ডাইরিয়া হয়ে বেঘোরে মারা যাবি।
এ-সব কথার জবাব দেবার কোনও মানে হয় না। আমি গোঁজ হয়ে রইলুম।
তারপরে বাবা আর মায়ের উপদেশ, বড়দার শাসানি-লেখাপড়া শিকেয় তুলে দিয়ে একমাস ধরে ওখানে আড্ডা দিয়ো না। ছোড়দির তিন ডজন গোল্ড স্টোন, ছ-ছড়া পাথরের মালা, ছখানা ওয়ালপ্লেটের ফরমাস। শুনতে শুনতে দিকদারি ধরে গেল। কোনওমতে পেন্নাম-টেন্নাম সেরে শিয়ালদা স্টেশনে এসে হাড়ে বাতাস লাগল।
বাকি তিন মূর্তি অনেক আগেই এসে একটা থার্ড ক্লাস কামরায় জমিয়ে বসেছে। বেশি খুঁজতে হল না, টেনিদার বাজখাঁই গলার ডাক শোনা গেল-চলে আয় প্যালা, ইদিকে চলে আয়–
দেখি তিনজনেই তারিয়ে-তারিয়ে অরেঞ্জ স্কোয়াশ খাচ্ছে।
গাড়িতে উঠে ঝুপ করে বাক্স-বিছানা রেখে প্রথমেই বললুম,বারে, আমার অরেঞ্জ স্কোয়াশ?
—তরটা কাটা গেছে। লেট কইর্যা আসছস, তার ফাইন।
হাবুল সেন জানিয়ে দিলে।
আমি চ্যাঁ-চ্যাঁ করে প্রতিবাদ জানালুম-লেট মানে? এখনও কুড়ি মিনিট দেরি আছে ট্রেন। ছাড়তে।
—যদি কুড়ি মিনিট আগেই ট্রেন ছেড়ে দিত, কী করতিস তা হলে? টেনিদা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলে।
–কেন কুড়ি মিনিট আগে ছাড়বে?
–রেখে দে তোর টাইম টেবিল! চোঁ-চোঁ করে অরেঞ্জ স্কোয়াশটা সাবাড় করল টেনিদা। ও তো রেল কোম্পানির একটা হাসির বই। এই তো পরশু জেঠিমা এল হরিদ্বার থেকে দুন এক্সপ্রেসে চেপে। ভোর পাঁচটায় গাড়িটা আসবে বলে টাইম টেবলে ছাপা রয়েছে, এল বেলা বারোটার সময়। সাতঘণ্টা লেট করে গাড়ি আসতে পারে, আর কুড়ি মিনিট আগে ছেড়ে দিতে পারে না? কী যে বলিস তার ঠিক নেই।
যত বাজে কথা!—আমি চটে বললুম, আমিও একটা অরেঞ্জ স্কোয়াশ খাব।
টেনিদা বললে–খাবিই?
–খাবই।
—নিজের পয়সায়?
—নিশ্চয়।
ক্যাবলা বললে, তোর যেরকম তেজ হয়েছে দেখছি তাতে তোকে ঠেকানো যাবে না। তা হলে কিনেই ফেল। চারটে। মানে চারটেই তোর নিজের জন্য নয়, আমরাও আছি।
হাবুল মাথা নেড়ে বললে–হ, এই প্রস্তাব আমি সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করতাছি।
টেনিদা বললে–ডিটো।
ছাড়ল না। চারটে কেনাল আমাকে দিয়ে। আর সেগুলো আমরা শেষ করতে না করতেই টিং-টিং-টিঙা-টিং করে নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসের ঘণ্টা পড়ল।
পথের বর্ণনা আর দেব না, তোমরা যারা দার্জিলিঙে গেছ তারা সবাই তা ভালো করেই জানো। সকরিগলির স্টিমারে গলাগলি করে মনিহারিতে হারি-কি-জিতি বলে বাক্স ঘাড়ে করে বাড়ির ওপর দিয়ে রেস লাগিয়ে সে যে কী দারুণ অভিজ্ঞতা সে আর বলে কাজ নেই। ক্যাবলা আছাড় খেয়ে একেবারে কুমড়োর মতো গড়িয়ে গেল, কোত্থেকে কার এক ভাঁড় দুই এসে হাবুল সেনের মাথায় পড়ল, আমার বাঁ পা-টা একটুখানি মচকে গেল আর ছোট লাইনের গাড়িতে উঠবার সময় একটা ফচকে চেহারার লোকের সঙ্গে টেনিদার হাতাহাতির জো হল।
এই সব দুর্ঘটনার পাট মিটিয়ে গুড়গুড়িয়ে আমরা শিলিগুড়িতে পৌঁছলুম ভোরবেলায়। দূরে নীল হয়ে রয়েছে হিমালয়ের রেখা, শাদা মেঘ তার ওপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। স্টেশনের বাইরে বাস আর ট্যাক্সির ভিড়।
দার্জিলিং-দার্জিলিং—খরসাং–
–কালিম্পং–কালিম্পং–
টেনিদার সঙ্গে মনিহারিতে যে-মারামারি করবার চেষ্টা করছিল সেই ফচকে চেহারার মিচকে লোকটা একটা বাসের ভেতরে বসে মিটমিট করে তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে। দেখলুম, শিলিগুড়ির এই গরমের ভেতরই লোকটা গায়ে নীল রঙের একটা মোটা কোট চড়িয়েছে, গলায় জড়িয়েছে মেটে রঙের আঁশ-ওঠা-ওঠা একটা পুরনো মাফলার। মুখের সরু গোঁফটাকে বাগিয়ে এমন একখানা মুচকি হাসি হাসল যে পিত্তি জ্বলে গেল আমাদের।
লোকটা গলা বাড়িয়ে দিয়ে বললে–কী হে খোকারা, দার্জিলিং যাবে?
এসব বাজে লোকের বাজে কথায় কান দিতে নেই। কিন্তু মনিহারি থেকে চটেই ছিল টেনিদা। গাঁ-গাঁ করে বলল—আপনার মতো লোকের সঙ্গে আমরা কোথাও যেতে চাই না।
লোকটা কি বেহায়া! এবারে দাঁত বের করে হাসল। আমরা দেখতে পেলুম, লোকটার উঁচু-উঁচু দাঁতগুলো পানের ছোপ লাগানো, তার দুটো আবার পোকায় খাওয়া।
—যাবে না কেন? বাসে বিস্তর জায়গা রয়েছে, উঠে পড়ো।
—না।
–না কেন?—তেমনি পানে রাঙানো পোকায় খাওয়া দাঁত দুটো দেখিয়ে ফচকে লোকটা চোখ কুঁচকে হাসল। অ-রাগ হয়েছে বুঝি? তা রেলগাড়িতে ওঠানামার সময় অমন দুচারটে কথা কাটাকাটি হয়েই থাকে! ওজন্যে কিছু মনে করতে নেই। তোমরা হচ্ছ আমার ছোট ভাইয়ের মতো, আদর করে একটু কান-টান মলে দিলেই বা কী করতে পারতে? এসো খোকারা, উঠো এসো। আমি তোমাদের পথের সিনারি দেখাতে-দেখাতে নিয়ে যাব।
অস্পর্ধা দেখ, আমাদের কান মলে দিতে চায়। লোকটা বাসে চেপে না থাকলে নির্ঘাত টেনিদার সঙ্গে হাতাহাতিই হয়ে যেত। টেনিদা চিৎকার করে বলল শাট আপ।
লোকটা এবার হি-হি করে হাসল।
—গেলে না তো আমার সঙ্গে? হায়, তোমরা জানো না, তোমরা কী হারাইতেছ!
—আমরা জানতে চাই না।
ভোঁপ ভোঁপ শব্দ করে বাসটা ছেড়ে দিলে। লোকটা গলা বাড়িয়ে আবার বললে–তোমাদের একটা চকোলেট প্রেজেন্ট করে যাচ্ছি। হয়তো পরে আমার কথা ভাববার দরকার হবে তোমাদের। তখন আর এত রাগ থাকবে না।
বলতে বলতে কী একটা ছুঁড়ে দিলে আমাদের দিকে আর পটলডাঙা থাণ্ডার ক্লাবের উইকেটকিপার ক্যাবলা নিছক অভ্যাসেই সেটা খপ করে ধলে ফেলল।
চকোলেটই বটে! পেল্লায় সাইজের একখানা!
ক্যাবলা বলল—এটা ফেলে দিই টেনিদা?
চটে গেলেও খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে টেনিদার ভুল হয় না। ঝাঁ করে চকোলেটটা কেড়ে নিল ক্যাবলার হাত থেকে। মেজাজ চড়েই ছিল, একেবারে খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠল।
–ইঃ, ফেলে দেবেন! অত বড় একটা চকোলেট ফেলে দিতে যাচ্ছেন। একেবারে নবাব সেরাজদ্দৌল্লা এসেছেন। এটা আমার। আমিই তো ঝগড়া করে আদায় করলুম।
—আমরা ভাগ পামু না টেনিদা?-হাবুল সেন জানতে চাইল।
টেনিদা গম্ভীর হল!—পরে কনসিডার করা যাবে।-বলে চকোলেটটা পকেটস্থ করল।
সামনে বাস আর ট্যাক্সি সমান ডাকাডাকি করছে–দার্জিলিং-খরসাং–কালিম্পং–
আমি বললুম–দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে টেনিদা? একটা বাসে-টাসে উঠে পড়া যাক।
–দাঁড়া না ঘোড়ার ডিম। আগে সোরাবজীর রেস্তোরাঁ থেকে ভালো করে রেশন নিয়ে নিই। নইলে পঞ্চাশ মাইল পাহাড়ি রাস্তায় যেতে যেতে পেটের নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত হজম হয়ে যাবে। চল, খেয়ে আসা যাক।
খেয়ে-দেয়ে বেরিয়ে এসে ট্যাক্সি ঠিক করতে আরও ঘণ্টাখানেক গেল। তারপর বাক্স খুলে গরম কোট-টোট বের করে নিয়ে আমরা রওনা হলুম দার্জিলিঙের পথে।
নীল পাহাড়ের দিকে আমাদের গাড়িখানা ছুটে চলল তীরের বেগে। চমৎকার রাস্তা। একটু এগিয়ে চায়ের বাগান, তারপর দুধারে শুরু হয়ে গেল শালের বন। ঠাণ্ডা ছায়া আর হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে গেল যেন। আমি বেশ উদাস গান জুড়ে দিলাম আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি—
হাবুল সেন কানে হাত চাপা দিয়ে বললে–ইস, কী একখানা সুরই বাইর করতাছস! গানটার বারোটা তো বাজাইলি!
না হয় গলার সুর-টুর আমার তেমন নেই। তাই বলে হাবুল সেন সেকথা বলবার কে! ও তো গলা দিয়ে একটি সুর বের করতে পারে, সেটা হল গর্দভরাগিণী। আমি চটে বললুম-আহা-হা, তুই তো একেবারে সাক্ষাৎ গন্ধর্ব।
ক্যাবলা বললে–তুমলোগ কাজিয়া মত করো। (ক্যাবলা ছেলেবেলায় পশ্চিমে থাকত, তাই মধ্যে মধ্যে হিন্দী জবান বেরিয়ে আসে ওর মুখ দিয়ে) আসল কথা হল, প্যালার এই গানটি এখানে গাইবার কোনও রাইট নেই। এই বনের ভেতর ও স্বচ্ছন্দেই মারা যেতে পারে। আমরা বাধা দিলেও মারা যেতে পারে, কিন্তু এখানে কিছুতেই ওর জন্ম হয়নি। যদি তা হত, তা হলে ও গাছে গাছে লাফিয়ে বেড়াত, আমাদের সঙ্গে এই মোটরে কিছুতেই বসে থাকত না।
আমাকে বাঁদর বলছে নাকি? একটু আগেই গাছে গোটাকতককে দেখা গেছে সেইটেই ওর বক্তব্য নয় তো?
আমি কী যেন বলতে যাচ্ছিলুম, হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল টেনিদা।—এর মানে কী? কী মানে হয় একবিতার?
কবিতা? কিসের কবিতা? আমরা তিনজনে টেনিদার দিকে তাকালুম। একটা নীল রঙের ছোট কাগজ ওর হাতে।
—কোথায় পেলে ওটা?
টেনিদা বললে–ওই চকোলেটর প্যাকেটের ভেতর ভাঁজ করা ছিল।
টেনিদার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে হাবুল সেন পড়ল—
মিথ্যে যাচ্চ দার্জিলিং
সেখানে আছে তির শিং।
যাবে তো যাও নীলপাহাড়ি, সে
থায় নড়ে সবুজ দাড়ি।
সেইখানেতে ঝাউবাংলায়
(লেখা নেইকো বুড়ো আংলায়)
গান ধরেছে হাঁড়িচাঁচায়,
কুণ্ডুমশাই মুণ্ডু নাচায়।
—শীঝুমুরলাল চৌবে চক্রবর্তী
আমরা চারজন কবিতা পড়ে তো একেবারে থ। প্রায় পাঁচ মিনিট পরে মাথা চুলকে ক্যাবলা বলল—এর অর্থ কী?
দুধারের ছায়াঘেরা শালবনের ভেতর থেকে এর কোনও অর্থ খুজে পাওয়া গেল না।