অনেক ভেবে-চিন্তে চারজন শেষ পর্যন্ত বদ্রীবাবুর দি গ্রেট ইন্ডিয়ান প্রিন্টিং হাউস-এ ঢুকে পড়লুম। নাম যতই জাঁদরেল হোক, প্রেসের ভেতরটায় কেমন আবছা অন্ধকার। এই দিনের বেলাতেও রামছাগলের ঘোলাটে চোখের মতন কয়েকটা হলদে হলদে ইলেকট্রিকের বাল্ব জ্বলছিল এদিকে-ওদিকে; পুরনো কতকগুলো টাইপ-কেসের সামনে ঝুঁকে পড়ে ঘষা কাচের মতো চশমা পরা একজন বুড়ো কম্পোজিটার চিমটে দিয়ে অক্ষর খুঁটে খুঁটে গ্যালি সাজাচ্ছিল; ওধারে একজন ঘটাং ঘটাং করে প্রেসে কী ছেপে যাচ্ছিল, উড়ে পড়ছিল নতুন ছাপা হওয়া কাগজ—আর একজন তা গুছিয়ে রাখছিল। পুরনো নোনাধরা দেওয়াল, কুলুঙ্গিতে সিদ্ধিদাতা গণেশ রয়েছেন, তাঁর পায়ের কাছে বসে একজোড়া আরশোলা বোধহয় ছাপার কাজই তদারক করছিল, হাত কয়েক দূরে পেটমোটা একটা টিকটিকি জ্বলন্ত চোখে লক্ষ করছিল তাদের। ঘরময় কালির গন্ধ, কাগজের গন্ধ, নোনার গন্ধ, আর তারই ভেতরে টেবিল-চেয়ার পেতে, খাতা কাগজপত্র, কালি কলম, টেলিফোন এই সব নিয়ে বদ্রীবাবু একমনে মস্ত একটা অ্যাঁলুমিনিয়ামের বাটি থেকে তেলমাখা মুড়ি আর কাঁচালঙ্কা খাচ্ছিলেন।
টেনিদা আর হাবুলের পাল্লায় পড়ে বদ্রীবাবুর প্রেসে ঢুকে পড়েছি, নইলে আমার এখানে আসবার এতটুকুও ইচ্ছে ছিল না। ক্যাবলারও না। আমরা দুজনেই প্রতিবাদ করে বলেছিলুম, কী দরকার? যাদের বাড়ির ছেলে, তাদের যখন কোনও গরজ নেই, আমরা কেন খামকা নাক গলাতে যাই?
কিন্তু টেনিদার নাকটা একটু বেয়াড়া রকমের লম্বা আর লম্বা নাকের মুস্কিল এই যে, পরের ব্যাপারে না ঢোকালে সেটা সুড়সুড় করতে থাকে। টেনিদা খেকিয়ে উঠে বললে, বা-রে, তাই বলে পাড়ার একটা জলজ্যান্ত ছেলে দুম করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে?
হয়ে যাক না ক্যাবলা খুশি হয়ে বললে, অমন ছেলে কিছুদিন নিরুদ্দেশ থাকলেই পাড়ার লোকের হাড় জুড়োয়। কুকুরের ল্যাজে ফুলঝুরি বেঁধে দেবে, গোরুর পিঠে আছড়ে পটকা ফাটাবে, বেড়ালছানাকে চৌবাচ্চার জলে চুবোবে, গরিব ফিরিওলার জিনিস হাতসাফাই করবে, ছোট-ছোট বাচ্চাগুলোকে অকারণে মারধোর করবে, ঢিল ছুঁড়ে লোকের জানলার কাচ ভাঙবে—ও আপদ একেবারেই বিদায় হয়ে যাক না। হনলুলু কিংবা হন্ডুরাস যেখানে খুশি যাক, মোদ্দা পাড়ায় আর না ফিরলেই হল।
শুনে, নাকটাকে ঠিক বাদামবরফির মতো করে, টেনিদা কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ক্যাবলার দিকে। তারপর বললে, ইস্স, কী পাষাণ প্রাণ নিয়ে জন্মেছিস ক্যাবলা! তুই শুধু পরীক্ষাতেই স্কলারশিপ পাস, কিন্তু মায়া-দয়া কিছু আছে বলে তো মনে হয় না। না হয় কম্বল এক-আধটু দুষ্টুমি করেই, তাই বলে একটা নিরীহ শিশুকে–
নিরীহ শিশু। ক্যাবলা বললে, দুবার ক্লাস সেভেনে ডিগবাজি খেল, তলা থেকে ও শক্ত হয়ে আসছে—এখনও শিশু! তা হলে দেড় হাত দাড়ি গজানো পর্যন্তও কম্বল শিশুই থাকবে, ওর বয়েস আর বাড়বে না। আর নিরীহ! অমন বিচ্ছু, অমন বিটলে, অমন মারাত্মক–
আমি সায় দিয়ে বললুম, মারাত্মক বলে মারাত্মক। কম্বলকে সাধুভাষায় সর্বার্থসাধক, কিঞ্জল্ক, ডিণ্ডিম, এমন কি সুপসুপা সমাস বললে–ও অন্যায় হয় না। এই তো সেদিন পয়লা বোশেখে আমায় বললে, প্যালাদা, তোমার একটা নববর্ষের পেন্নাম করব। আমি অবাক হয়ে ভাবছি, ব্যাপারটা কী, কম্বলের অত ভক্তি কেন—আর ভাবতে-ভাবতেই পেন্নামের নাম করে আমার দুপায়ে বিচ্ছুটির পাতা ঘষে দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। তারপর একঘণ্টা ধরে আমি দাপিয়ে মরি। ও রকম বহুব্রীহি-মাকা ছেলের চিরকালের মতো নিরুদ্দেশ হওয়াই ভালো—আমি ক্যাবলার কথায় ডিটো দিচ্ছি।
টেনিদা রেগে বললে, শাটাপ! ফের কুরুবকের মতো বকবক করবি, তা হলে এক-এক চড়ে কানগুলো কানপুরে পাঠিয়ে দেব।
হাবুল অনেকক্ষণ ধরে একমনে কী যেন খাচ্ছিল, মুখটা বন্ধ ছিল তার। এতক্ষণে সেটাকে সাবাড় করে ঘাড় নেড়ে বললে, কানগুলান কর্ণাটেও পাঠাইতে পারো।
তাও পারি। নাক নাসিকে পাঠাতে পারি, দাঁত দাঁতনে পাঠাতে পারি, আরও অনেক কিছুই পারি। আপাতত কেবল ওয়ার্নিং দিয়ে রাখলাম। ক্যাবলা—প্যালা—নো তর্ক, ফলো ইয়োর লিডার—মার্চ।
ক্যাবলা গোঁজ হয়ে রইল, আমি গোঁ গোঁ করতে লাগলুম। হাবুল আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে। বললে, আরে, না হয় দিছেই তর পায়ে বিছুটা ঘইষ্যা—তাতে অত রাগ করস ক্যান? ক্ষমা কইরা দে। ক্ষমাই পরম ধর্মজানস না? শুনে আমি হাবুলের কানে কুটুস করে একটা চিমটি দিলুম-হাবুল চ্যাঁ করে উঠল।
আমি বললুম, রাগ করিসনি হাবলা, ক্ষমাই পরম ধর্ম—জানিস না?
টেনিদা বললে, কোয়ায়েট। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ফাঁটির কোনও মানে হয় না। এখন অতি কঠিন কর্তব্য আমাদের সামনে। আমরা বদ্রীবাবুর ওখানে যাব। গিয়ে তাঁকে জানাব যে কম্বলকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে আমরা তাঁকে সাহায্য করতে প্রস্তুত।
ক্যাবলা কান চুলকে বললে, কিন্তু তিনি তো আমাদের সাহায্য চাননি।
আমরা উপযাচক হয়ে পরোপকার করব।
আমি বললুম, কিন্তু বদ্রীবাবু যদি আমাদের তাড়া করেন?
ভুরু কুঁচকে টেনিদা বললে, তাড়া করবেন কেন?
বদ্রীবাবু সকলকে তাড়া করেন। দরজায় ভিখিরি গেলে তেড়ে আসেন, রিকশাওলাকে কম পয়সা দিয়ে ঝগড়া বাধান—তারপর তাকে তাড়া করেন, ঝি-চাকরকে দু বেলা তাড়া করেন, বাড়ির কার্নিসে কাক বসলে তাকে–
টেনিদা এবার টুকুস করে আমার চাঁদিতে একটা গাঁট্টা বসিয়ে দিলে।
ওফ্—এই কুকুরটার মুখ তো কিছুতেই বন্ধ হয় না। আমরা ভিখিরি, না রিকশাওলা, না দাঁড়কাক, না ওঁর ঝি-চাকর? যাচ্ছি উবগার করতে, ভদ্রলোক আমাদের তেড়ে আসবেন? কী যে বলিস তার ঠিক নেই। পাগল, না পেট খারাপ?
প্যাটই খারাপ—হাবুল মাথা নেড়ে বললে, চিরকালটাই দেখতাছি প্যাট নিয়েই প্যালার যত ন্যাটা।
টেনিদা বললে, চুলায় যাক ওর পেট। এখানে বসে আর গুলতানি করে দরকার নেই–নাউ টু অ্যাঁকশন। চলো এবার বদ্রীবাবুর কাছেই যাওয়া যাক।
আমরা কেন এসেছি, বদ্রীবাবু সেকথা শুনলেন। প্যাঁচার মতো গম্ভীর মুখে মুড়ির বাটিটা একটু-একটু করে সাবাড় করলেন, শেষে আধখানা কাঁচা লঙ্কা কচমচ করে চিবিয়ে খেলেন। তারপর কোঁচায় মুখ মুছে বললেন, হুঁ।
টেনিদা বললে, কম্বলকে খোঁজবার জন্যে আপনি কী করছেন?
বদ্রীবাবু খ্যারখেরে মোটা গলায় বললেন, আমি আবার কী করব? কীইবা করার আছে আমার?
হাবুল বললে, হাজার হোক, পোলা তো আপনার ভাইপো—
নিশ্চয়।–বদ্রীবাবু মাথা নাড়লেন : আমার মা-বাপ মরা একমাত্র ভাইপো, আমারও কোনও ছেলেপুলে নেই। আমার প্রেস, পয়সাকড়ি–সবই সে পাবে।
তবু আপনি তাকে খুঁজবেন না?—টেনিদা জানতে চাইল।
কী করে খুঁজব?–বদ্রীবাবু হাই তুললেন।
কেন, কাগজে বিজ্ঞাপন তো দিতে পারেন।
কী লিখব? বাবা কম্বল, ফিরিয়া আইস? তোমার খুড়িমা তোমার জন্য মৃত্যুশয্যায়? ঠিকানা দাও—টাকা পাঠাইব? সে অত্যন্ত ঘোড়েল ছেলে। ঠিকানা দেবে, আমি টাকা পাঠাব—টাকাও সে নেবে, কিন্তু বাড়ি ফিরবে না।
কেন ফিরবে না?—আমি জিজ্ঞেস করলুম।
তার কারণ–বদ্রীবাবু একটা দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁতের গোড়া খুঁটতে খুঁটতে বললেন, দু-দুবার ক্লাস সেভেনে ফেল করায় আমি তার জন্যে যে-মাস্টার এনেছি, সে নামকরা কুস্তিগির। তার হাতের একটা রদ্দা খেলে হাতি পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে যায়। কম্বল স্বেচ্ছায় আসবে না। মাস্টার নিরুদ্দেশ না হলে তার উদ্দেশ মিলবে বলে আমার মনে হয় না।
আপনে থানায় খবর দিলেন না ক্যান?–হাবুল বললে, তারা ঠিক–
থানা?–বদ্রীবাবু একটা বুক-ভাঙা নিঃশ্বাস ফেললেন : মাস দুই আগে আমার প্রেসের কিছু টাইপ চুরি হয়ে গিয়েছিল, আমি থানায় গিয়েছিলুম। সঙ্গে ছিল কম্বল। দারোগা এজাহার নিচ্ছিলেন, টেবিলের তলায় তাঁর পেয়ারের কুকুরটা ঘুমুচ্ছিল। কম্বল নিচু হয়ে কী করছিল কে জানে, কিন্তু হঠাৎ একটা বিটকেল কাণ্ড ঘটে গেল। বিকট সুরে ঘ্যাও-ঘ্যাও আওয়াজ ছেড়ে কুকুরটা একলাফে টেবিলে উঠে পড়ল, আর এক লাফে চড়ল একটা আলমারির মাথায়, সেখান থেকে একরাশ ধুলোভরা ফাইল নিয়ে নীচে আছড়ে পড়ে গেল। একজন পুলিশ তাকে ধরতে যাচ্ছিল–ঘোয়ঙ বলে তাকে কামড়ে দিয়ে ঘাঁকে ঘ্যাঁকা বলে চেঁচাতে-চেঁচাতে দরজা দিয়ে তীরবেগে বেরিয়ে গেল কুকুরটা। সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। এজাহার চুলোয় গেল, থানায় হুলুস্থুল কাণ্ড—পাকড়ো পাকড়ো বলে দারোগা কুকুরের পেছনে ছুটলেন। কী হয়েছিল জানো?
বদ্রীবাবু একটু থেমে আমাদের মুখের দিকে তাকালেন। ক্যাবলা বললে, কী হয়েছিল?
কম্বল পকেটে হোমিওপ্যাথিক শিশিতে ভর্তি করে লাল পিঁপড়ে নিয়ে গিয়েছিল আর সেগুলো ঢেলে দিয়েছিল কুকুরটাকে কানে। দারোগা কম্বলকে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা চড় দিয়ে বলেছিলেন, ভবিষ্যতে তাকে কিংবা আমাকে থানার কাছাকাছি দেখলেও পুরোপুরি সাতদিন হাজতে পুরে রেখে দেবেন।
টেনিদা বললে, আপনার কী দোষ? আপনি তো আর কুকুরের কানে পিঁপড়ে দেননি। কিন্তু দারোগার ধারণা, মন্ত্রটা আমিই দিয়েছি কম্বলের কানে। অভিভাবকের কাছ থেকেই। তো ছেলেমেয়ে শিক্ষা পায়।
না, তা হলে আপনার থানার যাবার পথ বন্ধ—টেনিদা মাথা নাড়ল, আচ্ছা, আমরা যদি আপনার হয়ে—
বাধা দিয়ে বদ্রীবাবু বললেন, কিছু করতে হবে না। আমি জানি, কম্বলকে আর পাওয়া যাবে না। সে যেখানে গেছে, সেখান থেকে আর ফিরে আসবে না।
কী সর্বনাশ!–আমি আঁতকে বললুম, মারা গেছে নাকি?
মারা যাওয়ার পাত্র সে নয়।বদ্রীবাবু কান থেকে একটা বিড়ি নামিয়ে ফস করে সেটা ধরালেন : সে গেছে দূরে বহু দূরে।
হাবুল বললে, কই গেছে? দিল্লি?
দিল্লি!–বদ্রীবাবু বললেন, ফুঃ।
তবে কোথায়?—টেনিদা বললে, বিলেতে? আফ্রিকায়?
এক মুখ বিড়ির ধোঁয়া ছড়িয়ে বদ্রীবাবু বললেন, না, আরও দূরে। ছেলেবেলা থেকেই তার সেখানে যাওয়ার ন্যাক ছিল। সে গেছে চাঁদে।
কী বললেন?—চারজনেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলুম আমরা।
বললুম–কম্বল চাঁদে গেছে—এই বলে বদ্রীবাবু আমাদের ভ্যাবাচ্যাকা মুখের ওপর একরাশ বিড়ির ধোঁয়া ছড়িয়ে দিলেন।