১৩. বাঘ ভার্সাস ঘোগ

খুব সম্ভব মরেই গিয়েছিলাম। কিন্তু মরা মানুষকেও যে জাগিয়ে তুলতে পারে সে হল বাঘের ডাক। কানের পাশে যেন একসঙ্গে পঁচিশটা বাজ পড়ল এইরকম মনে হল আমার, আর মুখের ওপর ফটাস করে মোটা কাছির মতো কিসের একটা ঘা লাগল। বুঝতে পারলুম, বাঘের ল্যাজ।

মাত্র একহাত দূরে আমার বাঘ পড়েছে–তারপরেও কি আমার বেঁচে থাকা সম্ভব? আমি—পটলডাঙার প্যালারাম–এ-যাত্রা নির্ঘাত তা হলে মারাই গৈছি। আর যদি মরেই গিয়ে থাকি তা হলে আর কিসের ভয় আমার? আমি তো এখন ভূত। ভূতকে কি কখনও বাঘে ধরে?

আবার বিশটা বাজের মতো আওয়াজ করে, গর্ত ফাটিয়ে বাঘ হাঁক ছাড়ল–তারপরেই একটা পেল্লায় লাফ। আমি ঝট করে একটু সরে গিয়েছিলুম বলে বাঘ আমার গায়ে পড়ল না, কিন্তু ল্যাজটার ঘায়ে আমার নাক প্রায় থেঁতলে গেল। আর বাঘের নখের আঁচড়ে গর্তের গা থেকে খানিক মাটি ঝুরঝুর করে চোখময় ছড়িয়ে গেল।

এ তো ভালো ল্যাঠা দেখছি! বাঘ যদি আমাকে না-ও ধরে–বাঘের দাপাদাপিতেই আমি–মানে আমার ভূতটা মারা যাবে। কিংবা নাকে যখন ল্যাজের ঘা এসে এমন বেয়াড়াভাবে লেগেছে যে মনে হচ্ছে হয়তো আমি বেঁচেই আছি।

আবার বাঘের গর্জন। উঃ, কান দুটো তো ফেটে গেল! এসপার কি ওসপার!

এবার বাঘ লাফ মারবার আগেই আমি লাফ মারলুম। আর হাতে যা ঠেকল তা গোটাকয়েক গাছের শেকড়।

আমি পটলডাঙার প্যালারাম জীবনে কোনও দিন একসারসাইজ করিনি–পালাজ্বরে ভুগেছি আর পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খেয়েছি। দু-একবার খেলতে নেমেছিলুম, কিন্তু কী কাণ্ড যে করেছি তোমাদের ভেতর যারা প্যালারামের কীর্তি-কাহিনী পড়েছ তারা তা সবই জানো। সব্বাই আমাকে বলে–আমি রোগাপটকা, আমি অপদার্থ। কিন্তু এখন দেখলুম–রোগা-টোগা ওসব কিছু না–স্রেফ বাজে কথা। মনে জোর এলে আপনি গায়ের জোর এসে যায়–দুনিয়ার কোনও কাজ আর অসম্ভব বলে বোধ হয় না। আমি প্রাণপণে সেই শেকড় ধরে ঝুলতে লাগলুম। তাকিয়ে দেখি আরও শেকড় রয়েছে ওপরে। কাঁচা মাটির গর্তে পা দিয়ে দিয়ে শেকড় টেনে টেনে—

আরে—আরে—আমি যে ওপরে উঠে গেছি প্রায়! একটু–আর একটু–

নীচের গর্তে তখন যে কী দাপাদাপি চলছে ভাবাই যায় না। বাঘের চিৎকারে বিশটা নয়—পঁচিশটা নয়–একশোটা বাজ যেন ফেটে পড়ছে। বাঘ লাফিয়ে উঠছে থেকে থেকে–একবার একটা থাবা প্রায় আমার পা ছুঁয়ে গেল। শেষ শক্তি দিয়ে আমি সবচেয়ে ওপরের শিকড়টা টেনে ধরলুম, সেটা মটমট করে উঠল, তারপর ছিড়ে পড়ার আগেই আমি গর্তের মুখে আবার শক্ত মাটিতে উঠে পড়লুম।

আর তখন মনে হল, আমার বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা যেন ফেটে যাচ্ছে। কাঁধ দুটোকে কে যেন আলাদা করে ছিড়ে নিচ্ছে দুদিকে। কপাল থেকে ঘাম চোখে নেমে এসে সব। ঝাপসা করে দিচ্ছে, আগুন ছুটছে সারা গায়ে। ঘাসের ওপর দাঁড়াতে গিয়েও আমি দাঁড়াতে পারলুম না সত্যিই বেঁচে আছি না মরে গেছি ভালো করে বোঝবার আগেই সব অন্ধকার হয়ে গেল।

 

তারপর আস্তে আস্তে মাথাটা পরিষ্কার হতে লাগল। মুখের ওপর কী যেন সুড়সুড় করে হাঁটছে এমনি মনে হল। টোকা দিয়ে সেটাকে ফেলে দিয়ে দেখি, একটা বেশ মোটাসোটা গুবরে পোকা। চিত হয়ে পড়ে বোঁ-বোঁ করে হাত-পা ছুঁড়ছে।

আস্পর্ধা দ্যাখো একবার! আমার মুখখানাকে বোধহয় গোবরের তাল মনে করেছিল। এখন থাকো চিত হয়ে!

তক্ষুনি আবার যেন পাতাল থেকে কামানের ডাক এল। মাটিটা কেঁপে উঠল থরথরিয়ে।

দেখলুম, আমি মাটিতে পা ছড়িয়ে উবুড় হয়ে পড়ে আছি। আমার মাথার সামনে ঠিক ছইঞ্চি দূরে কুয়োর মতো মস্ত একটা গর্তের মুখ। আমার হাতের মুঠোয় কতগুলো সরু সরু ছেড়া শেকড়।

সব মনে পড়ে গেল। একটু আগেই গর্তটা থেকে আমি উঠে এসেছি। তারপর ভিরমি খেয়ে পড়ে গিয়েছিলুম।

কিন্তু গর্তের মধ্যে বাঘ কি এখনও আছে? নিশ্চয় আছে। নইলে সে উঠে এলে আমি আর মাটিতে থাকতুম না—আরও ভালো জায়গায় আমার থাকবার ব্যবস্থা হয়ে যেত—মানে বাঘের পেটের ভেতর। আর সেই শজারু? সে-ও নিশ্চয় যথাস্থানেই রয়েছে আর দুজনে মিলে জোর মজারু চলছে গর্তে।

মজা? বাঘের চিৎকার তো ঠিক সেরকমটা মনে হচ্ছে না।

আমি চার পায়ে ভর দিয়ে উঠলুম গলাটা একটু বাড়িয়ে দিলুম গর্তের দিকে। ভেতরে প্রথমটা খালি অন্ধকার মনে হল–আর বোধ হল, বিষম একটা দাপাদাপি চলছে। কিন্তু তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটু একটু করে আমি সব দেখতে পেলুম।

শজারুটা কেমন তালগোল পাকিয়ে পড়ে আছে তার চারটে পা আর মাথাটা অল্প অল্প নড়ছে। তার পাশেই পড়ে আছে বাঘ–লাফাচ্ছে না, সমানে হাঁপাচ্ছে, আর কী একটা যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে একটানা।

এবারে ব্যাপারটা বুঝতে আর বাকি রইল না।

বাঘ পড়েছিল সোজা শজারুর ওপর। তার ধারালো কাঁটাগুলো বাঘের সর্বাঙ্গে বিঁধেছে শরশয্যার মতো। আর তারই যন্ত্রণায় বাঘ অমনভাবে লাফঝাঁপ করছে–আমি যে শেকড় ধরে ধরে গর্ত বেয়ে ওপরে উঠে এসেছি, সে তা দেখতেও পায়নি। ওই শজারুটা নিজের প্রাণ দিয়ে আমায় বাঁচিয়েছে।

শজারুটার জন্যে আমার ভারি কষ্ট হতে লাগল। আর কেন জানি না–বাঘের জন্যেও মায়ায় মনটা আমার ভরে উঠল। সর্বাঙ্গে শজারুর কাঁটা বিঁধে না-জানি কত যন্ত্রণাই পাচ্ছে। বাঘটা। এর চাইতে যদি একেবারে মরে যেত, তাহলেও ঢের ভাল হত ওর পড়ে।

একমনে দেখছি–হঠাৎ টপাস্!

কী একটা ঢিলের মতো এসে পড়ল পিঠের ওপর। আরে—আরে করে উঠে বসলুম—আবার টপাস্! একেবারে চাঁদির ওপর। তাকিয়ে দেখি শুকনো সীমের মতো কী এরকম ফল।

ওপর থেকে আপনি পড়ছে নাকি?

না–না। যেই চোখ তুলে তাকিয়েছি, দেখি গাছের ডালে বসে কে যেন বিশ্রীরকমভাবে ভেংচি কাটছে আমাকে। ইয়া বড় একটা গোদা বাঁদর। এখানে আসা অবধিই দেখছি। হাড়বজ্জাত বাঁদরগুলো পেছনে লেগেছে আমাদের। নাকটাকে ছারপোকার মতো করে গাছ থেকে কতগুলো শুকনো ফল ছিড়ে ছিড়ে সে আমার পিঠ বরাবর তাক করছে, আর সমানে ভেংচি কেটে চলেছে।

আমি চেঁচিয়ে বললুম, এই!–তারপর বাঁদরটাকে আরও ঘাবড়ে দেবার জন্যে হিন্দী করে বললুম, ফের বদমায়েসী করেগা তো কান ধরকে এক থাপ্পড় মারেগা।

 

অবশ্য গাছের ওপর উঠে ওর কানটা হাতে পাওয়া মুস্কিল–থাপ্পড় মারা আরও মুস্কিল। কিন্তু যে করে হোক, বাঁদরটাকে নাভাস করে দেওয়া দরকার। আমি আবার বললুম, এক চাঁটিমে দাঁত উড়ায় দেগা। কেন ঢিল মারতা হ্যায়? হাম পটলডাঙার প্যালারাম হ্যায়–সমঝা?

বাঁদরটা দাঁত বের করে কী যেন বললে। —কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ কাঁচাগোল্লা কিংবা অমনি একটা কিছু হবে।

কাঁচাগোল্লা? আমার দারুণ মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আচ্ছা তাই সই! তোমায় কাঁচাগোল্লাই খাওয়াচ্ছি!

সামনেই কয়েকটা শুকনো মাটির ঢেলা পড়ে ছিল। তার দু-একটা তুলে নিয়ে বললুম, চলা আও—চলা আও—

সঙ্গে সঙ্গে নাকের ওপর আর-একটা ফল এসে পড়ল। বাঘের ল্যাজের ঘা খেয়ে নাকটা এমনিতেই বোঁচা হওয়ার জো–তার ওপর বাঁদরের এই বর্বর অত্যাচার! আমার শরীরে দস্তুরমতো ব্ৰহ্মতেজ এসে গেল।

চালাও ঢিল—লাগাও—

দমাদ্দম গাছের ওপর ঢিল চালাতে লেগে গেলুম। একেবারে মরিয়া হয়ে।

হঠাৎ বোঁ—ওঁ—ওঁ করে কেমন বেয়াড়া বিচ্ছিরি আওয়াজ।

এরোপ্লেন নাকি? আরে না-না–এরোপ্লেন কোথায়? গাছের একটা ডাল থেকে দল বেঁধে উড়ে আসছে ওরা কারা? চিনতে আমার একটুও কষ্ট হল না–ছেলেবেলায় মধুপুরে ওদের একটার মোক্ষম কামড় আমি খেয়েছিলুম। সেই থেকে ওদের আমি হাড়ে হাড়ে চিনি।

ভীমরুল! আমার ঢিল বাঁদরের গায়ে লাগুক আর না-লাগুক—ঠিক ভীমরুলের চাকে গিয়ে লক্ষ্যভেদ করেছে।

 

–মাঁরুচি–মাঁরুচি—খাউঞ্চি বলে বাঁদরটা এক লাফে কোথায় হাওয়া হল কে জানে! ওর মধ্যেই দেখতে পেলুম ওর নাকে মুখে ল্যাজে ভীমরুলেরা চেপে বসেছে। বোঝো–আমাকে ভ্যাংচানোর আর ঢিল মারবার মজাটা বোঝো!

কিন্তু এ কী! আমার দিকেও যে ছুটে আসছে ঝাঁক বেঁধে! এখন?

দৌড়দৌড়-মার দৌড়!

তবু সঙ্গ ছাড়ে না যে! যত ছুটছি, ততই যে পেছনে পেছনে আসছে ঝাঁক বেঁধে! এল–এল—এই এসে পড়ল–! গেছি এবার! কামড়ে আমাকে আর আস্ত রাখবে না!

এখন কী করি? বাঘের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে শেষে কি ভীমরুলের হাতে মারা যাব? আমি ঠিক এই সময়েই–

জয় গুরু। সামনে একটা পচা ডোবা!

ঝপাং করে আমি সেই ডোবাতেই সোজা ঝাঁপ মারলুম।


© 2024 পুরনো বই