রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়ে গেলে আমরা বারান্দায় এসে বসলুম। আকাশ আলো করে চাঁদ উঠেছে। চায়ের বাগান, দূরের শালবন, আরও দূরের পাহাড় যেন দুধে স্নান করছে। ঝিরঝিরে মিষ্টি হওয়ায় জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর। খাওয়াটাও হয়েছে দারুণ। আমার ইচ্ছে করছিল গিয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ি। কিন্তু কুট্টিমামা গল্পের থলি খুলে বসেছেন—সে-লোভও সামলানো শক্ত।
আমরা তিনজনে তিনটে চেয়ারে বসেছি। একখানা ছোট তক্তোপোশে আধশোয়া হয়ে আছেন কুট্টিমামা। সামনে গড়গড়া রয়েছে, গুড়গুড় করে টানছেন আর গল্প বলছেন।
সেই অনেক কাল আগের কথা। জঙ্গল, কেটে সবে চায়ের বাগান হয়েছে। বড় বড় পাইথন, বাঘ আর ভালুকের রাজত্ব। কালাজ্বর, আমাশা, ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া এসব লেগেই আছে। বাগানে কুলি রাখা শক্তদুদিন পরে কে কোথায় পালিয়ে যায় তার আর ঠিক-ঠিকানা থাকে না। কুলিদের আর কী দোষ-প্রাণের মায়া তো সকলেরই আছে।
তখন কুট্টিমামার বাবা এই বাগানে কাজ করতেন। পাকা রাস্তা ছিল না—যোলো মাইল দূরের রেল স্টেশন থেকে গোরুর গাড়ি করে আসতে হত। বাঘ-ভালুকের সঙ্গে দেখা হত হামেশা। কুট্টিমামা তখন খুব ছোট্ট কত জন্তু-জানোয়ার দেখেছেন কতবার।
তারই একদিনের গল্প।
সেবার কুট্টিমামা আর ওঁর বাবা নেমেছেন রেল থেকে বিকেলের গাড়িতে। সময়টা শীতকাল। একটু পরেই অন্ধকার নেমে এল। কাঁচা রাস্তা দিয়ে গোরুর গাড়ি দুলতে দুলতে এগিয়ে চলেছে। দুপাশে ঘন অন্ধকার শাল-শিমুলের বন। কুট্টিমামা চুপচাপ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন, জঙ্গলের মধ্যে থোকা থোকা জোনাক জ্বলছে। অনেক দূরে পাহাড়ের গায়ে হাতির ডাক-হরিণ ডেকে উঠছে মধ্যে মধ্যে গাড়ির সামনে দিয়ে ছুটে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে খরগোেশ। ঝিঝির আওয়াজ উঠছে একটানাঘুমের ভেতর গাছের ডালে কুঁক কুঁক করছে বনমুরগি।
দেখতে দেখতে আর শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন কুট্টিমামা। টুকুটক করে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ তাঁর ঘুম ভেঙে গেল।
গাড়ি থেমে দাঁড়িয়েছে। শালবনের ভেতর দিয়ে সেদিনও অনেকখানি চাঁদের আলো পড়েছে বনের রাস্তায়। সেই চাঁদের আলোয় আর বনের ছায়ায়–
কুট্টিমামা যা দেখলেন তাতে তাঁর দাঁতকপাটি লেগে গেল।
গোরুর গাড়ি থেকে মাত্র হাত দশেক দূরে দাঁড়িয়ে এক বিকট মূর্তি। কুচকুচে কালো লোমে তার শরীর ভরা বুকে কলারের মতো একটা শাদা দাগ। হিংসায় তার চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে। মুখটা খোলা—দুসারি দাঁত যেন সারি সারি ছুরির ফলার মতো সাজানো। আলিঙ্গন করবার ভঙ্গিতে হাত দুখানা দুপাশে বাড়িয়ে অল্প টলতে টলতে এগিয়ে আসছে সে।
ভালুক!
ভালুক বলে কথা নয়। এদিকের জঙ্গলে ছোটখাটো ভালুক কিছু আছেই। কিন্তু মানুষ। দেখলে তারা প্রায়ই বিশেষ কিছু বলে না—মানে মানে নিজেরাই সরে যায়। কিন্তু এ তো তা নয়! অদ্ভুত বড়—অস্বাভাবিক রকমের বিরাট! আর কী তার চোখ কী দৃষ্টি সেই চোখে! সাক্ষাৎ নরখাদক দানবের চেহারা!
গোরু দুটোর গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে। ছটফট করছে—একটা বিচিত্র আওয়াজ বেরুচ্ছে তাদের গলা দিয়ে।
কুট্টিমামার বাবাও দারুণ ভয় পেয়েছেন। সঙ্গে বন্দুক নেই। ফিসফিস করে বললেন, এখন কী হবে?
নেপালী গাড়োয়ান বীর বাহাদুর একটু চুপ করে থেকে বললে, কিছু ভাববেন না বাবু, আমি ব্যবস্থা করছি।
ফস করে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল বীর বাহাদুর। ভালুক তখন পাঁচ-সাত হাতের মধ্যে এসে পড়েছে। কুট্টিমামা ভাবলেন, এইবার গেছে বীর বাহাদুর। ভালুক এখুনি দুহাতে ওকে বুকে জাপটে ধরবে। আর যা চেহারা ভালুকের। একটি চাপে সমস্ত হাড়-পাঁজরা একেবারে গুঁড়ো করে দেবে। ভালুকরা অমনি করেই মানুষ মারে কিনা!
কিন্তু নেপালীর বাচ্চা বীর বাহাদুর—এ-সব জিনিসের অন্ধিসন্ধি সে জানে। চট করে গাড়ির তলা থেকে একরাশ খড় বের করে আনল, তারপর দেশলাই ধরিয়ে দিতেই খড়গুলো মশালের মতো দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।
আর সেই জ্বলন্ত খড়ের আঁটি নিয়ে সে এগিয়ে গেল ভালুকের দিকে।
আগুন দেখে ভালুক থমকে গেল। তারপর বীর বাহাদুর আর-এক পা সামনে বাড়াতেই সব বীরত্ব কোথায় উবে গেল তার! অতবড় পেল্লায় জানোয়ার চার পায়ে একেবারে চোঁ-চোঁ দৌড়–বোধহয় সোজা পাহাড়ে পৌঁছে তবে থামল।
কুট্টিমামার গল্প শুনে আমরা ভীষণ খুশি।
টেনিদা বললে, মামা, আমাদের কিন্তু শিকারে নিয়ে যেতে হবে।
কুট্টিমামা বললেন, যে-সব বীরপুরুষ, বাঘের ডাক শুনলেই—
হাবুল সেন বললে, না মামা, ভয় পামু না। আমরাও বাঘেরে ডাকতে থাকুম।
ডাইক্যা কমু—আইসো বাঘচন্দর, তোমার লগে দুইটা গল্পসল্প করি।
ক্যাবলা বললে, আর বাঘও অমনি হাবুলের পাশে বসে গলা জড়িয়ে ধরে গল্প আরম্ভ করে দেবে।
তখন আমি বললুম, আর মধ্যে-মধ্যে হাবলাকে আলুকাবলি আর কাজুবাদাম খেতে দেবে।
টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, কী যে বাজে বকবক করিস তোরা—একদম ভালো লাগে। হচ্ছে একটা দরকারি কথা-খামকা ফাজলামি জুড়ে দিয়েছে।
কুট্টিমামা হাই তুলে বললেন, আচ্ছা, সে হবে-এখন। এখন যাও শুয়ে পড় গে সবাই। কালকে ভাবা যাবে এসব।
টেনিদা, হাবুল আর কুট্টিমামা শুয়েছেন বড় ঘরে। এ-পাশের ছোট ঘরটায় আমি আর ক্যাবলা।
বিছানায় শুয়েই কুর-কুর করে ক্যাবলার নাক ডাকছে। কিন্তু অচেনা জায়গায় এত সহজেই আমার ঘুম আসে না। মাথার কাছে টিপয়ের উপর একটা ছোট্ট নীল টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। আমি ল্যাম্পটাকে একেবারে বালিশের পাশে টেনে আনলুম। তারপর সুটকেস খুলে শিবরামের নতুন হাসির বই জুতো নিয়ে জুতোজুতি আরাম করে পড়তে লেগে গেলুম।
পড়ছি আর নিজের মনে হাসছি। পাশেই খোলা জানালা দিয়ে মিঠে হাওয়া আসছে। দুধের মতো জ্যোৎস্নায় স্নান করছে চায়ের বাগান আর পাহাড়ের বন। কতক্ষণ সময় কেটেছে। জানি না। হাসতে হাসতে এক সময় মনে হল, জানালার গায়ে যেন খড়খড় করে আওয়াজ হচ্ছে।
তাকিয়ে দেখি, একটা বেশ বড়সড় বেড়াল। জানালার ওপর উঠে বসেছে—আর জ্বলজ্বল করে তাকাচ্ছে আমার দিকে।
বললুম, যাঃ—যাঃ—পালা—
পালাল না। বললে, গর্—র্—র্–
তখন আমার ভালো করে চোখে পড়ল।
শুধু একটা নয়—তার পাশে আর একটা বেড়াল। সেটার হাঁড়ির মতো প্রকাণ্ড মাথা—ভাঁটার মতো চোখ আর গায়ে ঘন হলদের ওপর কালো ফোঁটা।
এত বড় বেড়াল! আর, এ কেমন বেড়াল!
সেই প্রকাণ্ড বেড়ালটাও বললে, গর্—র্—র্–ঘুঁ!
আর ঘুঁ! আমি তৎক্ষণাৎ আকাশ-ফাটানো চিৎকার করলুম একটা। তারপর ক্যাবলাকে জড়িয়ে ধরে সোজা আছড়ে পড়লুম বিছানা থেকে। টেবিল ল্যাম্পটাও সেইসঙ্গে ভেঙে চুরমার।
আর সেই অথই অন্ধকারের ভেতর—