বনের বাঘ অবিশ্যি বনেই গেল, হালুম করে আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ল না। আর কুট্টিমামা হা হা করে হেসে উঠলেন।
-ওই একটুখানি বাঘ দেখেই ভিরমি খেলে, তোমরা যাবে জঙ্গলে শিকার করতে।
ততক্ষণে গাড়ি এক মাইল রাস্তা পার হয়ে এসেছে। জঙ্গল ফাঁকা হয়ে আসছে দুধারে। আমরাও নড়েচড়ে বসেছি ঠিক হয়ে।
টেনিদা বললে, না মামা, আমরা ভয় পাইনি। বাঘ দেখে ভারি ফুর্তি হয়েছিল কিনা, তাই বাঃ বাঃ বাঘ বলে আনন্দে চেঁচামেচি করছিলুম। শুধু প্যালাই যা ভয় পেয়েছিল। ও একটু ভিতু কিনা!
বাঃ–ভারি মজা তো। সবাই মিলে ভয় পেয়ে শেষে আমার ঘাড়ে চাপানো! আমি তাড়াতাড়ি বললুম, নানা, আমিও ভয় পাইনি। এই ক্যাবলাটাই একটুতে নার্ভাস হয়ে যায়, তাই ওকে ভরসা দিচ্ছিলুম!
ক্যাবলা নাক-মুখ কুঁচকে বললে, ব্যাস্-খামোশ!
শুনে আমার ভারি রাগ হয়ে গেল।
—খা মোষ। কেন—আমি মোষ খেতে যাব কী জন্যে? তোর ইচ্ছে হয় তুই মোষ খা—গণ্ডার খা—হাতি খা! পারিস তো হিপোপটেমাস ধরে ধরে খা!
কুট্টিমামা মিটমিট করে হাসলেন।
—ও তোমাকে মোষ খেতে বলেনি–বলেছে খামোশ—মানে,থামো। ওটা হচ্ছে। রাষ্ট্রভাষা।
বললুম, না ওসব আমার ভালো লাগে না! চারদিকে বাঘ-টাঘ রয়েছে—এখন খামখা রাষ্ট্রভাষা বলবার দরকার কী?
হাবুল সেন বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল।
–বুঝছস নি প্যালা–বাঘেও রাষ্ট্রভাষা কয় : হাম–হাম। মানে কী? আমি–আমি-যে-সে পাত্তর না-সাইক্ষাৎ বাঘ। বিড়ালে ইন্দুররে ডাইক্যা কয় : মিঞা আও–আইসো ইন্দুর মিঞা, তোমারে ধইর্যা চাবাইয়া খামু। আর কুত্তায় কয় : ভাগ—ভাগ—ভাগ হো–পলা—পলা, নইলে ঘ্যাঁৎ কইর্যা তর ঠ্যাঙে একখানা জব্বর কামড় দিমু–হঃ!
টেনিদা বললে, বাপূরে, কী ভাষা। যেন বন্দুক ছুঁড়ছে।
হাবুল বুক চিতিয়ে বললে, বীর হইলেই বীরের মতো ভাষা কয়। বোঝলা!
জবাব দিলে কুট্টিমামা। বললেন, বোঝলাম। কে কেমন বীর, দু-একদিনের মধ্যেই পরীক্ষা হবে এখন। এসব আলোচনা এখন থাক। এই যে—এসে পড়েছি আমরা।
সত্যি, কী গ্র্যান্ড জায়গা!
তিনদিকে জঙ্গল—আর একদিকে চায়ের বাগান ঢেউ খেলে পাহাড়ের কোলে উঠে গেছে। তার উপরে কমলালেবুর বাগান—অসংখ্য নেবু ধরেছে, এখনও পাকেনি, হলদে-হলদে রঙের ছোপ লেগেছে কেবল। চা বাগানের পাশে ফ্যাক্টরি, তার পাশে সায়েবদের বাংলো। আর একদিকে বাঙালি কর্মচারীদের সব কোয়ার্টার কুট্টিমামার ছোট্ট সুন্দর বাড়িটি। অনেকটা দূরে কুলি লাইন। ভেঁপু বাজলেই দলে দলে কুলি মেয়ে ঝুড়ি নিয়ে চায়ের পাতা তুলতে আসে, কেউ-কেউ পিঠে আবার ছোট্ট বাচ্চাদেরও বেঁধে আনে—বেশ মজা লাগে দেখতে।
সায়েবরা কলকাতায় বেড়াতে গেছে–কুট্টিমামাই বাগানের ছোট ম্যানেজার। আমরা গিয়ে পৌঁছুবার পর কুট্টিমামাই বললেন, খেয়ে-দেয়ে একটু জিরিয়ে নাও, তারপর বাগান-টাগান দেখবখন।
টেনিদা বললে, সেই কথাই ভালো মামা। খাওয়া-দাওয়াটা আগে দরকার। সে-চিনি যে কখন বলতে বলতেই সামলে নিলে : মানে সেই যে কখন থেকে পেট চিন-চিন করছে।
মামা হেসে বললেন, চান করে নাও–সব রেডি।
চান করবার তর আর সয় না—আমরা সব হুটোপুটি করে টেবিলে গিয়ে বসলুম।
একটা চাকর নিয়ে কুট্টিমামা এবাড়িতে থাকেন, কিন্তু বেশ পরিপাটি ব্যবস্থা চারদিকে। সব সাজানো গোছানো ফিটফাট। চাকরটার নাম ছোট্টুলাল। আমরা বসতে-বসতে গরম ভাতের থালা নিয়ে এল।
আমি জিজ্ঞেস করলুম, টেনিদা, তুমি যে রামভরসার কথা বলছিলে, সে কোথায়?
টেনিদা আমার কানে কানে বললে, চুপ–চুপ! রামভরসার নাম করিসনি। সে ভীষণ কাণ্ড হয়ে গেছে!
–কী ভীষণ কাণ্ড?
—ভাত দিয়েছে—খা না বাপু! টেনিদা দাঁত খিচুনি দিলে : অত কথা বলিস কেন? বকবক করতে করতে একদিন তুই ঠিক বক হয়ে উড়ে যাবি, দেখে নিস।
–বকবক করলে বুঝি বক হয়?
—হয় বইকি! যারা হাঁস-ফাঁস করে তারা হাঁস হয়, যারা ফিসফিস করে তারা ফিশ—মানে মাছ হয়—
আরও কী সব বাজে কথা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু থেমে গেল। ফিশকে থামিয়ে দিয়ে ডিশ এসে পড়েছে। মানে, মাংসের ডিশ!
—ইউরেকা!–বলেই টেনিদা মাংসের ডিশে হাত ডোবাল। একটা হাড় তুলে নিয়ে তক্ষুনি এক রামকামড়। ছোট্টলাল ওর গ্লাসে জল দিতে যাচ্ছিল, একটু হলে তার হাতটাই কামড়ে দিত।
ক্যাবলা বললে, মামা—হরিণের মাংস বুঝি? মামা বললেন, শিকারে না গেলে কি হরিণ পাওয়া যায়? আজকে পাঁঠাই খাও, দেখি কাল যদি একটা মারতে-টারতে পারি।
—আমরা সঙ্গে যাব তো?
—আমার আপত্তি নেই।-কুট্টিমামা হাসলেন : কিন্তু বাঘের সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায়—
ক্যাবলা বললে, না মামা, আমরা ভয় পাব না। পটলডাঙার ছেলেরা কখনও ভয় পায় না। আমাদের লিডার টেনিদাকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন না।…আচ্ছা টেনিদা, আমরা কি বাঘকে ভয় করি?
টেনিদা চোখ বুজে, গলা বাঁকিয়ে একমনে একটা হাড় চিবুচ্ছিল। হঠাৎ কেমন ভেবড়ে গেল।
বিচ্ছিরি রেগে, নাকটাকে আলুসেদ্ধর মতো করে বললে, দেখছিস মন দিয়ে একটা কাজ করছি, খামকা কেন ডিসটার্ব করছিস র্যা? হাড়টাকে বেশ ম্যানেজ করে এনেছিলুম, দিলি মাটি করে!
হাবুল ফ্যাকফ্যাক করে হেসে উঠল : তার মানে ভয় পাইতাছে!
–হ্যাঁ, ভয় পাচ্ছে। তোকে বলেছে!
–কওনের কাম কী, মুখ দেইখ্যাই তো বোঝন যায়। অখনে পাঠার হাড় খাইতাছ, ভাবতাছ বাঘে তোমারে পাইলেও ছাইড়্যা কথা কইব না—তখন তোমারে নি ধইর্যা—
বাঁ হাত দিয়ে দুম করে একটা কিল টেনিদা বসিয়ে দিলে হাবুলের পিঠে।
হাবুল হাউমাউ করে বললে, মামা দ্যাখেন—আমারে মারল।
মামা বললেন, ছিঃ ছিঃ মারামারি কেন। ওর যদি ভয় হয়, তবে ও বাড়িতে থাকবে। যাদের সাহস আছে, তাদেরই সঙ্গে করে নিয়ে যাব।
টেনিদার মেজাজ গরম হয়ে গেল।
–কী, আমি ভিতু।
ক্যাবলা বললে, না–না, কে বলেছে সেকথা। তবে কিনা তোমার সাহস নেই—এই আর কি।
–সাহস নেই।—এক কামড়ে পাঁঠার হাড় গুঁড়িয়ে ফেলল টেনিদা : আছে কি না দেখবি কাল! বাঘ-ভালুক-হাতি-গণ্ডার যে সামনে আসবে, এক ঘুষিতে তাকে ফ্ল্যাট করে দেব।
ক্যাবলা বললে, এই তো বাহাদুরকা বাত—আমাদের লিডারের মতো কথা!
মামা বললেন, শুনে খুশি হলাম। তবে যা ভাবছ তা নয়, বাঘ অমন ঝট করে গায়ের উপর এসে পড়ে না। তাকেই খোঁজবার জন্যে বরং অনেক পরিশ্রম করতে হয়। তা ছাড়া সঙ্গে দুটো বন্দুকও থাকবে—ঘাবড়াবার কিছু নেই।
হাবুল সেন খুশি হয়ে বললে, হ, সেই কথাই ভালো। বাঘেরে ঘুষিঘাষি মাইর্যা লাভ নাইবাঘে তো আর বক্সিং-এর নিয়ম জানে না। দিব ঘচাং কইর্যা একখানা কামড়! বন্দুক লইয়া যাওনই ভালো।
টেনিদা বললে, আঃ, তোদের জ্বালায় ভালো করে একটু খাওয়া-দাওয়া করবারও জো নেই, খালি বাজে কথা! কই হে ছোট্টুলাল, আর-এক প্লেট মাংস আনো। বেড়ে বেঁধেছে বাপু, একটু বেশি করেই আনো।
বিকেলে আমরা চায়ের বাগানে বেশ মজা করেই বেড়ালুম, কারখানাও দেখা হল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলুম দূরের কমলানেবুর বন পর্যন্ত। জায়গাটা ভালল—সামনে একটা ছোট্ট নদী রয়েছে। আমাদের সঙ্গে ছোট্টুলাল গিয়েছিল, সে বললে, নদীটার নাম জংলি।
সবাই বেশ খুশি, কেবল আমার মেজাজটাই বিগড়ে ছিল একটু। মানে, ব্যাপারটা তেমন। কিছু নয়। চা জিনিসটা খেতে ভালো, আমি ভেবেছিলুম চায়ের পাতা খেতেও বেশ খাসা লাগবে। বাগান থেকে একমুঠো কাঁচা পাতা ছিড়ে চুপি-চুপি মুখেও দিয়েছিলুম। মাগো কী যাচ্ছেতাই খেতে। আর সেই থেকে মুখে এমন একটা বদখত স্বাদ লেগে ছিল যে নিজেকে কেমন ছাগল-ছাগল মনে হচ্ছিল—যেন একটু আগেই কতগুলো কচি ঘাস চিবিয়ে এসেছি!
তার মধ্যে আবার নদীর ধারে দাঁড়িয়ে টেনিদা বাজখাঁই গলায় গান ধরলে :
এমনি চাঁদিনি রাতে সাধ হয় উড়ে যাই,–
কিন্তু ভাই বড় দুঃখ আমার যে পাখা নাই—
বলতে যাচ্ছি—এই বিকেলে চাঁদের আলো এল কোত্থেকে, এমন সময় ফস করে ক্যাবলা সুর ধরে দিলে :
তোমার যে ল্যাজ আছে,
তাই দিয়ে ওড়ো ভাই—
টেনিদা ঘুষি পাকিয়ে বললে, তবে রে—
ক্যাবলা টেনে দৌড় লাগাল। টেনিদা তাড়া করল তাকে। আর পরমুহূর্তেই এক গগনভেদী আর্তনাদ।
হাবুল, ছোট্টুলাল আর আমি দেখতে পেলুম। স্বচক্ষেই দেখলুম।
ঘন ঝোপের মধ্য একখানা কদাকার লোমশ হাত বেড়িয়ে এসে খপ করে টেনিদার কাঁধ চেপে ধরল। আর তারপর বেরিয়ে এল আরও কদাকার, আরও ভয়ঙ্কর একখানা মুখ। সে-মুখ মানুষের নয়। ঘন লোমে সে-মুখও ঢাকা—দুটো হিংস্র হলদে চোখ তার জ্বলজ্বল করছে—আর কী নিষ্ঠুর নির্মম হাসি ঝকঝক করছে তার দুসারি ধারালো দাঁতে।
হাবুল বললে, অরণ্যের বি–বি—বি—
আর বলতে পারল না। আমি বললুম–ভীষিকা, তারপরেই ধপাস করে মাটিতে চোখ বুজে বসে পড়লুম। আর টেনিদার করুণ মর্মান্তিক আর্তনাদে চারদিক কেঁপে উঠল।