০২. বিমানে চৈনিক রহস্য

ভজহরি মুখার্জি–স্বর্ণেন্দু সেন-কুশল মিত্র–কমলেশ ব্যানার্জি

নামগুলো শুনে চমকে চমকে উঠছ তো? ভাবছ–এ আবার কারা? হুঁ হুঁ ভাববার কথাই বটে। এ হল আমাদের চারমূর্তির ভালো নাম আগে স্কুলের খাতায় ছিল। এখন কলেজের খাতায়। ভজহরি হচ্ছে আমাদের দুর্দান্ত টেনিদা, স্বর্ণেন্দু হল ঢাকাই হাবুল, কুশল হচ্ছে হতচ্ছাড়া ক্যাবলা আর কমলেশ? আন্দাজ করে নাও।

এসব নাম কি ছাই আমাদের মনে থাকে? প্লেনে উঠতে যেতেই একটা লোক কাগজ

নিয়ে এইসব নাম ডাকতে লাগল। আমরাও–এই যে–এই যে বলে টকটক উঠে পড়লুম। হাবলা তো অভ্যাসে বলেই ফেলল, প্রেজেন্ট স্যার।

আরে রামো–এ কী প্লেন!

এর আগে আমি কখনও প্লেনে চাপিনি–কিন্তু বড়দা ও মেজদার কাছে কত গল্পই যে শুনেছি! চমৎকার সব সোফার মতো চেয়ার–থেকে-থেকে চা-কফি-লজেন্স-স্যাণ্ডউইচ-সন্দেশ খেতে দিচ্ছে, উঠে বসলেই সে কী খাতির। কিন্তু এ কী! প্লেনের বারো আনা বোঝাই কেবল বস্তা আর কাপড়ের গাঁট, কাঠের বাক্স, আবার এক জায়গায় দড়ি দিয়ে বাঁধা কয়েকটা হুঁকোও রয়েছে।

শুধু দুদিকে চারটে সিট কোনওমতে রাখা আছে আমাদের জন্যে। তাতে গদিটদি কিছু ছিল, কিন্তু এখন সব ছিড়েখুঁড়ে একাকার।

হাবুল সেন বললে, অ টেনিদা! মালগাড়িতে চাপাইলা নাকি?

টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, যা—যা-মেলা বকিসনি! কুড়ি টাকা দিয়ে প্লেন চাপবিকত আরাম পেতে চাস–শুনি? তবু তো ভাগ্যি যে প্লেনের চাকার সঙ্গে তোদের বেঁধে দেয়নি।

বলতে বলতে জন-তিনেক কোট-প্যান্ট-পরা লোক তড়াক করে প্লেনে উঠে পড়ল। তারপর সার্কাসের খেলোয়াড়ের মতো অদ্ভুত কায়দায় টকটক করে সেই বাক্সবস্তার ভূপ পেরিয়ে—একজন আবার কোগুলোতে একটা হোঁচট খেয়ে ওপাশের প্রবেশ নিষেধ লেখা একটা কাচের দরজার ওপারে চলে গেল।

টেনিদা বললে, ওরা পাইলট। এখুনি ছাড়বে।

ক্যাবলা বললে, ইস, পাইলট হওয়া কী কষ্ট! বাক্স আর বস্তার উপর দিয়ে লাফাতে হয় কেবল।

যাত্রী আমরা মাত্র চারজন। দুদিকের সিটগুলোতে চেপে বসতে-বসতে হঠাৎ ঘুরুর ঘুরুর করে আওয়াজ আরম্ভ হল। তারপরেই গুড়গুড়িয়ে চলতে আরম্ভ করল প্লেনটা।

আমরা তাহলে সত্যিই এবার আকাশে উড়ছি। কী মজা। এবার মেঘের উপর দিয়েনদী গিরি কান্তার মানে আরও কী সব যেন বলে—অটবী-টটবী পার হয়ে দূর-দূরান্তে চলে যাব। আমার পিসতুতো ভাই ফুচুদা এখন থাকলে নিশ্চয় কবিতা লিখত :

পাখি হয়ে যাই গগনে উড়িয়া,
ফড়িং টড়িং খাই ধরিয়া—

কিন্তু ফড়িং খাওয়ার কথা কি লিখত? আমার একটু খটকা লাগল। কবিরা কি ফড়িং খায়? বলা যায় না–যারা কবি হয় তাদের অসাধ্য আর অখাদ্য কিছুই নেই।

এইসব দারুণ চিন্তা করছি, আর প্লেনটা সমানে গুড়গুড় করে চলেছে। আমি ভাবছিলুম এতক্ষণে বুঝি মেঘের উপর দিয়ে কান্তার মরু দুস্তর পারাবার এইসব পাড়ি দিচ্ছি। দুৎ–কোথায় কী! খালি ডাঙা দিয়ে চলছে তো চলছেই!

টেনিদার পাশ থেকে হাবুল বললে, কই টেনিদা—উড়তে আছে না তো?

ক্যাবলা একটা এলাচ বের করে চিবুচ্ছিল। আমি খপ করে নিতে গেলুম পেলুম খোসাটা। রাগ করে বললুম, উড়বে না ছাই। মালগাড়ি কোনওদিন ওড়ে নাকি?

ক্যাবলা বললে যাচ্ছে তো গড়গড়িয়ে। কাল হোক, পরশু হোক,—ঠিক পৌঁছে যাবে।

হাবুল করুণ গলায় বললে, কয় কী–অ টেনিদা! এইটা উড়ব না? সঙ্গে সঙ্গে প্লেন দাঁড়িয়ে পড়ল। আর বেজায় জোরে ঘর ঘর করে আওয়াজ হতে লাগল।

আমি বললুম, যাঃ, থেমে গেল!

ক্যাবলা মাথা নেড়ে বললে, হুঁ–স্টেশনে থামল বোধহয়। ইঞ্জিনে জল-টল নেবে।

টেনিদা ভীষণ রেগে গেল এবার।

-টেক কেয়ার ক্যাবলা–আমার কুট্টিমামার দেশের প্লেন! খবরদার—অপমান করবিনি বলে দিচ্ছি।

–তবে ওড়ে না কেন! খালি আওয়াজ করে–মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে!

বলতে বলতেই আবার ঘর ঘর করে ছুটতে আরম্ভ করল প্লেন। তারপরেই–ব্যাস, টু করে যেন ছোট্ট একটু লাফ দিলে, আর সব আমাদের পায়ের তলায় নেমে যাচ্ছে।

আমরা উড়েছি! সত্যিই উড়েছি।

টেনিদা আনন্দে চেঁচিয়ে উঠে বললে, তবে যে বলছিলি উড়বে না? কেমন–দেখলি তো এখন? ডি-লা-এ্যাণ্ডি মেফিস্টোফিলিস—

আমরা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বললুম, ইয়াক-ইয়াক!

প্লেন উড়েছে। দেখতে দেখতে বাড়িঘরগুলো খেলনার মতো ছোট্ট-ছোট্ট হয়ে গেল, গাছগুলোকে দেখাতে লাগল ঝোপের মতো, রাস্তাগুলো চুলের সিঁথির মতো সরু হয়ে গেল আর রুপোর সাপের মতো আঁকাবাঁকা নদীগুলো আমাদের অনেক নীচে লুকিয়ে রইল।

মেজদার কাছে আগেই শুনেছিলুম, প্লেনে চেপে সিনারি দেখতে হলে জানলার পাশে যেতে হয়। আমিও কায়দা করে আগেই বসে পড়েছি। ক্যাবলা মিনতি করে বললে, তুই আমার জায়গায় আয় না প্যালা–আমিও ভাল করে একটুখানি দেখে নিই! আমি বললুম, এখন কেন? এলাচের খোসা দেবার সময় মনে ছিল না?

—তোকে চকলেট দেব।

—দে।

ঘাড় চুলকে ক্যাবলা বললে, এখন তো সঙ্গে নেই, কলকাতায় ফিরে গিয়ে দেব।

—তবে কলকাতায় ফিরেই সিনারি দেখিস। —আমি তক্ষুনি জবাব দিলুম।

 

ক্যাবলা ব্যাজার হয়ে বললে, না দিলি দেখতে–বয়ে গেল! কীই বা আছে দেখবার! ভারি তো বাঁশবন আর পচা ডোবা–-ও তো পাড়াগাঁয়ে গিয়ে তালগাছের উপরে চাপলেই দেখা যায়।

–দ্রাক্ষাফল অতিশয় টক–শেয়াল বলেছিল।–আমি ক্যাবলাকে উপদেশ দিলুম; তবে যা-তালগাছের মাথাতেই চাপ গে।

ওদিকে টেনিদা আর হাবুলের মধ্যে দারুণ তর্ক চলছে।

হাবুল বললে, আমার মনে হয়, আমরা বিশ হাজার ফুট উপর দিয়া যাইত্যাছি।

টেনিদা নাকটাকে কুঁচকে বললে, ফুঃ! আমার কুট্টিমামার দেশের প্লেন অত তলা দিয়ে যায় না। আমরা কম-সে কম পঞ্চাশ হাজার ফুট উপর দিয়ে যাচ্ছি।

ক্যাবলা মিটমিট করে হাসল। তারপর বললে, কেইসা বাত বোস্তা তুমলোক। এসব ডাকোটা প্লেন, যেগুলো মাল টানে, কখনও ছ-সাত হাজার ফুটের উপর দিয়ে যায় না।

—এই ক্যাবলাটার সব সময় পণ্ডিতি করা চাই। টেনিদা মুখখানা হালুয়ার মতো করে বললে, থাম, ওস্তাদি করিসনি! এসব কুট্টিমামার দেশের প্লেন–পঞ্চাশষাট হাজারের নীচে কথাই কয় না।

ক্যাবলা বললে, আমি জানি।

টেনিদার হালুয়ার মতো মুখটা এবার আলু-চচ্চড়ির মতো হয়ে গেল : তুই জানিস? তবে আমিও জানি। এক্ষুনি তোর নাকে এমন একটা মুগ্ধবোধ বসিয়ে দেব যে—

ক্যাবলা তাড়াতাড়ি বললে, না-না, আমারই ভুল হয়ে গিয়েছিল। এই প্লেনটা বোধহয় এখন একলাখ ফুট উপর দিয়ে যাচ্ছে।

 

–এক লাখ ফুট! —আমি হাঁ করে রইলুম। সেই ফাঁকে ক্যাবলা আমার মুখের ভেতরে আবার একটা এলাচের খোসা ফেলে দিলে।

হাবুল বললে, খাইছে! এক লাখ ফুট! অ টেনিদা–!

টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, কী বলবি বল না! একেবারে শিবনের হয়ে বসে রইলি কেন?

—আমরা তো অনেক উপরে উইঠ্যা পড়ছি!

টেনিদা ভেংচে বললে, তা পড়ছি। তাতে হয়েছে কী?

–চাঁদের কাছাকাছি আসি নাই?

টেনিদা উঁচুদরের হাসি হাসল।

–হ্যাঁ, তা আর-একটু উঠলেই চাঁদে যাওয়া যেতে পারে।

—তা হইলে একটু কও না পাইলটেরে। চাঁদের থিক্যা একটু ঘুইর্যাই যাই। বেশ ব্যাড়ানোও হইব, রাশিয়ান স্পুটনিক আইস্যা পড়ছে কি না সেই খবরটাও নিতে পারুম।

ক্যাবলা বললে, হুঁ, চাঁদে সুধাও আছে শুনেছি। এক-এক ভাঁড় করে খেয়ে যাওয়া যাবে।

আমার শুনে কেমন খটকা লাগল। এত সহজেই কি চাঁদে যাওয়া যায়? কাগজে কী সব যেন পড়েছিলুম। চাঁদ, কী বলে–সেই যেন কত লক্ষ মাইল দূরে মানে, যেতে-টেতে অনেক দেরি হয় বলেই শুনেছিলুম। এমন চট করে কি সেখানে যাওয়া যাবে? আরও বিশেষ করে এই মালগাড়িতে চেপে?

কিন্তু টেনিদাকে সে কথা বলতে আমার ভরসা হল না। কুট্টিমামার দেশের প্লেন। সে-প্লেন সব পারে। আর পারুক বা নাই পারুক, মিথ্যে টেনিদাকে চটিয়ে আমার লাভ কী? এসে হয়তো টকাটক চাঁদির উপরে গোটাকয়েক গাঁট্টাই মেরে দেবে। আমি দুনিয়ার সব খেতে ভালবাসি–কলা, মুলো, পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল, চপ কাটলেটকালিয়া কিছুতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু ওই চাঁটি-গাঁট্টাগুলো খেতে আমার ভালো লাগে

—একদম না। হাবুল আবার মিনতি করে বললে, অ টেনিদা, একবার পাইলটেরে রিকোয়েস্ট কইর‍্যা–চল না চাঁদের থিক্যা একটুখানি ব্যাড়াইয়া আসি।

হাবুল সেন ইয়ার্কি করছে নির্ঘাত! আমার দিকে তাকিয়ে একবার চোখ পিটপিট করলে। কিন্তু টেনিদা কিছু বুঝতে পারল না। বুঝলে হাবলার কপালে দুঃখ ছিল।

টেনিদা আবার উঁচুদরের হাসি হাসল–যাকে বাংলায় বলে, হাইক্লাস। তারপর বললে, আচ্ছা, নেস্ট টাইম। এখন একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে কিনা–মানে কুট্টিমামা আমাদের জন্যে এতক্ষণ হরিণের মাংসের ঝোল রেডি করে ফেলেছে। তা ছাড়া রাশিয়ান আর আমেরিকানরা যাওয়ার এত চেষ্টা করছে, ওদের মনে ব্যথা দিয়ে আগে চাঁদে যাওয়াটা উচিত হবে না। ভারি কষ্ট পাবে। আমার মনটা বড় কোমল রে–কাউকে দুঃখ দিতে ইচ্ছে করে না। আমরা সবাই বললুম, সে তো বটেই!

টেনিদা বললে, যাক চাঁদে পরে গেলেই হবে এখন। ও আর কী–গেলেই হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, কুট্টিমামার হরিণের ঝোল মনে পড়তে ভারি খিদে পেয়ে গেল রে। কী খাওয়া যায় বল দিকি?

-এই তো খেয়ে এলে–আমি বললুম, এক্ষুনি খিদে পেল?

টেনিদা বললে, পেল। যাই বল বাপু, আমার খিদে একটু বেশি। বামুনের পেট তো প্রত্যেক দশ মিনিটেই একেবারে ব্রহ্মতেজে দাউদাউ করে ওঠে। কিন্তু কী খাই বল তো?

হাবুল বললে, ওই তো একটা বস্তা ফুটা হইয়া কী জ্যান পড়তে আছে! লবণ মনে হইত্যাছে। খাইবা?

আমরা একসঙ্গে তাকিয়ে দেখলুম। তাই বটে। একটা ছোট বস্তায় ছোট একটা ফুটো হয়েছে। সেখান থেকে শাদা গুঁড়ো-গুঁড়ো কী সব পড়ছে। লবণ? কিন্তু কিন্তু কেমন সন্দেহজনক!

একলাফে দাঁড়িয়ে পড়ল টেনিদা। বললে, দেখি কী রকম লবণ!

বলেই বস্তা থেকে খানিকটা আঙুলের ডগায় তুলে নিলে। তারপর চেঁচিয়ে বললে, ডি-ল্যা-এ্যাণ্ডি! ইউরেকা! আমরা বললুম, মানে?

–বস্তার রহস্যভেদ। মানে?

–বস্তার চৈনিক রহস্য। —চৈনিক রহস্য!

সে আবার কী?–আমি জানতে চাইলুম। টেনিদা বললে, চিনি—চিনি—পিয়োর চিনি। যে-চিনি দিয়ে সন্দেশ তৈরি হয়, যে-চিনির রহস্যভরা রসের ভিতরে রসগোল্লা সাঁতার কাটে! যে-চিনি–

আর বলতে হল না। চিনিকে আমরা সবাই চিনি–কে না চেনে?

পড়ে রইল চাঁদ, নদী-গিরি কান্তারের শোভা। আমরা সবাই চিনির বস্তার ফুটোটাকে বাড়িয়ে ফেললুম।

তারপর—

তারপর বলাই বাহুল্য।


© 2024 পুরনো বই