সংকলকের নিবেদন
‘টেনিদা সমগ্র’ প্রকাশিত হল ।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের যাবতীয় ছোটদের লেখা এখন ‘সমগ্র কিশোরসাহিত্য নামের সংকলনে পাওয়া যায়। চার খণ্ডের সেই আনন্দ-প্রকাশনাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়ও বটে। তবু কেন আলাদা করে এই ‘টেনিদাসমগ্র, এমন প্রশ্ন—কেউ তুলবেন বলে মনে হয় না, তাও–যদি কেউ তোলেন, জবাবদিহির দায় একটা থেকেই যায়। এর উত্তরে বলি, চার খণ্ডের ‘সমগ্র কিশোরসাহিত্য’-এর ভিত্তিতেই ‘টেনিদাসমগ্র’ সংকলিত, তবু এই সংগ্রহে এমন-কিছু রয়েছে যা কিনা ‘সমগ্র কিশোরসাহিত্য-এ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর । আর তা হল, শুধুই টেনিদার গল্প-উপন্যাসের কাহিনী পরপর পড়ে যাবার, পড়তে-পড়তে অবিমিশ্র আনন্দ উপভোগ করে যাবার এক দুর্লভ সুযোগ ।
এ কথা অবিসংবাদিত রূপে সত্যি যে, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটদের লেখা মাত্রেই দারুণ উপভোগ্য। কিন্তু টেনিদার ক্ষেত্রে তার মাত্রাটা যেন কূল-ছাপানো । প্রেমেন্দ্র মিত্রের যেমন ঘনাদা, পরবর্তীকালে সত্যজিৎ রায়ের যেমন ফেলুদা, তেমনই এক পরম পাঠকপ্রিয় চরিত্র টেনিদা। বয়স-ভোলানো, প্রজন্ম-পেরুনো, অবাক করা এই পাঠকপ্রিয়তা। টেনিদার সঙ্গে ঘনাদার মিল নেই, ফেলুদা তো গোয়েন্দাচরিত্র, টেনিদা একেবারে টেনিদারই মতন । এক এবং অদ্বিতীয়। টেনিদার মুখের কথা আজ প্রবচন, পটলডাঙার চারমূর্তির কীর্তিকাহিনী আজ কিংবদন্তী । এই অবিস্মরণীয় প্রবচন আর কিংবদন্তীকেই দু’ মলাটের মধ্যে পুরোপুরি ধরে রাখার চেষ্টা এই বইতে ।
এই সংগ্রহে রইল টেনিদাকে নিয়ে লেখা পাঁচটি উপন্যাস, বত্রিশটি গল্প আর একটি নাটিকা। এর বাইরেও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা টেনিদার কোনও গল্প-উপন্যাস-নাটকের যদি খোঁজ পান কোনও সহৃদয় পাঠক, তাঁর উদ্দেশে অনুরোধ রইল, তিনি যেন অনুগ্রহ করে প্রকাশকের ঠিকানায় সংবাদটি জানিয়ে এই সংগ্রহকে সম্পূর্ণাঙ্গ করে তুলতে সহযোগিতা করেন। এই সূত্রেই বলি, এই সংকলন করতে গিয়ে টেনিদার নামে এমন গল্প-উপন্যাসও দু’-একটি বাজারচালু গ্রন্থে চোখে পড়েছে যা কিনা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর প্রকাশিত এবং তাঁর লেখা নয় । সে-লেখা এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা সঙ্গত মনে হয়নি ।
প্রয়োজনীয় তথ্য জোগাড় করতে না পারায় এই সংগ্রহের গল্প-উপন্যাস রচনাকাল-অনুসারে বিন্যস্ত করা গেল না । এ-ত্রুটির দায় সর্বাংশে সংকলকের । তবে, নিতান্ত এলোমেলোভাবে রচনাগুলি সাজিয়ে দিতেও মনের সায় মেলেনি। তাই, মধুর অভাবে গুড়ের ব্যবস্থার মতন, বিকল্প বিন্যাসের কথা ভাবতে হয়েছে। পাঠকের চোখে খুঁজে বার করতে চেয়েছি টেনিদা-কাহিনী সমূহের অন্তর্লীন ধারাবাহিকতা। যেভাবে তা ধরা পড়েছে, সেই পারম্পর্যেই সাজিয়ে দেওয়া হল উপন্যাস-গল্পের নতুন ক্রম। এ-বিষয়েও টেনিদা-অনুরাগীদের যাবতীয় অভিমত ও পরামর্শ সাদরে গৃহীত হবে। এভাবে সাজাতে গিয়ে টেনিদা-কাহিনীর কতকগুলি অচেনা দিক চোখের সামনে ফুটে উঠেছে, চোখে পড়েছে কিছু কিছু অসঙ্গতিও । এ-নিয়ে পরিশিষ্টে যোগ করা হল সংক্ষিপ্ত একটি আলোচনা। সেই সঙ্গে সংযোজিত হল আনন্দবাজার পত্রিকায় সম্প্রতি-প্রকাশিত সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটি দারুণ কৌতূহলকর প্রতিবেদন। যে-চরিত্রের আদলে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় গল্পের টেনিদাকে নিজের মতো করে সৃষ্টি করে নিয়েছিলেন, ক’দিন আগে বাস্তবের সেই টেনিদার সঙ্গে পটলডাঙায় গিয়ে মুখোমুখি কথা বলে এসেছেন সাংবাদিক দীপংকর চক্রবর্তী । টেনিদার সাক্ষাৎকার-সংকলিত তাঁর সেই লেখাটিকে তিনি এ-গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করতে দিয়েছেন। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি এ-গ্রন্থের প্রকাশক বন্ধুবর বাদল বসুর কাছেও, আলস্যপরায়ণ, অছিলা-অনুরাগী ও খুঁতখুঁতে স্বভাবের লেখকের কাছ থেকেও ঠিক সময়ে পাণ্ডুলিপি আদায় করে নেবার সমূহ কৌশল যাঁর করায়ত্ত ।
পরিশেষে একটি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ । এই সংকলন করার পিছনে নিরন্তর প্রেরণা, তাগিদ ও প্ররোচনা জুগিয়েছিল অতি কাছের এক গ্রন্থভুক্ পাঠিকা। আজ যখন সত্যি-সত্যি বেরুতে চলেছে ‘টেনিদা সমগ্র, সে তখন নয়নসমুখ থেকে নয়নের মাঝখানে। বেদনার্ত চিত্তে এই সম্পাদনার ফসল তার উদ্দেশেই উৎসর্গ করলাম ।
প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়
১ মাঘ, ১৪০২ বঙ্গাব্দ
রূপসাগর অ্যাপার্টমেন্ট
কলকাতা ৭০০ ০৫৫