ধনঞ্জয় ও লীলার মধ্যে গভীর ভালোবাসা।
কোনো নাটকীয় রোমাঞ্চকর ঘটনার মধ্যে তাদের ভালোবাসা জন্মেনি, প্রেমে পড়ার বয়স হবার পর ঘটনাচক্রে হঠাৎ দেখা এবং পরিচয় হয়েও নয়। অল্প বয়স থেকে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও স্নেহ-মমতার সম্পর্ক বড় হয়ে ক্রমে ক্রমে যে ভালোবাসায় পরিণত হয়, তাদের প্রেমটা সেই জাতের।
লীলা যখন স্কুল পার হয়ে কলেজে ঢুকেছে এবং ধনঞ্জয় ব্যবসায়ে নেমেছে তখনো তারা ভালোবাসা টের পায়নি। মাঝখানে ধনঞ্জয় ব্যবসা উপলক্ষে বছর তিনেক বাইরে ছিল–সেই সময় দুজনের মনেই খটকা লাগে যে ব্যাপারটা তবে কি এই? ধনঞ্জয় ফিরে আসা মাত্র সব জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়ে যায়–প্রথম দর্শনের দিনেই।
তা, হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে এত আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। বিশেষ এ রকম পাকাঁপোক্ত বনিয়াদের ওপর অনেককাল ধরে যে ভালোবাসা গড়ে ওঠে সেটা বিরাট দালানের মতোই–গাঁথুনি শেষ হবার আগে কে সেটাকে ইমারত বলে মনে করে?
তারপর বছরখানেক ধরে তাদের ভালোবাসা জমাট বেঁধেছে। এখন বিয়ের মধ্যে যথারীতি সমাপ্তি ঘটলেই হয়।
একটু বাধা আছে, তেমন মারাত্মক কিছু নয়। ব্যবসা ধনঞ্জয় মন্দ করছে না। কিন্তু এখনো ততটা ভালো করতে পারেনি লীলার বাবা পশুপতির যেটুকু দাবি। এমন একটা কিছু এখনো ধনঞ্জয় করতে পারেনি যাতে ব্যবসায়ী জাতের বড় বা মাঝারি রাঘব বোয়ালদের সঙ্গে তুলনায় যতই ছোট হোক অন্তত বড় ব্যবসায়ীর জাতে উঠতে পেরেছে বলে তাকে গণ্য করা যায়।
কথাটা স্পষ্ট করার জন্য ধনঞ্জয় বলেছে, যেমন ধরুন লাখ টাকা? কিন্তু সেটা কীভাবে দেখতে চান? কারবারে খাটছে অথবা ব্যাংকে জমা হয়েছে?
পশুপতি বলেছে, না না, এমন কথা আমি বলছি না যে আগে তোমাকে লাখপতি হতে হবে? লাখ টাকার কারবারি কি দেউলে হয় না? সে হল আলাদা কথা। ব্যবসার আসল ঘাটিতে তুমি মাথা গলিয়েছ–এটুকু হলেই যথেষ্ট। তারপর তোমার লাক আর আমার মেয়ের লাক। তুমি এখনো যাকে বলে ব্যবসায়ে এপ্রেন্টিস।
লীলার ইচ্ছা হলে অবশ্য এ বাধাটুকু কোথা ভেসে যেত। কিন্তু লীলাও এ বিষয়ে বাপের মতের সমর্থক।
সে বলে, যাই বল তাই বল; এদিকে ঢিল দিলে চলবে না। তোমার চাড় নষ্ট হয়ে যাবে–আমাকে নিয়ে মেতে থাকবে দিনরাত। তোমার ফিউচার নষ্ট করতে রাজি হব অত সস্তা পাওনি আমাকে।
ধনঞ্জয়ের ভবিষ্যৎ অবশ্য লীলারও ভবিষ্যৎ। কিন্তু ভালোবাসার মানেও তো তাই। কাজেই, এটা লীলার স্বার্থপরতা মনে করা ছেলেমানুষি ছাড়া কিছু নয়। ধনঞ্জয়। তা মনেও করে না।
খুব বেশি দুর্ভাবনার কারণও তার নেই। অপূর্ব যে কালোবাজার সৃষ্টি হয়েছে, অপূর্ব যে স্বাধীনতা পাওয়া গেছে ব্যবসা করে মুনাফা লুটবার, তাতে একবার একটা লাগসই সুযোগ পাকড়াতে পারলে আর দেখতে হবে না, রাতারাতি ব্যবসাজগতে নিজেকে এমন স্তরে তুলে নিতে পারবে যে লীলা বা তার বাবার কিছু বলার থাকবে না।
লীলা মাঝে মাঝে বলে, কী করছ তুমি? অ্যাদ্দিনেও কিছু করতে পারলে না, টুকটাক চালিয়ে যাচ্ছ! এদিকে কত বাজে লোক উতরে গেল। লোকেশবাবুর হতভাগা ছেলেটা পর্যন্ত একটা পারমিট বাগিয়ে কী রেটে কামাচ্ছে!
ধনঞ্জয় বলে, তোমরা শুধু ব্ল্যাকমার্কেটটা দেখছ আর এটা বাগিয়ে ওটা বাগিয়ে কত সহজে কে বড়লোক হচ্ছে সেটা দেখছ। ওই বাগানোর জন্য যে কী ভয়ানক কম্পিটিশন, কত কাঠখড় পোড়াতে হয়–সেটা তো দেখছ না।
লীলা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে হেসে বলে, তুমি পারবে। বাবা বলেন, মালটা তুমি খাঁটি।
ধনঞ্জয় হেসে বলে, আর তুমি কী বল? ভেজাল?
ভেজাল! আমার কাছে ভেজাল চলে? খাঁটি না হলে তোমায় আমি হাত ধরতে দিলাম?
ইতোমধ্যে ধনজ্ঞয়ের আশা-লোলুপতার বৃন্তে ফুল ধরবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। একদিকে যেমন বেড়ে যায় তার কর্মব্যস্ততা আর কমে যায় লীলার সঙ্গে দেখা করা গল্প করার সময়, অন্যদিকে তেমনি তার কথাবার্তা চালচলনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নতুন ধরনের একটা উৎসাহ ও উত্তেজনা।
কী হয়েছে তোমার?
লীলার প্রশ্নের জবাবে ধনঞ্জয় তাকে শুধু একটু আদর করে।
ব্যাপারটা কী?
বলব পরে।
লীলা হেসে বলে, বলতে হবে না, আমি বুঝেছি।
বুঝেছ?
বুঝব না? বিয়ের তারিখ ঘনিয়ে না এলে পুরুষমানুষের এ রকম ফুর্তি হয়!
কয়েকদিন পরে তারা দুজনে এক ভাটিয়া কোটিপতির বাড়িতে এক উৎসবের নিমন্ত্রণ রক্ষা করে ফিরেছে। ধনঞ্জয় বলে, একটা মোটা কন্ট্রাক্ট বোধ হয় পাব।
লীলা গিয়েছিল পশুপতির সঙ্গে, ধনঞ্জয় গিয়েছিল একা। প্রীতি অনুষ্ঠানে ধনঞ্জয় অযাচিত উপেক্ষিত হয়ে ছিল আগাগোড়া–যেটুকু খাতির পেয়েছিল সবটুকুই লীলার জন্য। কিন্তু আজ ধনঞ্জয়ের কোনো ক্ষোভ আছে মনে হয় না।
লীলা খুশি হয়ে বলে, খুলে বলো।
ধনঞ্জয় খুলেই বলে। হাজার আশি টাকার ব্যাপার। পরে কৌশলে আরো কিছু বাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
মি. নিরঞ্জন দাস দেবার মালিক, তাকে অনেক চেষ্টায় বাগানো গেছে।
বাবা কম হাঙ্গামা করতে হয়েছে আমাকে! লোকটা নিজে এতটুকু রিস্ক নেবে না, সব নিয়মদুরস্ত হওয়া চাই! কোনো দিক ফাঁক থাকলে চলবে না। অথচ এদিকে চাহিদাটি ঠিক আছে। দশ বছরের পুরনো ফার্ম ছাড়া কন্ট্রাক্ট দেওয়া চলবে না। এরকম একটা ফার্ম কোথায় লালবাতি জ্বালতে বসেছে খুঁজে খুঁজে গা বাঁচিয়ে কিনে নেওয়া কি সোজা কাজ!
কিনেছ?
হ্যাঁ। তবে মোটা রকম ঢালতে হয়েছে। তিনটে দিন মোটে সময়, করি কী। গরজ বুঝে গেল। যাকগে, সব তুলে নেব। হাজার গুণ তুলে নেব।
লীলা একটু ভেবে বলে, সব একেবারে ঠিকঠাক তো?
ধনঞ্জয় বলে, তা একরকম ঠিকঠাক বৈকি!
একরকম!
লীলা ধনঞ্জয়ের একটা কান আদর করে মলে দেয়, বাবা যে বলেন তুমি এপ্রেন্টিস, সেটা মিছে নয়। এত টাকা ঢেলে এতদূর এগিয়ে এখনো বলছ একরকম ঠিক! মোটা নিরঞ্জনকে বাধনি বুঝি যাতে কোনোরকম গোলমাল করতে না পারে? কী বুদ্ধি। এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি এই বাজারে ব্যবসা করবে!
ধনঞ্জয় রীতিমতো ভড়কে যেতে লীলা সাহস দিয়ে বলে, মোটা নিরঞ্জন তো? গোলমাল করবে না মনে হয়। আমি বরং একটু চাপ দেব। লোকটা খুব শিভালরাস।
চাপ দেবে মানে?
লীলা সশব্দে হেসে ওঠে, অমনি ঈর্ষা জাগল? এই মোটা নিরঞ্জনকেও তুমি ঈর্ষা করতে পার আমার বিষয়ে! ধন্য তুমি! মেয়েরা কী করে গা বাঁচিয়ে চাপ দেয় জান না?
গা বাঁচিয়ে চাপ দিতে গেলেও কাছে যেতে হয়, মিশতে হয়, হাসি আর মিষ্টি কথায় মন ভুলাতে হয়। তার ফলেই সৃষ্টি হল সমস্যা।
প্রেমের সমস্যা।
এতদিন পর্যন্ত তাদের ধারণা ছিল যে জগতে অন্য সমস্ত কিছুর দরদাম আছে, একটা ফুটো পয়সায় হোক বা লক্ষ টাকায় হোক সবকিছুর দাম ঠিক করা যায়–প্রেম অমূল্য। কারণ প্রেম তো কোনো বস্তু নয়–মাল নয় যে দাম দিয়ে কেনা যাবে।
নিরঞ্জন স্বয়ং ক্রেতা হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের ধারণা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।
নিরঞ্জন লীলাকে বিয়ে করতে চায়। কোনোরকম সস্তা বা কুৎসিত মতলব তার নেই, সে শুদ্ধ পবিত্র শাস্ত্রীয় অথবা ততোধিক শুদ্ধ আইনসঙ্গতভাবে লীলাকে গরীয়সী মহীয়সী স্ত্রী হিসেবে পেতে চায়। এর মধ্যে কালোবাজারি কোনো চাল নেই।
সে নিজে কিছু বলেনি। খ্যাতনামা একজনকে ঘটক হিসেবে পাঠিয়েছে পশুপতির কাছে। লীলার কাছে প্রেম নিবেদন করাও সে দরকার মনে করেনি। কারণ সে ভালো করেই জানে যে সোজাসুজি লীলার কাছে কথা পাড়লে লীলা সোজাসুজি জবাব দেবে–না।
ধনঞ্জয় গিয়েছিল তার ভবিষ্যৎ সুদৃঢ় করার প্রত্যাশায়, নিরঞ্জন তাকে একটু অকারণ লজ্জা-মেশানো হাসি দিয়ে খাপছাড়া অভ্যর্থনা জানিয়ে সরলভাবে বলে, শুনলে তুমি ঠাট্টা করবে, কিন্তু বিয়েটিয়ে করে সংসারী হচ্ছি ভাই! তুমি চেন, পশুপতিবাবুর মেয়ে। সামনের মাসেই একটা শুভদিন দেখে যাতে হয় তার প্রস্তাব পাঠিয়েছি। নিরঞ্জন তাকে একটা সিগারেট দেয়। হাসিমুখেই আবার বলে, পশুপতিবাবু অনেকদিন ঘোরাফেরা করছেন–এ পর্যন্ত কিছু করা হয়নি। এবার কিছু করে দিতে হবে। তোমাকে কথা দিয়ে ফেলেছি–অন্য কেউ হলে এই কন্ট্রাক্টই পশুপতিবাবুকে দিয়ে দিতাম। কিন্তু তোমার কথা আলাদা–তোমাকে তো আর না। বলতে পারি না এখন!
কথাটা সহজেই বুঝতে পারে ধনঞ্জয়। অতি সরল স্পষ্ট মানে নিরঞ্জনের কথার। লীলাকে তার চাই, ধনঞ্জয় যদি ব্যাঘাত ঘটায় তবে বর্তমানের আশি হাজার এবং অদূর ভবিষ্যতে যা লক্ষাধিক টাকার কন্ট্রাক্ট দাঁড়াবে সেটা ফসকে যাবে ধনঞ্জয়ের হাত থেকে। শুধু তাই নয়, পশুপতিরও ভবিষ্যতে কোনোদিন কিছু বাগাবার আশা ভরসা থাকবে না নিরঞ্জনের মারফতে।
তারপরে কাজের কথায় আসে নিরঞ্জন। বলে, খুব সাবধানে হিসেব করে সব করবে! কোনো দিকে যেন কোনো ফাঁক না থাকে। এদিককার সব আমি সামলে নেব।
বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতোই ঠেকে ব্যাপারটা তাদের কাছে। পরস্পরের সঙ্গে হঠাৎ দেখা করতে পর্যন্ত দুজনেই তারা ভয় পায়। নিজের নিজের ঘরে একা বসে তলিয়ে বুঝবার চেষ্টা করে যে কিসে কী হল এবং এখন কী করার আছে!
নিরঞ্জনের প্রস্তাব নিয়ে যে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিটি ঘটকালি করতে গিয়েছিল তাকে। পশুপতি জানায় যে মেয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে দু-তিন দিনের মধ্যেই নিরঞ্জনের সঙ্গে দেখা করবে।
নিরঞ্জনের আপিস থেকে ধনঞ্জয় সোজা বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। পশুপতি ধনঞ্জয়কে টেলিফোনে ডেকে পাঠায়।
ধনঞ্জয় বলে, আমি সব শুনেছি। কাল সকালে আপনার ওখানে যাব।
লীলাকে ডেকে দেব?
থাক।
ধনঞ্জয় ও লীলা দুজনেই সারারাত জেগে কাটায়–মাইলখানেক তফাতে শহরের দুটি বাড়ির দুখানা ঘরে, যে ব্যবধান তারা যে কেউ একজন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে কয়েক মিনিটে ঘুচিয়ে দিতে পারে!
সকালে ধনঞ্জয় আসে পশুপতির বাড়ি।
পশুপতি বলে, লীলার সঙ্গেই কথা বলো। তোমরা ছেলেমানুষ নও, তোমরা যা ঠিক করবে আমি তাই মেনে নেব।
লীলার চোখ লাল। বোঝা যায় রাত্রে বেশ খানিকটা কেঁদেছে। ধনঞ্জয়ের শুকনো বিবর্ণ মুখ একনজরে দেখেই আবার সে কেঁদে ফেলে। চোখ মুছতে মুছতে বলে, বোসো।
ধনঞ্জয় বসে, ধীরে ধীরে বলে, কিছু ঠিক করেছ?
লীলা বলে, তুমি?
তারপর দুজনেই খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে।
প্রথমে লীলার কাছেই অসহ্য হয়ে ওঠে এই নীরবতা। বলে, নিরঞ্জন ছাড়বে না, সব ভেঙে দেবে। ধনঞ্জয় বলে, সে তো স্পষ্ট বলেই দিয়েছে।
আবার কবে তুমি এ রকম চান্স পাবে। কে জানে! একেবারে পাবে কি না তারও কিছু ঠিক নেই।
ধনঞ্জয় নীরবে সায় দেয়।
লীলা বলে, তাছাড়া এদিক ওদিক টাকাও ঢালতে হয়েছে অনেক। সব নষ্ট হবে।
ধনঞ্জয় বলে, তা হবে। এমনিতেও তোমাকে পাবার আশা একরকম ঘুচে যাবে।
লীলা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, তুমি যা ভেবেছ, আমিও তাই ভাবছি। কাল আমরা বিয়ে করতে চাইলে এ জগতে কারো সাধ্য আছে ঠেকায়? কিন্তু আমরা ছেলেমানুষ নই। বিয়ে নয় হল, তারপর? তোমার আমার দুজনেরই জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। কোনো লাভ নেই।
ধনঞ্জয় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে, সত্যি লাভ নেই।