১৩. সূর্যাস্ত দেখিবার শখ

ঝোঁকের মাথায় কাজ করার অভ্যাস শশীর কোনোদিন ছিল না। মনের হঠাৎ-জাগা ইচ্ছাগুলিকে চিরদিন সামলাইয়া চলিবার চেষ্টা করে। তবে এমন কতকগুলি অসাধারণ জোরালো হঠাৎ-জাগা ইচ্ছা মানুষের মধ্যে মাঝে মাঝে জাগিয়া ওঠে, যে, সেসব দমন করার ক্ষমতা কারো হয় না। সকালে উঠিয়া কিছুই সে যেন ভাবিল না, কোনো কথা বিবেচনা করিয়া দেখিল না, সোজা পরানের বাড়ি গিয়া রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়াইয়া বলিল, একবার তালবনে আসবে বউ?

কুসুম অবাক। তালবনে? কেন, তালবনে কেন এই সকালবেলা?

এসো। কটা কথা বলব তোমাকে।

কথা বলবেন? হাসব বা কাঁদব ভেবে পাই না ছোটোবাবু। জন্মবয়সে আজ প্রথম আমাকে যেচে কথাটা বলতে এলেন, তাও তালবনে ডেকে যান আমি আসছি।

তালবনের সেই ভূপতিত তালগাছটায় শশী বসিয়া রহিল, এমনি সকালবেলা একদিন তাকে ডাকিয়া আনিয়া কুসুম সেখানে বসিয়া মতির কথা শুনিয়াছিল। খানিক পরে আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা খেলাচ্ছলে মৃদু মৃদু শব্দে বাজাইতে বাজাইতে কুসুম আসিল। এত উৎফুল্ল কেন কুসুম আজ, কাল যে চিরতরে বিদায় গ্রহণ করিবে? মুখখানা একটু তাহার স্নান দেখাক, চোখে থাক গোপন রোদনের চিহ্ন? কথা শশী বলিতে পারিল না। নিজের মুখখানা স্নান করিয়া কুসুমের ভাব দেখিতে লাগিল।

হাসব?-কুসুম জিজ্ঞাসা করিল।

কেন, হাসবে কেন?

কুসুম হাসিয়া বলিল, আমার হাসি দেখলে আপনার মন নাকি জুড়িযে যায়? তাই শুধোচ্ছি।

 

শশী বলিল, তামাশা করার জন্যে তোমায় এখানে ডাকিনি বউ।

আহা, তা তো জানি না তামাশাই করলেন চিরকাল, তাই ডাকলে মনে হয় তামাশা করার জন্যেই বুঝি ডেকেছেন। বসি তবে বসে শুনি কীজন্য ডাকলেন!

শশী বলিল, একথা কী করে বললে বউ, চিরকাল তোমার সঙ্গে তামাশা করেছি?

তামাশা নয়? তবে ঠাট্টা বুঝি?

শশী একটু রাগ করিয়া বলিল, তোমার কী হয়েছে বুঝতে পারছি না বউ।

কুসুম তবু হালকা সুর ভারী করে না। বলিল, কী করে বুঝবেন? মেয়েমানুষের কত কী হয়, সব বোঝা যায় না। হলেই বা ডাক্তার! এ তো জ্বরজ্বালা নয়।

শশী জ্বালা বোধ করে। এ কী আশ্চর্য যে কুসুমকে সে বুঝিতে পারে না, মৃদু স্নেহসিঞ্চিত অবজ্ঞায় সাতবছর যার পাগলামিকে সে প্রশ্রয় দিয়াছিল? শশীর একটা দুর্বোধ্য কষ্ট হয়। যা ছিল শুধু জীবনসীমায় বহিঃপ্রাচীর, হঠাৎ তার মধ্যে একটা চোরা দরজা আবিস্কৃত হইয়াছে, ওপাশে কত বিস্তৃত, কত সম্ভাবনা, কত বিস্ময়। কেন চোখ ছলছল করিল না কুসুমের? একবার বাপের বাড়ি যাওয়ার নামে আছাড় খাইয়া তার কোমর ভাঙিয়াছিল, যদিবা শেষপর্যন্ত গেল, ফিরিয়া আসিল পনেরো দিনের মধ্যে। এখানে এমনভাবে হয়তো এই তাদের শেষ দেখা, এ জীবনে হয়তো আর এত কাছাকাছি তারা আসিবে না; আর আজ একটু কাঁদিল না কুসুম, গাঢ় সজল সুরে একটি আবেগের কথা বলিল না? কুসুমের মুখে ব্যথার আবির্ভাব দেখিতে শশীর দুচোখ আকুল হইয়া ওঠে, অস্ফুট কান্না শুনিবার জন্য সে হইয়া থাকে উৎকর্ণ। কে জানিত কুসুমের দৈনন্দিন কথা ও ব্যবহার মেশানো অসংখ্য সংকেত, অসংখ্য নিবেদন এত প্রিয় ছিল শশীর, এত সে ভালোবাসিত কুসুমের জীবনধারায় মৃদু, এলোমেলো, অফুরন্ত কাতরতা? চিরদিনের জন্য চলিয়া যাইবে, আর আজ এই তালবনে তার এত কাছে বসিয়া খেলার ছলে কুসুম শুধু বাজাইবে চাবি কী অন্যায় কুসুমের, কী সৃষ্টিছাড়া পাগলামি।

 

পা দিয়া ছোট একটি আগাছা নাড়িয়া দিতে ঝরঝর করিয়া শিশির ঝরিয়া পড়িল। শশীর মনে হইল কুসুমকে ধরিয়া এমনি বাকুনি দেয় যাতে তার চোখের আটকানো  জলের ফোঁটাগুলি এমনিভাবে ঝরিয়া পড়ে এবং দুচোখ মেলিয়া সে তা দেখিতে পায়।

কুসুম জিজ্ঞাসা করিল, কথা বলবেন বলে ডেকে এনে চুপচাপ কেন ছোটোবাবু?

শশী বলিল, শুনলাম তোমরা নাকি গাঁ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তাই শুধোতে ডাকলাম।

কুসুম অনায়াসে বলিল, পরশু যাব।

আমায় যে বলো নি কিছু?

কখন বলব? আপনি কি আসেন?

শশী রাগিয়া বলিল, নাই বা এলাম! জানো না কাজের ভিড়ে কত ব্যস্ত থাকি? মিথ্যা করে ভাঙা হাত দেখাতে বৃষ্টি মাথায় করে যেতে পারো, এতবড় একটা খবর দেবার জন্যে একবার যেতে পারলে না?

একথায় ক্রোধের কী অপূর্ব ভঙ্গিই কুসুম করিল দুহাতে মুখে দুপাশের আলগা চুলগুলি পিছনে ঠেলিয়া দিয়া এমন তীব্রভৃষ্টিতে শশীর দিকে চাহিল যে মনে হইল শশী যেন দুরন্ত অবাধ্য শিশু, এখুনি কুসুম তাকে একটা চড়ুচাপড় মারিয়া বসিবে। এমন তো ছিল না কুসুম! শশী কবে তাকে অপমান না করিয়াছে, কবে মান রাখিয়াছে তার অভিমানের, কবে এমন কথা বলিতে ছাড়িয়াছে যা শুনিলে গা জ্বলিয়া যায় না? কোনোদিন রাগ সে করে নাই, ভর্ৎসনার চোখে চাহে নাই। আজ এই সামান্য অপমানে সে একেবারে ফুঁসিয়া উঠিল বাঘিনীর মতো!

 

তবে কড়া কথা কিছু সে বলিল না, আত্মসম্বরণ করিল। তার রাগের ভঙ্গি দেখাইয়া শশী একেবারে নিভিয়া গিয়াছে দেখিয়া কে জানে কী আশ্চর্য কৌশলে, কথা বলার চিরন্তন রহস্যময় সুরটিও কুসুম ফিরাইয়া আনিল। বলিল, বাবা, কী ছেলেমানুষের পাল্লাতেই পড়েছি মিথ্যে করে ভাঙা হাত দেখাতে একবার ছেড়ে একশোবার যেতে পারি ঝড় বৃষ্টি ভূমিকম্প মাথায় করে, ওকথা বলবার জন্য যাব কেন?

শশী বলিল, পরানকে দিয়ে তো বলে পাঠাতে পারতে?

কুসুম বলিল, তাই বা কেন পাঠাব? যে খবর নেয় না তাকে খবর দেবার কী গরজ আমার? আমিই তো বারণ করলাম ওকে।

কাজের ভিড়ে আসতে পারিনি বলে আমি একেবারে পর হয়ে গেছি, না বউ?

পাগলাটে মানুষ আমি, তবু যাওয়ার দুদিন আগে আমাকে এখানে ডেকে আনা চাই, আজেবাজে কথা বলে কান ঝালাপালা করা চাই! দশ বছর খেলা করেও কি সাধ মেটেনি? আমরা মুখ্যু গেঁয়ো মেয়ে এ সব খেলার মর্ম বুঝি না, কষ্টে মরে যাই।

এ কথার কোনো প্রতিবাদ নাই বলিয়া শশীর মুখে কথা ফোটে না। জুতার ভিতর হইতে পা বাহির করিয়া পায়ে ঘাসের শিশির মাখিতে মাখিতে নতমুখে সে মূক হইয়া বসিয়া থাকে।

এদিকে কুসুমের চোখে এতক্ষণে  জল আসিয়া পড়িয়াছে। শশীর কাছে মএন্র আবেগকে এমন স্পষ্টভাবে চোখের জলে কুসুম কোনোদিন স্বীকার করে নাই। তবে সে বড়ো শক্ত মেয়ে, দুবার জোরে জোরে শ্বাস টানিয়া আবার আঁচলে চোখ মুছিয়াই আবেগ সে আয়ত্তে আনিয়া ফেলিল।

 

বলিল, এমন হবে ভাবিনি ছোটোবাবু। তাহলে কোনকালে গাঁ ছেড়ে চলে যেতাম।

কুসুম আর কিছুক্ষণ চোখের জল ফেলিলে যে শশী হঠাৎ খ্যাপার মতো বিনা বাক্যব্যয়ে তাকে দুহাতে জড়াইয়া ধরিত তাতে সন্দেহ ছিল না, কিন্তু কুসুমের অনুযোগগুলি তাকে দমাইয়া রাখিল। একথা সে ভুলিতে পারিল না যে এতকাল পরে ওভাবে কুসুমের সমস্ত নালিশের জবাব দেওয়া আর চলে না। মুখখানা শশীর একটু পাংশু দেখাইতেছিল। কী বলা যায় কুসুমকে, কী করা যায়! কে জানিত মোটে দুদিনের নোটিশে কুসুম তাকে এমন বিপদে ফেলিবে, তার গুছানো সময়ের মধ্যে এমন ওলটপালট আনিয়া দিবে কুসুমের কাছে বসিয়া থাকিলে, দুদিন পরে সে যে চিরদিনের জন্য চলিয়া যাইবে, এই চিন্তার কষ্ট তরঙ্গের মতো পলকে পলকে অবিরাম উথলিয়া উঠিয়া তাকে এমন উতলা করিয়া তুলিবে, এ ধারণা শশীর ছিল না। কাল কথাটা শুনিয়া অবধি শশীর মনে নানা বিচিত্র ভাবধারা উঠিতেছিল, আজ সকালে সে-সমস্ত যেন শুধু একটা কটু ক্লেশে পরিণত হইয়া গিয়াছে।

কুসুমের যে শরীরটা আজ অপার্থিব সুন্দর মনে হইতেছিল তার সমস্তটা শশী জড়াইয়া ধরিতে পারিল না, হঠাৎ করিল কি, খপ করিয়া কুসুমের একটা হাত ধরিয়া ফেলিল। কুসুম একটু অবাক হইয়া গেল। দুজনের মধ্যে ব্যবধান ছিল, তাতে টান পড়ার জন্যই বোধহয় কুসুম একটু সরিয়াও আসিল, কিন্তু যা কথা বলিল তা অপূর্ব, অচিন্তিত।

কতবার নিজে যেচে এসেছি, আজকে ডেকে এনে হাত ধরা-টরা কি উচিত ছোটোবাবু? রেগে-টেগে উঠতে পারি তো আমি? বড় বেয়াড়া রাগ আমার।

শুনিয়া শশীর আধো-পাংশু মুখখানা প্রথমে একেবারে শুকাইয়া গেল। কে জানিত কুসুমকে এত ভয়ও শশী করে? তবু কুসুমের হাতখানা সে ছাড়িল না। বলিল, রেগো, কথা শুনে রেগো। আমার সঙ্গে চলে যাবে বউ?

 

চলে যাব? কোথায়?

যেখানে হোক। যেখানে হোক চলে যাই চলো আজ রাত্রে।

কুসুম সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, না।

শশী ব্যাকুলভাবে কহিল, কেন? যাবে না কেন?

কুসুম শুধু বলিল, কেন যাব?

শশী বোকার মতো, শিশুর মতো বলিল, কেন যাবে? কেন যাবে মানে কী কুসুম?

আজ নাম ধরে কুসুম বললেন!—বলিয়া ছোট বালিকার মতো মাথা দুলাইয়া জ্বলজ্বলে চোখে শশীর অভিভূত ভাব লক্ষ করিতে করিতে কুসুম বলিল, কী করে যে শুধোলেন কেন যাব। আপনি বুঝি ভেবেছিলেন যেদিন আপনার সুবিধে হবে ডাকবেন, আমি অমনি সুড়সুড় করে আপনার সঙ্গে চলে যাব? কেউ তা যায়?

শশী অধীরভাবে বলিল, একদিন কিন্তু যেতে।

কুসুম স্বীকার করিয়া বলিল, তা যেতাম ছোটোবাবু, স্পষ্ট করে ডাকা দূরে থাক, ইশারা করে ডাকলে ছুটে যেতাম। চিরদিন কি এরকম যায়? মানুষ কি লোহার গড়া যে চিরকাল সে একরকম থাকবে, বদলাবে না? বলতে বসেছি যখন কড়া করেই বলি, আজ হাত ধরে টানলেও আমি যাব না।

 

তার হাত ছাড়িয়া দিয়া শশী বলিল, তোমার রাগ যে এমন ভয়ানক তা জানতাম না বউ। অনেক বড় বড় কথা তো বললে, একটা ছোট কথা কেন তুমি বুঝতে পারো না? নিজের মন কি মানুষ সবসময় বুঝতে পারে বউ? অনেকদিন অবহেলা করে কষ্ট দিয়েছি বলে আজ রাগ করে তার শোধ নিতে চলেছ, এমন তো হতে পারে আমি না-বুঝে। তোমায় কষ্ট দিয়েছি, তোমার পরে কতটা মায়া পড়েছে জানতে পারিনি? তুমি চলে যাবে শুনে এতদিনে আমার খেয়াল হয়েছে? তা ছাড়া তোমার কথাই ধরি, তুমি বললে মানুষ বদলায়-বেশ, আমি অ্যাদিন তোমার সঙ্গে খেলাই করেছি, আজ তো আমি বদলে যেতে পারি বউ?

কী ব্যাকুল, উৎসুক আবেদনের মতো শোচনীয় শশীর কথাগুলি। কে জানিত কুসুমকে তাহার এমন করিয়া একদিন বলিতে হইবে। শুনিতে বিস্ময়ের সীমা থাকে না কুসুমের শরীরটা যে ভালো নাই তার মুখ দেখিয়াই তা বোঝা যায়, হয়তো কুসুম মনে করে যে তার এই সকাতর দুর্বলতা সেইজন্যই। সে মৃদুস্বরে বলিল, এ কী বলছেন ছোটোবাবু? আমার জন্য আপনার মন কাঁদবে?

শশী সরলভাবে বলিল, ভয়ানক মন কাঁদবে বউ, জীবনে আমি কখনও তা হলে সুখী হতে পারব না।

কুসুম ব্যাকুলভাবে বলিল, তা কি কখনও হয়? আপনার কাছে আমি কত তুচ্ছ, আমার জন্য জীবনে কখনও সুখী হতে পারবেন না। দুদিন পরে মনেও পড়বে না আমাকে।

শশী বলিল, এতকাল ধরে জড়িয়ে বেঁধেছ আর দুদিনে তোমাকে ভুলে যাব, তাই ভেবে নিলে তুমি?

শেষপর্যন্ত কুসুম বলিল, আমার সাধ্যি কী ছোটোবাবু আপনাকে জড়িয়ে জড়িয়ে বাঁধব?

শশী ক্ষুব্ধ হইয়া বলিল, আজ ওসব বিনয় রাখো বে। আজেবাজে বকার ধৈর্য আমার নেই। আমার কী হবে না হবে সেকথাও না। স্পষ্ট করে আমায় শুধু তুমি বুঝিয়ে দাও চিরকাল আমার জন্যে ঘর ছাড়তে তুমি পাগল ছিলে, আজকে হঠাৎ বিরূপ হলে কেন?

 

এসব কথায় কলহ হয় ছোটোবাবু। যাবার আগে কলহ কি ভালো?

কলহ হবে না, বলো।

কুসুম স্নানমুখে বলিল, আপনাকে কী বলব ছোটোবাবু, আপনি এত বোঝেন! লাল টকটকে করে তাতানো লোহা ফেলে রাখলে তাও আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে যায়, যায় না? সাধ-আহ্লাদ আমার কিছু নেই, নিজের জন্যে কোনো সুখ চাই না। বাকি জীবনটা ভাত রেঁধে ঘরের লোকের সেবা করে কাটিয়ে দেব ভেবেছি—আর কোনো আশা নেই, ইচ্ছে নেই। সব ভোঁতা হয়ে গেছে ছোটোবাবু। লোকের মুখে মন ভেঙে যাবার কথা শুনতাম, অ্যাদ্দিনে বুঝতে পেরেছে সেটা কী। কাকে ডাকছেন ছোটোবাবু, কে যাবে আপনার সঙ্গে? কুসুম কি বেঁচে আছে? সে মরে গেছে।

কুসুম মরিয়া গিয়াছে। সেই চপল রহস্যময়ী, আধো-বালিকা আধো-রমণী, জীবনীশক্তিতে ভরপুর, অদম্য অধ্যবসায়ী কুসুম। শশী যে কেন আর কোনো কথা বলিল না তার কারণটা দুর্বোধ্য। বোধ হয় ভাবিবার অবসর পাইবার জন্য। কুসুম তো আজ ও কাল এখানে আছে। বলিবার কিছু আছে কি না সেটাই আগে ভাবিয়া দেখা দরকার।

মিনিটখানেক চুপচাপ দাঁড়াইয়া থাকিবার পর বাড়ির দিকে চলিতে আরম্ভ করিবার সময় কুসুম শুধু বলিল, আপনি দেবতার মতো ছোটোবাবু।

বাড়ি ফিরিয়া শশী বুঝিতে পারে কল্পনার এমন কতকগুলি স্তর আছে, বিশেষ কোনো উপলক্ষ ছাড়া যেখানে উঠিবার ক্ষমতা মানুষের নাই। এক-একটা ঘটনা যেন চাবির মতো মনের এক-একটা দুয়ার খুলিয়া দেয়, যে দুয়ার ছিল বলিয়াও মানুষ জানিত না। এত বড় বড় কল্পনা শশীর, এত বিরাট ও ব্যাপক সব মনোবাসনা, একদিনে সব যেন পৃথক অনাবশ্যক হইয়া গেল, শিশুর মনের বড় বড় ইচ্ছাগুলি যৌবনে যেমন পায়। রবার-বসানো চাকা-যুক্ত গদি-আটা ঠেলাগাড়িতে চাপার জন্য ছেলেবেলা কত কাঁদিয়াছিল শশী, কলিকাতায় মোটর হাঁকাইবার সাধ আজ তারি পর্যায়ে গিয়া পড়িয়াছে। গ্রাম ছাড়িয়া কোথায় যাইবে শশী? কী আছে গ্রামের বাইরে শশীর যা মনোহরণ করিতে পারবে? একটা প্রকাণ্ড বড় পৃথিবী, অসংখ্য অচেনা মানুষ। কী পাইবে শশী সেখানে?

 

কুসুমের কথাগুলির অন্তরালে যত অর্থ ছিল ক্রমে ক্রমে শশী তা পরিষ্কার বুঝিতে পারে। একদিন দুদিন নয়, অনেকগুলি সুদীর্ঘ বৎসর ব্যাপিয়া তার জন্য কুসুম পাগল হইয়া ছিল, তারপর ক্রমে ক্রমে তার সে উন্মাদ ভালোবাসা নির্জীব হইয়া আসিয়াছে। হয়তো মরিয়াই গিয়াছে! কে বলিতে পারে? আজ এ ঘটনা শশীর কাছে যত ভয়ানক মনে হোক এই পরিণতিই তো স্বাভাবিক। গাঁয়ের মেয়ে ঘরের বউ কুসুম, মনোবাসনা কতদূর অদম্য হইয়া ওঠায় দিনের-পর-দিন নৈবেদ্যের মতো নিজেকে শশীর কাছে সে নিবেদন করিয়া চলিয়ছিল এখন শশী তা বুঝিতে পারে, কুসুমের অমন ভয়ানক উপবাসী ভালোবাসা যে এতকাল সতেজে বাঁচিয়া ছিল, তাই তো কল্পনাতীতরূপে বিস্ময়কর। আপনা হইতেই যে প্রেম জাগিয়াছিল, আপনা হইতে স্বাভাবিক নিয়মে আবার তা লয় পাইয়াছে। শশীকে না দেখিয়া এখন কুসুমের দিন কাটিবে, শশীকে বাদ দিয়া কাটিবে জীবন।

কুসুমের পরিবর্তনে আশ্চর্য শশী তাই হয় না। ঘরে আগুন লাগিলে আগুন নেভে- বাহিরের, মনেরও। কুসুমের মনের আগুন কেন চিরদিন জুলিবে? নিজের ব্যাকুলতা শশীকে অবাক করিয়া রাখে। যখনি মনে হয় তার আর কিছুই করিবার নাই, জীবনে যতো বড়ো অসম্ভবকে সম্ভব করিতে পারুক কুসুমকে আর কোনোদিন সে ভালোবাসাইতে পারিবে না, কষ্ট শশী ছটফট করে। ফুটিয়া ঝরিয়া গিয়াছে, কুসুম মরিয়া গিয়াছে,–তারই চোখের সামনে তারই অন্যমনস্ক মনের প্রান্তে। কী ছেলেখেলায় সে মাতিয়াছিল যে এমন ব্যাপার ঘটিতে দিল!

ছেলেখেলাগুলি সবই বর্তমান আছে। হাসপাতালে গেল শশী, নাড়ি টিপিয়া হৃৎস্পন্দন শুনিয়া ওষুধ লিখিয়া দিল-ফোঁড়াও কাটিল একটা। সাতগাঁয়ে রোগীও দেখিতে যাইতে হইল। কতকাল এসব কর্তব্য শশী করিতেছে, একদিন কি কলের মতো কাজগুলি করা যায় না? অন্যমনে কুসুমের কথা ভাবিতে ভাবিতে নাড়ি টিপিতে কেহ তো তাহাকে বারণ করে নাই! এত রাগ কেন শশীর, মরণাপন্ন রোগীকে এমন ধমক দেওয়া কেন? কী আপসোস আজ শশীর মনে, কী আত্মধিক্কার কারো তো বুঝিবার নয়। ধরিতে গেলে একদিক দিয়া এ তো ভালোই হইয়াছে শশী? ঘরের বউ শুদ্ধ ও পবিত্রভাবে ঘরেই রহিয়া গিয়াছে, রক্ষা পাইয়াছে নীতি ও ধর্ম। সত্য এদিক দিয়া একটু ভালোলাগা উচিত ছিল। ভালোমদের অনেক দিনের পুরানো এসব সংস্কার তার আছে বইকী, তবু, একবারও শশীর মনে হইল না একদিন অনেক ভণিতা করিয়া কুসুমকে যে-কথাগুলি বুঝাইয়া বলিতে গিয়াছিল আজ প্রকারান্তরে তাই ঘটিয়াছে—শান্ত মনে বুঝিয়া শুনিয়া চারিদিক বিবেচনা করিয়া কুসুমকে সে যে আত্মসংযম অভ্যাস করিতে বলিয়াছিল, কিছু না-বুঝিয়া শুনিয়াই কুসুম এখন অনায়াসে তা পালন করিতে পারবে।

পরদিন সকালে কুসুমকে এ বাড়িতে দেখা গেল। মেয়েদের কাছে বিদায় লইয়া আসিয়াছে। আর কেহ হইলে হয়তো ভাবিয়া বসিত এ তার শশীকে দেখিতে আসার ছল, শশী তা ভাবিল না। নিজের পক্ষে সুবিধাজনক ভাবনাগুলিকে শশী চিরকাল ভয়ানক সন্দেহের সঙ্গে বিচার করে। তবু সে করিল কী, বাহিরে দাঁড়াইয়া থাকার বদলে নিজের ঘরে গিয়া সকলে কী ভাবিবে না ভাবিবে একেবারে অগ্রাহ্য করিয়া ডাকিল, পরানের বউ, একবার শোনো।

কুসুম ঘরে আসিয়া বলল, বিদায় নিতে এলাম ছোটোবাবু। দোষটোষ যা করেছি মনে রাখবেন নাকি?

শশীর লিল, রাখব না? দোষগুণ, ভালোমন্দ, তোমার সম্বন্ধে খুঁটিনাটি তুচ্ছ কথাটি পর্যন্ত কোনোদিন ভুলতে পারব না বউ।

কালের চেয়ে শশীর আজকের প্রেম-বিনোদন ঢের বেশি স্পষ্ট। যেমন বলিল তেমনভাবে শশী যদি কুসুমকে মনে রাখে তবে সত্যসত্যই কি গভীরভাবে কুসুমকে সে ভালোবাসে?

কুসুম তাই কাঁদো-কাঁদো হইয়া বলিল, এমন করে বললে আমার যে পায়া ভারী হয়ে যায় ছোটোবাবু?

শশী বলিল, সত্যিকথা আমি সোজা ভাষাতেই বলি বউ-স্পষ্ট করে। ইশারাফিশারায় বলা আমার আসে না।

যাওয়ার সময় বিপদ করলেন।–কুসুম বলিল।

নাই বা গেলে?—বলিল শশী।

কুসুমকে গাঁয়ে রাখিবার জন্য আজও চেষ্টা করিতেছে শশী, এ শশীকে যেন চেনা যায় না। এমন দীনভাব সে কোথায় পাইল, কোথায় শিখিল এমন কাঙালপনা? জানে, কুসুম থাকিবে না, থাকিলে ভালোবাসিবে না, তবু উৎসুকভাবে শশী জবাবের প্রতীক্ষা করে। মানুষ যে মরিয়া বাঁচে না কী তার প্রমাণ আছে? শীতকালের বর্ষায় এখনো কি মরা নদীতে বান ডাকে না? নিজেকে হয়তো কুসুম বুঝিতে পারে নাই, কাল তালবনে মিথ্যা বলিয়াছিল!

কুসুম ভয়ে ভয়ে বলিল, থেকে কী করব ছোটোবাবু? তাতে আপনারও কষ্ট, আমারও কষ্ট। এ বয়সে আর কি কষ্ট সইতে পারব? গলায় দড়ি-টড়ি দিয়ে বসব হয়তো।

শশী না পারুক, ইশারায় মনের কথা কুসুম বেশ বলিতে পারে, অনেকদিন শশীকে ওভাবে মনের কথা বলিয়া তার দক্ষতা জনিয়াছে। শশী বিবর্ণ হইয়া গেল। সভয়ে বলিল, না বউ না, ওসব কখনও কোরো না! ওসব নাটুকেপনা করতে নেই। গোড়ায় যদি বলতে, থাকার কথা মুখেও আনতাম না। এত যদি বিগড়ে থাকে মন, বাপের বাড়ি গিয়েই থাকো। বুঝেশুনেই তো কাজ করতে বলেছি তোমাকে গোড়া থেকে, চারদিক বিবেচনা করে।

কুসুম বলিল, তা না করলে অনেক আগেই গলায় দড়ি দিতাম ছোটোবাবু। যাব এবার?

এ অনুমতি চাওয়ার কোনো কারণই শশী সেদিন খুঁজিয়া পাইল না।

 

এত কাণ্ড করিয়া কুসুম বাড়ি গেল। এইরকম স্বভাব কুসুমের। জীবনটা নাটকীয় করিয়া তুলিবার দিকে চিরদিন তার বিশেষ পক্ষপাতিত্ব ছিল।

শুধু গ্রাম ছাড়িবার কল্পনা নয়, অনেক কল্পনাই শশীর নিস্তেজ হইয়া আসিয়াছে, তবে গ্রামে বসিয়া থাকিবারও আর কোনো কারণ সে খুঁজিয়া পায় না। হাসপাতালের কাজে বেশ শৃঙ্খলা আসিয়াছে, একজন ডাক্তার নিযুক্ত করিয়া এবার সে বিদায় গ্রহণ করিতে পারে। যাওয়ার কথা প্রকাশ করিলে ঘরে ও বাহিরে একটা হৈচৈ বধিয়া যাইবে, কৈফিয়ত দিতে দিতে, উপদেশ ও উপরোধ শুনিতে শুনিতে বাহির হইয়া যাইবে প্রাণ। এটা এড়ানো চলিবে না। সে তো কুসুম নয় যে, যেদিন খুশি তল্পিতল্পা গুছাইয়া চলিয়া যাইতে চাহিলে এতবড় গ্রামের মধ্যে শুধু ব্যস্ত হইবে একজন।

হাঙ্গামার ভয়টাই যেন শশীকে নিক্রিয় করিয়া রাখিল। মন তো ভালো থাকেই না, শরীরটাও খারাপ। উৎসাহ এবং জীবনীশক্তির রীতিমতো অভাব ঘটিয়াছে।

মাস দুই কাটিয়া গেল। সকালবেলা সূচনা হইয়া একদিন মাঝরাত্রে সেনদিদির অবশ্যম্ভাবী বিপদটি আসিয়া পড়িল।

সত্যই বিপদ। সেনদিদি বুঝি বাঁচে না।

অনেক বয়সে প্রথম সন্তান হওয়াটা হয়তো আকস্মিক সৌভাগ্য বলিয়া ধরা যাইতে পারে, কিন্তু সেটা বিপজ্জনকও বটে। গোপালের বোধহয় এ আশঙ্কা ছিল, গ্রাম ছাড়িয়া এসময় দু-একদিনের জন্যও সে কোথাও যাইত না, সর্বদা খোঁজখবর লইত। যামিনী কবিরাজের বৈঠকখানায় তার সর্বদা যাতায়াত,–যামিনি বাচিয়া থাকিতে শেষের দিকে কখনও যাইত না। সেনদিদির দাদা কৃপানাথ কবিরাজ বড় পোষ মানিয়াছে গোপালের কাছে। লোকটা চিকিৎসাশাস্ত্র পড়িয়াছে ভালো কিন্তু প্রয়োগ জানে না, পশারও নাই। চরক-সুশ্রুতের শ্লোক বলিবার ফাঁকে ফাঁকে সে গোপালের স্তব পাঠ করে কিনা কে জানে, গোপাল তাকে বিশেষ কৃপা করিয়া থাকে। তা না হইলে যামিনী কবিরাজের বাড়িঘরে সপরিবারে বাস করিবার সৌভাগ্য তার বেশিদিন স্থায়ী হইতে পারিত না। গোপাল সেনদিদিকে বলিত, এবার তাড়াও ওদের; সেনদিদি ওদের বলিত, এবার তোমরা এসো। একটা গুরুতর মামলার শুনানি উপলক্ষে গোপাল আজ বাজিতপুরে গিয়েছিল। কোর্টে কাজ থাকিলে সেদিন গোপাল গ্রামে ফেরে না, আজ ফিরিল। রাত্রি প্রায় দশটার সময়।

সেনদিদির খবরটা আসিল গোপাল যখন খাইতে বসিয়াছে,-শশীর সঙ্গে। খবরটা দিল কৃপানাথ স্বয়ং।

এই তো বিপদ দাদা। আপনাকে একবার যেতে হচ্ছে।

গোপাল শুল্কমুখে কাতরভাবে বলিল, আমি গিয়ে কী করব হে?

কৃপানাথ বলিল, একবার যেতে হচ্ছে। একটা বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে—

বুদ্ধি-পরামর্শ? বিপদে বুদ্ধি-পরামর্শ দিতে যাওয়াটা দোষের নয়, গোপাল তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করিয়া উঠিয়া গেল। ধীরস্থির থাকিবার চেষ্টা করেও গোপাল কিন্তু চাঞ্চল্য চাপিতে পারে না। বাড়ির মেয়েরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। মাথা হেঁট করিয়া শশী নীরবে খাইয়া যায়।

ও-বাড়িতে দিয়ে কৃপানাথকে গোপাল কী পরামর্শ দেয় সে-ই জানে, খাইয়া উঠিয়া শশী ঘরে গিয়া বসিতে-না-বসিতে সে আবার আসিয়া হাজির হয়। রলে, তোমাকে একবার যেতে হবে শশী।

শশী বলে, আমাকে অনুগ্রহ করে তুমি বলবেন না।

অ্যাঁ? বলিয়া কৃপানাথ একটু থামে। শীর্ণ মুখখানা তাহার একটু লম্বাটে হইয়া যায়। ভাবিয়া বলে, আমি আপনার পিতৃবন্ধু–

শশী বলে, আপনি যান মশায়, আমার ঘুম পেয়েছে।

কৃপানাথ আবার একটু থামে থতথত ভাবটা কাটিতে একটু সময় লাগে তার। তার সংস্কৃত শ্লোক বলার মতো গড়গড় করিয়া বিপদের কথা বলিয়া যায়, চোখদুটো তার ছলছল করে। শশী না গেলে সেনদিদি বাঁচিবে না, গেলেও বাঁচিবে কি-না ভগবান জানেন, তবু যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ কিনা তাই দয়া করিয়া আপনি একবার চলুন শশীবাবু।

গাঁয়ে আর ডাক্তার নাই, কৃপানাথ নিজে যদিও চিকিৎসক, এসব হাঙ্গামার ব্যাপারে সে বোঝে না। জ্বর-জ্বালা হয়, পাঁচন বড়ি দিয়া চোখের পলকে সারাইয়া দিবে, এ তো তা নয়। শশী ভিন্ন সেনদিদির এখন আর গতি নাই। শুনিতে শুনিতে শশীর মনে পড়ে সেনদিদির সেই বসন্ত হওয়ার ইতিহাস, অসময়ে সাতগাঁর একটি বসত্তরোগীর দেহের বীজাণু দু-মইল মাঠঘাট বাড়িঘর ডিঙাইয়া সেনদিদির দেহে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল, যামিনীর চেলা ছিল সাতগাঁর রোগীটির চিকিৎসক। সেদিন এ-বাড়িতে গোপাল আর ও-বাড়িতে যামিনী তাকে সেনদিদির চিকিৎসা করিতে দেয় নাই। কত যুক্তি তর্ক অপমান আস্ফালনের বাঁধা ঠেলিয়া সেনদিদিকে সে বাঁচাইয়াছিল—একরকম গায়ের জোরে। আজ আবার অন্য কারণে সেনদিদি মরিতে বসিয়াছে। আজ তার চিকিৎসা করিতে বাঁধা নাই, নিজে গোপাল ডাকিয়া পাঠাইয়াছে। কেন ডাকিয়াছে? পুত্র বলিয়া এভাবে তাকে ডাকিবার অধিকার কে দিয়াছে গোপালকে? সেনদিদি মরুক বাঁচুক শশী কি গ্রাহ্য করে। এমন কত রোগী শশীর নিজের হাতে মরিয়াছে—সেনদিদি তো আজ শশীর রোগীও নয়। আর সমস্ত কথা সে যদি ভুলিয়াও যায়, যদি শুধু মনে রাখে যে সে ডাক্তার, মরণাপন্ন রোগীর আত্মীয় তাকে ডাকিতে আসিয়াছে, তবু না-যাওয়ার অধিকার তার আছে। দেহ তার অসুস্থ দুর্বল, সমস্ত দিন খাটিয়া খাটিয়া সে শ্রান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে, এখন ডাক আসিলে সে ফিরাইতে পারে বইকী। তার কি বিশ্রামের দরকার নাই?

কৃপানাথ ক্ষুণ্ণমনে চলিয়া গেলে আলোটা কমাইয়া শশী খাটে বসিয়া একটা মোটা চুরুট ধরাইল। আজকাল বিড়ির বদলে সে চুরুট খায়।

কুন্দ আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এখন শোবেন শশীদাদা? মশারি টাঙিয়ে দেব?

শশী বলিল, দে।

মশারির কোণ বাঁধিতে বাঁধিতে বুন্দ বলিল, সেনদিদিকে একবার দেখতে যাবে না শশী দাদা?

শশী রাগিয়া আগুন হইয়া বলিল, তুই আমার সঙ্গে ইয়ার্কি দিচ্ছিস নাকি কুন্দ?

কুন্দ থতথত খাইয়া গেল। তারপর কাঁদিয়া বলিল, দুটি খেতে পরতে গিচ্ছেন বলে আমি কথা কইলেই আপনি রেগে যান। কী করেছি আপনার আমি? এর চেয়ে আমায় তাড়িয়ে দিন শশীদাদা, আমি যেখানে হোক চলে যাই।

শশী নরম হইয়া বলিল, আজেবাজে কথা বলিস তাই তো রাগ হয়।

কুন্দও কান্না সহজে থামে না! সে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, আজেবাজে কথা কখন বললাম, কখন ইয়কি দিলাম? একবার চিকিৎসা করে ওঁকে বাঁচিয়েছিলেন, তাইতো বললাম দেখতে যাবেন কিনা। তাও দোষের হয়ে গেল?

শশী আরও নরম হইয়া বলিল, শরীরটা ভালো নেই কুন্দ, গা-হাত পা ব্যথা করছে, কাঁদিস না। হাতের কাজটা চটপট শেষ করে দিকি, শুয়ে পড়ি।

রাত প্রায় বারোটার সময় শশীর দরজা ঠেলিয়া গোপাল আস্তে আস্তে ডাকিল, শশী? শশী ঘুমোলি?

অসুস্থ শরীরের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা এতক্ষণে শশীর ঘুমে পরিণত হইতেছে, জাগিয়া সাড়া দিতে গোপাল দরজা খুলিতে বলিল। শশী উঠিয়া দরজা খুলিয়া দিল। গোপালের হাতে আলো ছিল, মেঝেতে সেটা নামাইয়া দিয়া সে বসিল খাটে। গোপাল স্তব্ধ, বিষন্ন, গম্ভীর; মনে হয় কথা সে কিছুই বলিবে না, নির্বাক আবেদনের ভঙ্গিতে এমনিভাবে মধ্যরাত্রে বসিয়া থাকিবে ছেলের ঘরের সামনে!

শশীই শেষে বিরক্ত হইয়া বলিল, আমার ঘুম পাচ্ছে।

গোপাল বলিল, ঘুম পাচ্ছে? তা পাবে বইকী, রাত কি কম হল! শরীরটাও তো তোমার ভালো নেই। একটা মানুষ মরে যাচ্ছে, তাই, নইলে তোমায় ডাকতাম না শশী।

শশী চুপ করিয়া রহিল। গোপাল ব্যগ্রভাবে বলিল, যাবি না একবার? শুধু তো মরবে না শশী, কী যন্ত্রণাই যে পাচ্ছে।

শশী বলিল, বাজিতপুর থেকে ওরা ডাক্তার আনাল না কেন। বিকেলে লোক পাঠালে এতক্ষণে এসে পৌঁছত!

গোপাল বলিল, সে বুদ্ধি কারো হয়নি। তুই গাঁয়ে থাকতে বাজিতপুরে ডাক্তার আনতে লোক পাঠাবেই বা কেন? তোর চেয়ে তারা তো বেশি জানেশোনে না। ডাকলে তুই যে যাবি না, ওরা তা ভাবতেও পারেনি শশী। কৃপানাথ এখন আমার হাতে-পায়ে ধরে কাঁদাকাটা করছে বাবা। তুই অপমান করে তাড়িয়ে দিলি, তাই তোর কাছে আসতে আর সাহস পাচ্ছে না।

শশীর ভয়ানক কষ্ট হইতেছিল, সে মৃদুস্বরে বলিল, মান-অপমান তো আমারও আছে বাবা।

গোপাল বলিল, না, না, তোকে অপমান করেনি শশী। না-বুঝে যদি একটা কথা বলে থাকে, কথা গোপাল শেষ করে না। তারপর দুজনেই চুপ করিয়া থাকে। উশখুশ করে গোপাল, করুণ চোখে সে তাকায় শশীর দিকে, মেরজাই-এর ফিতাটা টান দিয়া খুলিয়া বুকটা উদলা করিয়া দেয়, খাইয়া উঠিয়া পান মুখে দিবার সময় পায় নাই, তবু হয়তো অভ্যাসে, হয়তো মানসিক চাঞ্চল্যে, মুখের শূণ্যতাটা পানের মতো বারকয়েক চিবাইয়া দেয়। বড় অদ্ভুত রকমের শ্রীহীন দেখায় গোপালকে।

গোপাল যে নিজেই তাহাকে অনুরোধ করিতে আসিতে পারবে শশী এটা ভাবিতে পারে নাই। এতবেশি সেনদিদির জীবনের মূল্য গোপালের কাছে? একদিন ওর চিকিৎসা করিতে কেন তবে সে তাকে বাঁধা দিয়াছিল? গভীর দুঃখ ও লজ্জায় শশীর মন ভরিয়া গিয়াছিল, তবু সে মনে-মনে আশ্চর্য হইয়া গেল। বসন্তু যখন রূপ মুছিয়া লইয়া গেল সেনদিদির তখন মমতা আসিল গোপালের, এমন গভীর অবুঝ স্নেহ।

তারপর শশী বলিল, যান, শোবেন যান আপনি। আমি যাচ্ছি ও-বাড়ি জামাটা গায়ে দিয়ে।

গোপাল নিরুত্তরে উঠিয়া গেল। মুখ দিয়া আর তাহার কথা বাহির করার ক্ষমতা ছিল না। শশী তাহাকে অনেক কষ্ট দিয়াছে, আজ যে কষ্ট দিল তার তুলনা হয় না। কৃপানাথ যখন ডাকিতে আসিয়াছিল তখন যদি শশী সেনদিদিকে দেখিতে যাইত, এ লজ্জাটা তবে গোপালের থাকিতে পারিত নেপথ্যে।

এভাবে যখন তাহাকে যাইতেই হইল, সেনদিদিকে বাঁচানোর চেষ্টাটা শশী বিশেষ সমারোহের সঙ্গেই করিয়া দেখিল। রাতদুপুরে এই বিপদগ্রস্ত বাড়িতে সে আরও একটা অতিরিক্ত বিপর্যয় আনিয়া ফেলিল হুকুম দিয়া ধমক দিয়া সকলকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল। অনেক  জল গরম হইল, লোক পাঠাইয়া হাসপাতাল হইতে ওষুধ যন্ত্রপাতি ও কম্পাউন্ডারকে আনানো হইল, দেখিয়া কে বলিবে কিছুক্ষণ আগেও উদাসীন শশী সেনদিদিকে মরিতে দিতে প্রস্তুত ছিল। আবার তেমন জিদ শশীর আসিয়াছে যার জোরে সেনদিদিকে আগে একবার সে বাঁচাইয়াছিল। সেদিন সে লড়িয়াছিল বাহিরের বাধার সঙ্গে, আজ কি শশীকে লড়িতে হইল অন্তরের বাঁধার সঙ্গে? মুমুর্ষ সেনদিদিকে দেখিয়াও কি শশীর মনে বিতৃষ্ণ মিলাইয়া গেল না? সব তো তারই হাতে, এ দুজনের মরণ বাঁচানো। কী না করিতে পারে শশী? শুধু সেনদিদির নয়, সেনদিদির নবাগত চিহ্নের চিহ্নকেও তো সে চিরদিনের জন্য পৃথিবী হইতে মুছিয়া দিতে পারে। কারো প্রশ্ন করাও চলিবে না কেন এমন হইল। শশী কি শুধু মানুষ বাঁচাইতে শিখিয়াছে, মারিতে শেখে নাই? অতি সহজে, অন্যমনস্ক অবস্থায় ভুল করার মতো করিয়াও, সে তা পারে। বাকি জীবনটা তাতে খুব কি আপসোস করিতে হইবে শশীকে?

শেষ রাত্রে একটি ছেলে হইল সেনদিদির, ভোরবেলা সেনদিদি মরিয়া গেল। এত কম জীবনীশক্তি ছিল সেনদিদির, এত দুর্বল হইয়া গিয়াছিল তার হৃদপিণ্ড, যে, প্রথমে তাকে পরীক্ষা করিয়া শশীর বিশ্বাস হইতে চাহে নাই, সেনদিদিকে দেখিয়া কখনও মনে হয় নাই তার দেহষন্ত্রের আসল ইঞ্জিনটা এমন হইয়া গিয়াছে। তবু, শশীও ভাবিতে পারে নাই এ যাত্রা সে রক্ষা পাইবে না। ডাক্তার মানুষ সে, সেও যেন ভালো করিয়া বুঝিতে পারিল না অজ্ঞান অবস্থা পার হইয়া সেনদিদির যখন শান্ত হইয়া ঘুমাইতে আরম্ভ করা উচিত ছিল হঠাৎ হাত-পা কেন ঠাণ্ডা হইয়া আসিল।

শশী জানে এরকম হয়, মানুষের দেহের মধ্যে আজও এমন কিছু ঘটিয়া চলে এ যুগের ধম্বন্তরিরও যা থাকে জ্ঞানবুদ্ধির আগোচর। এ তো মানুষের বানানো কল নয়। তবু শশীর রাতজাগা চোখের আরক্ত ভাব যেন বাড়িয়া গেল, অবসাদ যেন হইয়া উঠিল অসহ্য। আর কিছু করিবার ছিল না, বাড়ি গিয়া স্নান করিয়া শশী কড়া এককাপ চা খাইল, তারপর শুইয়া পড়িল। আসিবার সময়ও বাহিরে গোপালকে সে দেখিয়া আসিয়াছে।

চেনা ও জানা মানুষগুলির মধ্যে দু-চারজনকে শশী যেমন মরিতে দেখিয়াছে, তেমনি তাদের ঘরে দু-চারজনকে জন্ম লইতেও দেখিয়াছে। দু-চারজন মরিবে দু-চারজন জন্ম লইবে এই তো পৃথিবীর নিয়ম। তবু এসব মরণ, মরণেঅভ্যস্ত শশী ডাক্তারকে বড় বিচলিত করে। যারা মরে তারা চেনা, স্নেহে ও বিদ্বেষে দীর্ঘকালব্যাপী সম্পর্ক তাদের সঙ্গে, যারা জনায় তারা তো অপরিচিত। এই কথা ভাবে শশী ; সেনদিদি কি বাঁচিত, সে যদি অন্যভাবে চেষ্টা করিত, যদি অন্য ওষুধ দিত? শেষের দিকে সে যে ব্যস্তভাবে গোটা দুই ইনজেকশন দিয়াছিল রোগিণীর পক্ষে তা কী অতিরিক্ত জোরালো হইয়াছিল? হইয়া থাকিলেও তাহার দোষ কী? অনেক বিবেচনা করিয়া তবে সে ইনজেকশন দুটো দিয়াছিল, তা ছাড়া আর কিছুই তখন করিবার ছিল না। নিজের জ্ঞানবুদ্ধিতে যা ভালো বুঝিয়াছে তাই সে করিয়াছে, তার বেশি আর সে কী করিতে পারে? আজ পর্যন্ত সে যে অনেকগুলি প্রাণ রক্ষা করিয়াছে সেটাও তো ধরিতে হইবে?

গোপাল একেবারে মুহ্যমান হইয়া গেল। এমন পরিবর্তন আসিল গোপালের যে সকলের সেটা নজরে পড়িতেছে বুঝিয়া শশীর লজ্জা করিতে লাগিল। গোপাল চিরকাল ভোজন-বিলাসী, এখন তার আহারে রুচি নাই; অমন চড়া মেজাজ, কিন্তু মুখ দিয়া আর কড়া কথা বাহির হয় না। গম্ভীর বিষণ্ণমুখে বাহিরের ঘরে ফরাশে বসিয়া তামাক টানে আর আবশ্যক অনাবশ্যক নথিপত্র ঘাঁটে, যেগুলি গোপালের কাছে এতকাল নাটক নভেলের মতো প্রিয় ছিল। মন হয়তো বসে না গোপালের, তবু এই অভ্যস্ত কাজের মধ্যে ডুবিয়া থাকিয়া সে সময় কাটানোর চেষ্টা করে। শশী আশ্চর্য হইয়া যায়। এসব তার কাছে একান্ত খাপছাড়া লাগে। অপ্রত্যাশিত যত কিছু ঘটিয়াছে শশীর জীবনে, তার মধ্যে গোপালের চরিত্রের এই বেমানান দিকটা সবচেয়ে বিস্ময়কর মনে হয়।

শশীর সঙ্গে কথাবার্তা গোপালের খুব কমই হয়। দুজনের দুটি জগৎ যেন এতদিনে একেবারে পৃথক হইয়া গিয়াছে। একদিন আচমকা গোপাল জিজ্ঞাসা করিল, তোমার সেনদিদি কিসে মরল শশী?

হার্ট খারাপ ছিল।

গোড়ায় বুঝি ধরতে পারো নি?

গোড়াতেই ধরেছিলাম।

তবে মরল যে।

এ প্রশ্নে শশী হঠাৎ রাগিয়া গেল। বলিল, গোড়ায় রোগ ধরতে পারলেও মানুষ মরে।

গোপাল বলিল, ইনজেকশন দুটো আগে দাওনি বলে হয়তো—

এটুকু বলিয়া উৎসুকভাবে গোপাল খানিকক্ষণ শশীর মন্তব্যের প্রতীক্ষা করিয়া রহিল। কী সত্য সে নির্ণয় করিতে চায় কে জানে—শশী একেবারে স্তম্ভিত হইয়া যায়। খুঁটিয়া খুঁটিয়া তার চিকিৎসার আগাগোড়াই হয়তো গোপাল জানিয়া লইয়াছে। কী ভাবিয়াছে গোপাল? চিকিৎসক-পুত্রের সম্বন্ধে কী ভাবনা তার মনে আসিয়াছে? মুখখানা লাল হইয়া যায় শশীর। কিছু বলিতে ভরসা পায় না।

কৃপানাথ বলছিল সময়মতো দু-একদানা মৃগনাভি দিলে—

শশী এবার নীরবে উঠিয়া চলিয়া গেল। রাগও হয়, মমতাও বোধ করে শশী। বিষয়ী, সংসারী পৌঢ়বয়সী মানুষ, তার এ কী ছেলেমানুষি। কুন্দ জিজ্ঞাসা করে, মামার কী হয়েছে, শশীদাদা? একটু মেহব্যাকুল সুরেই জিজ্ঞাসা করে। কুন্দর ছেলেটির বড় কঠিন অসুখ হইয়াছিল। অনেক চেষ্টায় শশী তাকে ভালো করিয়া তুলিয়াছে। পাকা দালানে একখানা ঘরও দেওয়া হইয়াছে কুন্দকে, আর দেওয়া হইয়াছে সংসার-পরিচালনার কিছু কিছু দায়িত্ব। মুখরা কুন্দ একেবারে বদলাইয়া গিয়াছে। কত সামান্য কামনা থাকে এক-একটি স্ত্রীলোকের, যার অভাবে স্বভাবটি হইয়া ওঠে হিংস্র খিটখিটে! শশীরও আজকাল মনে হয় ; না, কুন্দর প্রকৃতি তেমন মন্দ নয়, মোটামুটি ভালোই মেয়েটা। নিজের কাজের চাপে আজকাল আর বেশি নজর দিবার সময় পায় না, কুন্দ যে সিন্ধুকে বেশ যত্ন-টত্ব করে তাতে শশী আরও খুশি হয়।

কুন্দর প্রশ্নের জবাবে সে বলে, আমি জানি না কুন্দ।

কুন্দ বলে, আপনি বিয়ে টিয়ে করবেন না, কাল আমার কাছে বড় দুঃখ করছিলেন।

শশী বলে, বাবা দুঃখ করছিলেন, না তুই বাবার কাছে দুঃখ করছিলি?

কুন্দ একটু হাসিয়া বলে, আমরা দুজনেই করছিলাম।

শশী অবাক হইয়া তাকায় কুন্দর দিকে। এমন খাপসই আলাপ কুন্দ শিখিল কোথায়? হঠাৎ শশীর মনে হয় কুন্দ যেন বড় সুখী, ওর জীবনটা যেন আনন্দে পরিপূর্ণ।একটু ভাবপ্রবণ কুন্দ, একটু ঈৰ্ষাপ্রবণও বটে, শাড়ি গহনার লোভটাও বেশ একটু প্রবল, স্বামী তার গোপালের মুহুরিদের সঙ্গে মিশ খাইয়া গিয়াছে, তবু কুন্দ এত সুখী যে শখ করিয়া দুটো-একটা কৃত্রিম দুঃখ বানাইয়া সে উপভোগ করে, তার অভাব অভিযোগগুলিও তাই। কুন্দর অস্তিত্ব এতকাল শশীর কাছে ছিল জড়বস্তুর মতো নিরর্থক, আজ ওর অর্থহীন জীবনে এমন সুখের সমাবেশ দেখিয়া সে যেন খানিকটা ভড়কাইয়া গেল। কী যেন করিয়া দিয়া গিয়াছে শশীকে কুসুম। সামনে আসিলেই মানুষের চোখেমুখে ব্যাকুল চোখে কী যেন শশী খোজে। মুখে হাস্যচ্ছটা দেখিলে, চোখে আনন্দের ছাপ দেখিলে শশীর মন জুড়াইয়া যায়! সজল চোখে ক্লিষ্ট কাতরমুখে যে দাঁড়ায় শশীর সামনে তাকে শশীর মারিতে ইচ্ছে হয়। হঠাৎ কুন্দকে বড় ভালো লাগে শশীর। সস্নহে বলে, তোর কী চাই বল তো কুন্দ? খুব ভালো একখানা কাপড় নিবি? বেনারসী?

কুন্দ অবাক। বলে, হঠাৎ কাপড় কেন দাদা?

শশী গম্ভীরমুখে বলে, দেব, তোকে একখানা কাপড় দেব। এমনি দেব কুন্দ, মিছিমিছি।

মিছিমিছ কুন্দকে শশী কাপড় কিনিয়া দেয়। এদিকে আবির্ভাব ঘটে গোপালের গুরুদেবের। ভোলা ব্রহ্মচারী নামে তার খ্যাতি। সুপুষ্ট লোমশ দেহ, মাথা গোঁফদাড়ি ভ্র সব কামানো, হাতে কুচকুচে কালো একটি দণ্ড। গায়ে গেরুয়া, পায়ে গেরুয়া-রঙ-করা রাবার-সোলের ক্যাম্বিশ জুতা। বছর পাঁচেক একে গোপাল একরকম ভুলিয়াই ছিল, হঠাৎ এমন ব্যাকুলভাবে স্মরণ করিয়াছে যে ভগবানকে করিলে হয়তো তিনিও দেখা দিতেন। সসম্মানে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করিল, স্বহস্তে পা ধোয়াইয়া দিল। অন্দরের একখানা ঘর আগেই ধুইয়া মুছিয়া পরিষ্কার করিয়া রাখা হইয়াছিল, সেখানে ভোলা ব্রহ্মচারীকে থাকিতে দেওয়া হইল। ব্রহ্মচারীকে শশী ভক্তি করিত, এসময় হঠাৎ তাহার আগমনে বিশেষ খুশি না হইলেও শ্রদ্ধার সঙ্গে একটা প্রণাম করিল।

ব্ৰহ্মচারী দিন সাতেক রহিয়া গেল। এই সাতদিন একমুহুর্তের জন্যও গোপাল তাহার সঙ্গ ছাড়িল না। কত প্রশ্ন গোপালের, কত ব্যাকুল নিবেদন। গোপালের অবহেলায় বাজিতপুরের কোর্টে একটা মামলা ফাঁসিয়া গেল। তা যাক, মনে বৈরাগ্য আসিয়াছে, ওসব মামলা-মোকদ্দমা বিষয়কর্ম তার কাছে এখন তুচ্ছ। শুধু সেনদিদির জন্য তো নয়, আজ কতকাল হইল গোপালের মনে ভাবনা ঢুকিয়াছে, কিসের জন্য এসব। কার জন্য সে এতকষ্টে অর্থসম্পদ সংগ্ৰহ করিতেছে। একটা মেয়ে আছে সিন্ধু, দুদিন পরে ওর বিবাহ দিলে পরের ঘরে চলিয়া যাইবে, তখন কে থাকিবে গোপালের? শশী? শশীর কাছে কোনো আশাভরসাই সে রাখে না। বাপকে যে ছেলে ঘৃণা করে, তার কাছে কী প্রত্যাশা থাকে বাপের? ধরিতে গেলে সেই তো মনটা ভাঙিয়া গোপালের।

এ বড় আশ্চর্য কথা যে কুসুমের মতো গোপালের মনটাও শশীই ভাঙিয়া দিয়াছে। এ দুজনের মনের মতো হইতে না-পারার অপরাধটা শশীর এতবড় ভাঙা মনটা লইয়া কুসুম সরিয়া গিয়াছে। গোপাল আজও হাল ছাড়ে নাই। ব্রহ্মচারীর কাছে মনোবেদনা ব্যক্ত করিয়া সে তফাতে যায়, ব্রহ্মচারী ডাকেন শশীকে।

বাবা শশী, তুমি বিদ্বান বুদ্ধিমান, তোমাকে বলাই বাহুল্য যে খেয়ালের চেয়ে কর্তব্য অনেক বড়।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

বাপকে ভক্তিশ্রদ্ধা করার চেয়ে বড় কর্তব্য ছেলের আর কী আছে?

ঠিক এমনিভাবেই বলেন ব্রহ্মচারী, এমনি ভূমিকাবিহীন কঠোর ভাষায় কথাটা তাই বড় জোরালো হয়। শশী আহত হইয়া বলে, বাপের প্রতি ওটাই ছেলের প্রথম কর্তব্য বইকী। ছেলের মনের ওটা স্বাভাবিক ধর্ম বাবা, যুক্তিতর্কে বোঝানোর জিনিস নয়। বাপের স্বভাব মন্দ হলে ছেলে হয়তো বড় হয়ে তাকে সমালোচনা করে কিন্তু যেমন বাপই হোক ছেলের মনের অন্ধভক্তিটা কিছুতেই যাবার নয়।

কম নয় শশী, গুরুকে সে গুরুর মতো বোঝায়। সাত-আট বছর আগে ভোলা ব্রহ্মচারীর কাছে গোপাল তাহার দীক্ষা দিয়াছিল, ওঁ স্থানে নমো বলিয়া গুরুর মন্ত্র কিছুদিন শশী জপও করিয়াছে, তারপর কত পরিবর্তনই হইয়াছে শশীর!

সংক্ষেপে পরিচ্ছন্নভাবে তারপর অনেক জ্ঞানগর্ভ কথাই ব্রহ্মচারী বলেন, শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনিয়া শশীও জ্ঞানগর্ভ জবাব দেয়। মনে মনে সে টের পায় যে গুরুর চেয়ে জ্ঞানটা তার অনেক বেশি বাড়িয়া গিয়াছে, কিন্তু এটা সে প্রকাশ পাইতে দেয় না। শশীকে ব্রহ্মচারীর বড় ভালো লাগে। ছেলের সম্বন্ধে যেসব অভিযোগ গোপাল করিয়াছিল সমস্ত ভুলিয়া গিয়া অনেককালের সঞ্চিত বাধাধরা উপদেশগুলি নেপথ্যে রাখিয়া নানা বিষয়ে শশীর সঙ্গে আলাপ করেন। ক্রমে ক্রমে মনে হয় অনেকগুলি বছর আগে তাদের মধ্যে যে গুরুশিষ্যের সম্পর্কটি স্থাপিত হইয়াছিল, আজ তাহা বাতিল হইয়া গিয়াছে ধর্মের কথা নয়, ইহকালপরকাল পাপ-পুণ্য সম্বন্ধে প্রশ্নোত্তর নয়, এবার তাদের মুখোমুখি বসিয়া শুধু গল্প করা, অসমবয়সী দুটি বন্ধুর মতো। দুটি দিন এখানে বাস করিতে-নাকরিতে শশীর কাছে একটা মুখোশ যেন ভোলা ব্রহ্মচারীর খসিয়া গেল, ভিতরের আসল মানুষটির সঙ্গে শিষ্যের তিনি পরিচয় ঘটিতে দিলেন। আপনভোলা সদাশিব মানুষ, অনেকটা যাদবের মতো ঘটনাচক্রে তিনি ব্রহ্মচারী, সাধ করিয়া নয়— তারপর অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। ক্রমে ক্রমে জীবনের দু-একটি ঘটনা ও সম্ভাবনার কাহিনী শশীকে তিনি শোনান। প্রথম যৌবনে প্রথম সন্ন্যাসী-জীবনের কথা, ঘরে যা মেলে নাই তারই অন্বেষণে দেশে দেশে যাযাবর বৃত্তি। অনিশ্চিতের সন্ধানে বাহির হওয়ার এমনি সব কাহিনী চিরদিন শশীকে ব্যাকুল করে। তারও অনেক দিনের বাহির হওয়ার সাধ।

গোপালের অনুরোধে শশীর মনটি ঘরের দিকে টানিবার চেষ্টা করিতে গিয়া তার ঘর ছাড়ার প্রবৃত্তিকেই ব্রহ্মচারী উস্কাইয়া দিয়া গেলেন।

দিন সাতেক গুরুসঙ্গ করিয়া গোপাল যেন একটু গা ঝাড়া দিয়া উঠিল। নিজের সঙ্গে কিছু সে একটা রফা করিয়া ফেলিয়া থাকিবে, কারণ দেখা গেল কর্তব্য সম্পাদন ও শশীর প্রতি ব্যবহার তার সহজ্ঞ ও স্বাভাবিক হইয়া আসিয়াছে।

বলে, হাসপাতালে রোগীপত্র কেমন হচ্ছে শশী?

শশী বলে, বাড়ছে দু-একটি করে।

গোপাল আপসোস করিয়া বলে, বেগার খেটেই তুমি মরলে। মাইনে হিসেবে কিছু কিছু নাও না কেন? পরিশ্রমের দাম তো আছে তোমার, একটা লোক রাখলে তাকে তো দিতে হত?

শশী বলে, হাসপাতালের টাকা কোথায় যে নেব বাবা? সামান্য টাকার হাসপাতাল, আমিও যদি নিজের পাওনা গণ্ডা বুঝে নিতে থাকি, হাসপাতাল চলবে কিসে?

তা না নিক শশী মাহিনা বাদে কিছু এখন সেটা আর আসল কথা নয় গোপালের কাছে, ছেলের সঙ্গে একটু সে আলাপ করিল মাত্র। এমনি নারীসুলভ একধরনের ছলনায়ময় ব্যবহার গোপালের আছে, শশীকে মাঝে মাঝে যা আশ্চর্য ও অভিভূত করিয়া দেয়। ভোলা ব্রহ্মচারীকে শশী কথার কথা বলে নাই, গোপালের প্রতি একটা অন্ধ ভয়মেশানো ভক্তি আজও তার মধ্যে অক্ষয় হইয়া আছে-হয়তো চিরদিনই থাকিবে। গোড়ার দিকে অনেকগুলি বছর ধরিয়া তার মনের সমস্ত গাথুনি যে গাথিয়াছিল গোপাল, সেগুলি ভাঙিতে পরিবে কে?

কায়েতপাড়ার পথ দিয়া চলিবার সময় এক-এক দিন শশী যামিনী কবিরাজের বাড়িতে শিশুর ক্ৰন্দন শুনিতে পায়। কচি গলার কান্না। খুবই যেন কচি মনে হয় গলাটা শশীর। বিপিনের কি এক ছোট শিশু আছে? অনেকদূর চলিয়া গিয়াও অনেকক্ষণ অবধি কান্নার সুরটি শশীর কানে বাজিতে থাকে। নিজের এই ভাবপ্রবণতা ভালো লাগে না। যে শিশু জনিয়াছে সে মাঝে মাঝে কাঁদিবে বৈ কি! তাতে এতখানি বিচলিত হওয়ার কী আছে? নিজের বাড়িতেও এমন কান্না সে কত শোনে।

সেনদিদির মারা যাওয়ার মাস তিনেক পরে একদিন অনেক বেলায় শশী ফিরিয়াছে, এমনি কান্নায় রত একটি শিশুকে বুকে করিয়া কুন্দ শশীর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, সেনদিদির ছেলে শশীদাদা।

রোদের তেজে অস্নাত অভুক্ত শশীর মুখখানা শুকনো দেখাইতেছিল, আরও একটু পাংশু হইয়া সে বলিল, কার ছেলে বললি কুন্দ, সেনদিদির?

কুন্দ বলিল, হ্যাঁ। পেট থেকে পড়েই তো মাকে খেয়েছে রাক্ষস, কিপানাথ কবরেজের শালীর কচি ছেলে আছে, তার মাই খেত। সে আজ চলে গেল কিনা, মামা তাই আমাকে এনে দিলেন। খুকির সঙ্গে আমার দুধ খাবে। মার মতো শেষে আমাকেও না খায়!

একগাল হাসিল কুন্দ, সেনদিদির কাথা-জড়ানো ছেলে শশীর সামনে মেলিয়া ধরিয়া বলিল, ওকে মানুষ করার জন্য সোনার হার পাব শশীদাদা। মামার মন আজকাল বড় দরাজ হয়েছে।

ওকে আনলে কে?

মামাই আনল। এমনি কথা জড়িয়ে বুকের কাছটিতে ধরে। বাড়ির ছেলেমেদের কাছে ঘেঁষতে দেয় না, পরের ছেলে কোলে নেবার মামার রকম দেখে হেসে হেসে বাঁচি না। আমায় কী বললেন জানেন?–ছেলেটা নিলামরে কুন্দ আমি, মানুষ করতে পারবি? তোকে দশভরির হার গড়িয়ে দেব। আমি বললাম, দিন না মামা, আমার ছেলেমেয়ের সঙ্গে মানুষ হবে, এতে আর হাঙ্গামা কী?

শশী ঝাঝিয়া বলিল, কেন তুই এ ভার নিতে গেলি? এত গয়নার লোভ তোর!

কুন্দ অবাক হইয়া বলিল, গয়নার লোভে বুঝি? অতটুকু মা-মরা শিশু, কেউ না দুধ দিলে বাঁচবে কেন? মামি-টামি কারো কচি ছেলে নেই। সেকথা যদি বাদ দেন, মামা বললে আমি তো না বলতে পারি না।

সন্দিগ্ধভাবে তাকায় কুন্দ, খানিক বোঝে খানিক বোঝে না। এতক্ষণ পরে শশী হঠাৎ জামাকাপড় ছাড়িতে আরম্ভ করিল। কুন্দ জিজ্ঞাসা করিল, এত রাগলেন কেন শশীদাদা?

না, রাগিনি।

সেনদিদির ছেলে কান্না থামাইয়াছিল। কুন্দ তাকে একটা চুমো খাইল,—সস্নেহে, গৌরবের সঙ্গে। কে জানে কী দুষ্টামি আছে কুন্দর মনে তারপর ছেলেকে আর একবার শশীর দিকে বাড়াইয়া দিয়া বলিল, কী সুন্দর হয়েছে ছেলেটা দেখুন শশীদাদা, সেনদিদির মতো দেখতে হবে। মুখখানা দেখলে মায়া হয় না?

শশী শ্রান্তভাবে বলিল, তুই যা তো কুন্দ। ঘেমেচেমে হয়রান হয়ে এলাম, একটু বিশ্রাম করতে দে।

কার উপরে রাগ করিবে শশী, কাকে বলিবে? সেনদিদির ছেলে যে সুন্দর হইয়াছে তাতে সন্দেহ নাই, আশ্চর্যরকম সুন্দর হইয়াছে; সেনদিদির যে জমজমাট রূপ বসন্ত হরণ করিয়াছিল ছেলের মধ্যে যেন তার ক্ষতিপূরণ হইয়াছে সুদসমেত। এতটুকু ছেলে, কাচা সোনার মতো কী তার রঙ। ওর মুখ দেখিয়া গোপালের যদি মায়া হইয়া থোকে, মায়া করিয়া গোপাল যদি এই অনাথ শিশুকে বুকে তুলিয়া ঘরে আনিয়া থাকে, তাতে কার কী বলিবার আছে? এ তো মহত্ত্ব, প্রশংসনীয় কাজ। ক্ষোভে দুঃখে এজন্য এমন কাতর হওয়া তো শশীর উচিত নয়।

সেনদিদির ফুলের মতো শিশুকে দেখিয়া একটু কি মায়া হইল না শশীর মায়া করার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি কি তার এমনভাবে নষ্ট করিয়া দিয়া গিয়াছে কুসুম? গম্ভীর বিষন্নমুখে শশী স্নান করিতে গেল, সেনদিদির ছেলেকে কোলে করিয়া কুন্দ অদূরে আসিয়া বসায় ভালো করিয়া খাওয়া পর্যন্ত হইল না শশীর। অল্পে অল্পে শরীরটা তাহার কিছু ভালো হইয়াছে, কী ক্ষুধাই আজ পাইয়াছিল!

সমস্ত দুপুরটা শশী নিঝুম হইয়া রহিল। এবার কিছু করিতে হইবে তাহাকে, আর চুপ করিয়া থাকা নয়। আর গরমিল চলিবে না। স্তব্ধ দ্বিপ্রহরে নিস্তেজ শয্যাশায়ী শশীর মনে অসংখ্য এলোমেলো ভাবনা বিস্ময়করভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়া আসিতে থাকে, কোমল মমতাগুলির আলগা ফুলের মতো ঝুরঝুর করিয়া ঝরিয়া যায়। আগুনের আচে সরস বস্তুর শুকাইয়া যাওয়ার মতো নিজে সে রুক্ষ প্রকৃতির মানুষ হইয়া উঠিতেছে এমনি একটা অনুভূতি শশীর হয়। একেবারে বেপরোয়া, নির্মম, অবিবেচক কুসুমের জন্য মন কেমন করিত শশীর। বড় আকুলভাবে মন কেমন করিত। এতবড় উপযুক্ত ছেলের মর্যাদায় ঘা দিয়া মনকে কী করিয়া দিয়াছে গোপাল যে সেই মন-কেমন-করাকে আজ হাস্যকর মনে হইতেছে? সে যে-বাড়িতে বাস করে অবানবদনে সেনদিদির ছেলেকে সেখানে গোপাল কেমন করিয়া আনিল? সেনদিদিকে মরমর জানিয়াও শশী যে তার চিকিৎসা করিতে যাইতে চাহে নাই গোপাল কি সে কথা ভুলিয়া গিয়াছে? শশীর অভিমান এতই তুচ্ছ গোপালের কাছে, সে কী ভাবিবে না ভাবিবে সেটা এতখানি অবহেলার বিষয়! শশীর কাছে তার একটু সংকোচ করিবারও প্রয়োজন নাই? ছেলের সম্বন্ধে এমনি ধারণা গোপালের যে সে ভাবিয়া রাখিয়াছে সেননিদির ছেলেকে বাড়িতে আনিয়া পুত্রয়েহে মানুষ করিতে থাকিলেও শশী চুপ করিয়া থাকিবে, গ্রাহ্যও করিবে না। কে জানে, গোপালই হয়তো গ্রাহ্য করে না শশী চুপ করিয়া থাক অথবা গোলমাল করুক।

পরদিন সকালে হাসপাতাল-কমিটির মেম্বারদের কাছে শশী জরুরি চিঠি পাঠাইয়া দিল। শীতলবাবুর বাড়িতে সন্ধ্যার পর কমিটির জরুরি সভা বসিল। শশী পদত্যাগপত্র পেশ করিল, ডাক্তারের জন্য বিজ্ঞাপনের খসড়া দাখিল করিল, প্রস্তাব  করিল যে হাসপাতালের সমস্ত দায়িত্ব কমিটির সুযোগ্য প্রেসিডেন্ট শীতলবাবুর হাতে চলিয়া যাক।

কমিটির হতভম্ব সভ্যেরা প্রশ্ন করিলেন, কেন শশী, কেন?

শশী বলিল, আমি গাঁ ছেড়ে চলে যাচ্ছি।

এবার আর দ্বিধা নয়, গাফিলতি নয়। অনিবার্য গতিতে শশীর চলিয়া যাওয়ার আয়োজন অগ্রসর হইতে থাকে। হাসপাতাল-সংক্রান্ত ব্যাপারগুলি শীতলবাবুকে বিশদভাবে বুঝাইয়া দেয়, টাকাপয়সার সম্পূর্ণ হিসাব দাখিল করে, আর ভবিষ্যতের কার্যপদ্ধতি সম্বন্ধে কিছু কিছু নির্দেশও লিখিয়া দেয়। ডাক্তারের জন্য কাগজে যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হইয়াছিল তার জবাবে দরখাস্ত আসে অনেকগুলি। কমিটির সভ্যদের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া তাদের মধ্যে কয়েকজনকে শশী দেখা করিতে আসিবার জন্য পত্র লিখিয়া দেয়।

সকলে খুতখুঁত করে, কেহ কেহ হায় হায় করিতেও ছাড়ে না। কোথায় যাইবে শশী, কেন যাইবে? সে চলিয়া গেলে কী উপায় হইবে গায়ের লোকের? পাস-করা ডাক্তারের দরকার হইলে আবার কি তাহদের ছুটিতে হইবে বাজিতপুরে? সকলে কৈফিয়ত চায় শশীর কাছে, তার সঙ্গে তর্ক জুড়িবার চেষ্টা করে। শশী না দেয় কৈফিয়ত, না করে তর্ক। মৃদু একটু হাসির দ্বারা অন্তরঙ্গতাকে গ্রহণ করিয়া প্রশ্নকে বাতিল করিয়া দেয়।

তবু খবরটা প্রচারিত হওয়ার পর হইতে চারিদিক এমন একটা হৈচৈ শুরু হইয়াছে যে মনে মনে শশী বিচলিত হইয়া থাকে। কেবল ডাক্তার বলিয়া স্বার্থের খাতির তো নয়, মানুষ হিসাবেও মনের মধ্যে সকলে তাহাকে একটু স্থান দিয়াছে বৈ-কি। সাধারণের ব্যাপারগুলিতে সে উপস্থিত থাকিলে সকলের মনে উৎসাহের সঞ্চার হয়, তার উপরে নির্ভর রাখিয়া সকলে নিশ্চিন্ত থাকে। এ তো অকারণে হয় না, কতবড় সৌভাগ্য শশীর, না চাহিয়া জনতার এই প্রীতি পাইয়াছে। এ তো শুধু সৎকার্যের পুরস্কার নয়। কী এমন সৎকাজটা শশী  করিয়াছে? রাস্তাঘাটের সংস্কারের জন্য কোদাল ধরে নাই, ম্যালেরিয়া নিবারণের ছাত্রসঙ্গ প্রভৃতি গড়িয়া তোলে নাই, কিছুই করে নাই। শুধু হয়তো আশেপাশে দশটা গ্রামে শশীর চেয়ে বেশি প্রভাব আর কাহারো নাই! শশীকে যদি সকলে ভালো না বাসিবে এমনটা তবে হইবে কেন?

শশী তাদের ভালোবাসে, শশীকে তারা ভালোবাসিয়াছে? গ্রাম ও গ্রাম্যজীবনের প্রতি মাঝে মাঝে শশী গভীর বিতৃষ্ণ বোধ করিয়াছে, ধরিতে গেলে আজ কত বছর এখানে তার মন টিকিতেছে না; তবু ক্ষতের বেদনার মতো স্থায়ী একটা কষ্ট শশীর মধ্যে আসিয়াছে, গ্রাম ছাড়িবার কথা ভাবিলে কেমন করিয়া উঠে মনটা। এখানে জন্ম শশীর, এখানেই সে বড় হইয়াছে। এই গ্রামের সঙ্গে জড়ানো তার জীবন। কুসুম ছিল বিদেশিনী, যেদিন শখ জাগিল নির্বিকার চিত্তে বিদায় হইয়া গেল-শশী কেন তা পরিবে? রওনা হওয়ার সময় চোখের কোণে  জল পর্যন্ত আসিবে শশীর। নিশ্চয় আসিবে।

কুন্দ কাঁদে –কেন শশীদা, কেন চলে যাচ্ছেন আমাদের ছেড়ে?

সেনদিদির ছেলের ভার লওয়ায় কুন্দর কাজ বাড়িয়াছে, তবু সে শশীর সেবা বাড়াইয়া দেয়। শশী যতক্ষণ বাড়িতে থাকে কোনো-না-কোনো ছলে কুন্দ বারবার কাসে আসে, ছলছল চোখে শশীর দিকে তাকায়, কত কী বলিতে চায় কুন্দ, সব কথা বলিতে সাহস পায় না।

কি রে কুন্দ, কী হল তোর? কুন্দ বলে।

কুন্দ বলে, আপনার জন সবাইকে ফেলে চলে যাওয়া কি ভালো শশীদাদা?

কেউ কি তা যায় না কুন্দ? সকলে কি দেশে গাঁয়ে থাকে?

যারা যায় পেটের ধান্দায় যায়, আপনার যাবার দরকার?

কার মেহের অভাবে এমন হু হু করিতেছে শশীর মন যে কুন্দর একটুকু মমতায় তার মোহ জাগে? মনে হয় আরও একটু মায়া করুক কুন্দ, আরও একটু কাতর হোক।

কাতর হইয়াছে গোপাল। একেবারে যেন আধমরা হইয়া গিয়াছে মানুষটা। নিজের বাড়িতে চোরের মতো বাস করে, ভীতু করুণ চোখে তফাত হইতে শশীর চালচলন লক্ষ করে, অপরকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া শশীর মতলবাদির সন্ধান নেয়। সামনাসামনি শশীর সঙ্গে কথা বলিবার সাহসও গোপাল পায় না! কে জানে কী বলিতে কী বলিয়া বসিবে তার দুরন্ত অবাধ্য ছেলে কোথায় যাইতে চায় শশী, কী করিতে চায় সঠিক খবর কেহ গোপালকে দিতে পারে না, তবে ব্যবস্থা দেখিয়া সকলে অনুমান করে যে দু-চার দশদিনের জন্য সহজ সাধারণ যাওয়া নয়, যাওয়াটা শশীর যাওয়ার মতোই হইবে।

তারপর একদিন শশীর চিঠির জবাবে হাসপাতালের চাকরির জন্য দরখাস্তকারীদের মধ্যে একজন গ্রামে আসিয়া পৌঁছিল। নাম তার অমূল্য, শশীর সঙ্গে একই বছর পাস করিয়া বাহির হইয়াছে। নাম শশীর মনে ছিল না, এখন দেখা গেল শশীর সে চেনা। অমূল্যের সঙ্গে আলাপ করিয়া শশীর ভালো লাগিল, তা ছাড়া এই সামান্য চাকরির দাবি লইয়া উপস্থিত হইলে বন্ধুকে কে ফিরাইতে পারে? লোক বাছিবার আর প্রয়োজন রহিল না, কয়েকদিন পরে পরে যাদের আসিবার জন্য তারিখ দেওয়া হইয়াছিল, তাদের বারণ করিয়া চিঠি লিখিয়া দেওয়া হইল।

নিজের বাড়িতেই অমূল্যকে একখানা ঘর শশী ছাড়িয়া দিলা বলিল, একদিন আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে হবে অমূল্য, রোগীদের চিনে সব বুঝে-শুনে নেবে-এবার থেকে সমস্ত ভার তোমার। গাঁয়ের যারা তোমায় ডাকবে তাদের অধিকাংশ বড় গরিব, ফি-টা তাচ্ছিল্য করিতে শিখো। যার যা ক্ষমতা নিজে থেকেই দেবে, গায়ের লোক ডাক্তারকবরেজকে ঠকাতে সাহস পায় না।

সঙ্গে করিয়া অমূল্যকে সে হাসপাতালে লইয়া গেল, নিজের চেয়ারের পাশে তার জন্য চেয়ার পাতিয়া দিল। একটু মোটাসোটা মানুষ অমূল্য, ধীর শান্ত প্রকৃতি, কিন্তু উৎসাহের অভাব নাই। নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে সে শশীর কাজ

নিয়মকানুনের বিষয়ে প্রশ্ন করিল। মনে হইল, এখন হইতেই সে যেন গভীর দায়িত্ব বোধ করিতেছে। শশী চলিয়া যাইবে, আর কখনও ফিরিয়া আসিবে না, একথা শুনিবার পর এখানকার সমগ্র নূতনত্বের অন্ধকারে তার নিজের আলোটি জ্বলিবার অধিকার যেন তার জনিয়াছে। একটু সমালোচনাও অমূল্য করিল। এই নিয়মটা এমন হইলে ভালো হইত না শশী, এই ব্যবস্থার বদলে এই ব্যবস্থা? এসব সুলক্ষণ, কাজকর্ম অমূল্য যে ভালোই করিবে তার প্রমাণ, তবু মনে মনে শশীর অকারণে ক্ষোভ জাগিতে লাগিল। তার একটা রাজ্য যেন কে বেদখল করিতে আসিয়াছে—কত যত্নে কত পরিশ্রমে শশী যে গড়িয়া তুলিয়াছে তার এই হাসপাতাল, লোকে যে এটা শশী ডাক্তারের হাসপাতাল বলিয়া জানে! ফোড়াকাটা ক-খানা ছুরি আছে হাসপাতালে তাও শশীর গোনাগাথা। গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে জানিয়াও ধীরে ধীরে হাসপাতালটিকে বড় করিয়া তুলিবার কল্পনা সে তো কম করে নাই। দুদিন পরে এখানে কর্তৃত্ব করিবে অমূল্য, হয়তো উন্নতি হইবে, হয়তো অবনতি হইবে, কিছুই শশী দেখিতে আসিবে না।

যাওয়ার কথা ভাবিতে ভাবিতে এমন হইয়াছিল শশী যে সে যেন ভুলিয়া গিয়াছিল কেহ তাহাকে যাইতে বলে নাই, নিজে সে সাধ করিয়া যাইতেছে, এখনও যাওয়া বন্ধ করিলে কেহ তাহাকে কিছু বলিতে আসিবে না। না গেলে তার যে চলিবে না, যাইতে সে যেন বাধ্য। কে যেন গা হইতে তাহাকে তাড়াইয়া দিতেছে, থাকিবার উপায় নাই।

যাইতে ক্ষোভই বা কিসের শশীর? কতকাল ধরিয়া কতভাবে সে যে তার যাওয়ার কামনাকে পুষ্ট করিয়াছে? যাওয়ার আয়োজন শুরু করিবার সময় দ্বিধা না করিবার, গাফিলতি না করিবার প্রতিজ্ঞাই বা কোথায় গেল শশীর? অমূল্যের মধ্যে নিজের ভবিষ্যৎ প্রতিনিধিকে দেখিয়াই মনটা এমন বিগড়াইয়া গেল? জীবনের বিপুল ব্যাপক বিস্তারের স্বপ্ন দেখিয়া যার দিন কাটিত, এই তুচ্ছ গাওদিয়া গ্রামে এই ক্ষুদ্র হাসপাতালের মোহে আবদ্ধ হইয়া থাকিতে চাওয়ার কথা তো তার নয়!

অমূল্যকে দেখিয়া এবং সে কেন আসিয়াছে শুনিয়া গোপাল আরও ভড়কাইয়া গেল। আর সে চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না। রাত্রে শশী খাইতে বসিলে কোথা হইতে আসিয়া নীরবে একখানা আসন আনিয়া নিজেই পাতিয়া গোপাল তার পাশে বসিল। পিসি ছুটিয়া জলের গ্লাস দিয়া অদূরে বসিতে যাইতেছিল, গোপাল বলিল, যা তুই ক্ষান্ত, পাকঘরে বসবি যা।

পিসি চলিয়া গেলে গোপাল বলিল, তুমি কোথায় যাবে শশী?

শশী বলিল, প্রথমে আপাতত কলকাতায় যাব।

গোপাল বলিল, তারপর পশ্চিম-টশ্চিম একটু ঘুরে বেড়িয়ে বাড়ি ফিরবে বুঝি? মাসখানেক লাগেব তোমার, না?

কলকাতা থেকে বিলেত যাব।

বিলেত? মুখে একগ্রাস ভাত তুলিয়াছিল গোপাল, সেটা গিলিতে গিয়ে দম যেন আটকাইয়া আসিল।–বিলেত কেন?

শিখে টিখে আসব।–শশী বলিল।

গোপাল ব্যাকুলভাবে বলিল, তাতে তো অনেকদিন লাগবে শশী। দু-তিন বছরের কম নয়। এতকাল আমি একা পড়ে থাকব গাঁয়ে?

শশী আশ্চর্য হইয়া বলিল, একা পড়ে থাকবেন?

না, একা নয়, ঘরভরা আত্মীয়-পরিজন থাকিবে গোপালের, গ্রামভরা থাকিবে শক্রমিত্র। তবু শশী না থাকিলে কী একাই যে সে হইয়া যাইবে এতবড় ছেলেকে কেমন করিয়া গোপাল আজ তা বোঝায়। এ জগতে আর কে আছে একা গোপালের অন্তর জুড়িয়া? হৃদয় তাহার কী রীতি পালন করিয়াছে গোপাল তা জানে মা, এ জগতে একটা মানুষকে সে স্নেহ করিতে পারে নাই, নিজের মেয়ে কটাকে পর্যন্ত নয়; শুধু শশীর জন্য, একা শশীর জন্য, উন্মাদ বাৎসল্য আজও বুক জুড়িয়া আছে। গাম্ভীর্য, ধীরতা সব খসিয়া যায় গোপালের, জড়ানো ভারী গলায় সে বলে ; কেন যাবি বাবা, আমার ওপর রাগ করে, তোর তো আমি কিছুই করিনি!

শশী মৃদুস্বরে বলিল, জীবনের উন্নতি করতে যাব, এতে রাগের কী আছে?

একটু ভাবিয়া গোপাল বলিল, তিন-চার বছর পরে ফিরে এসে হয়তো আমায় আর দেখতেই পাবি না শশী।

তিন-চার বছর পরেও সে যে ফিরিয়া আসিবে না সে-বিষয়ে শশী কিছু বলিল না। নীরবে ভাত মাখিতে লাগিল।

গোপাল আবার বলিল, বুড়ো হলাম, হঠাৎ একদিন যদি মরে যাই, তুইও কাছে না থাকিস, কে এসব দেখবে শশী? সারাজীবন খেটেখুটে যা-কিছু করেছি সব যে ছারেখারে যাবে।

শশী বলিল, আপনার যাকে খুশি সব দিয়ে দেবেন।

এ তো ছেলেমানুষ কথা হল শশী, রাগের কথা হল! বলিয়া গোপাল উৎসুক দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। মিথ্যা আশা। প্রতিবাদ করিয়া কিছুই তো শশী বলিল না। ভিতরে ভিতরে একটা জ্বালা বোধ করিতেছিল গোপাল, কী অদ্ভুত বিকারগ্রস্ত সে সস্তান, যার মনের নাগাল মেলে না? কী হইয়াছে বলুক না শশী, জানাক না ঠিক কী সে চায়। অনেক অধিকার ত্যাগ করিয়া ছেলের ইচ্ছায় গোপাল আজ সায় দিবে। নিজের অনিচ্ছার দিকে একেবারেই তাকাইবে না। উপযুক্ত হইয়াছে অবাধ্য হইয়াছে ছেলে, কী আর করিবে গোপাল, নীরবে সবই তাহাকে সহিতে হইবে! এই ধরনের কথা কিছু শশীকে সে বলে। তার কথায় একপ্রকার অদ্ভুত মিনতি ধ্বনিত হইতে থাকে। কী উগ্র ক্রোধ আর নিদারুণ ভয় আর গভীর দুঃখ মনের মধ্যে চাপিয়া রাখিয়া গোপাল কথা বলিতেছে বুঝিতে পারিয়া নিজেকে বড় বিপন্ন বোধ করে শশী, তবু ধরাছোয়া সে দেয় না। পিতাপুত্রে কী আজ শুরু হইয়াছে বুঝিতে কাহারো বাকি থাকে নাই, ঘরে ঘরে দরজাজানালার আড়ালে জড়ো হইয়া সকলে ওঁত পাতিয়া আছে, চড়া গলায় এদের কথা শুরু হইলে প্রাণ ভরিয়া শুনিবে। বাড়ির একটা অস্বাভাবিক স্তব্ধ আবহাওয়া স্পষ্ট অনুভব করা যায়। কখন ঝড় উঠবে ঠিক নাই।

ঝড় উঠিল সম্পূর্ণ অন্য দিক দিয়া। হঠাৎ সেনদিদির ছেলেকে কোলে করিয়া কোথা হইতে কুন্দ আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, খেয়ে উঠে একবার দেখবেন তো শশীদাদা, গাটা বড় গরম বোধ হচ্ছে।

শশী মুখ তুলিল না, কথা বলিল না। গোপাল বা হাত বাড়াইয়া উদ্বিগ্নকণ্ঠে বলিল, জ্বর হয়েছে নাকি? দেখি। দ্যাখ তো শশী একবার হাত দিয়ে? জ্বর মনে হচ্ছে যেন।

শশী নিঃশব্দে ভাত ফেলিয়া চলিয়া গেল।

জ্বর হয়েছে কি না দেখিবার জন্য অতটুকু শিশুর গায়ে একবার হাত দিবার অনুরোধ। তার জবাবে অমন করিয়া উঠিয়া গেলে সে কাজের মানে গোপালের মাথাতেও ঢোকে বৈ-কি। কুন্দর বিস্মিত দৃষ্টিপাতে লজ্জায় গোপালের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। অভ্যস্ত গলায় হুংকার দিয়া কুন্দকে বলে, দূর হ, সামনে থেকে দূর হ হারামজাদী।

বিনা দোষে এমন গর্জন কুন্দ সহিতে পারে না, প্রথমে সে বিহাল হইয়া গেল, তারপর কাঁদিতে কাঁদিতে চলিয়া গেল নিজের ঘরে। দেখিতে দেখিতে বাড়ির কৌতুহলী মেয়েরা সেখানে গিয়া হাজির। কিছুদিন হইতে এ-বাড়ির কাণ্ডকারখানায় সকলে ভ্যাবাঁচাকা খাইয়া যাইতেছে। সাহসী কুন্দই সম্প্রতি ও আশ্চর্য হইয়া গেল।

কেন রে কুন্দ, বকল কেন রে তোকে?

কুন্দ কি সহজে সে কথা ফাঁস করে? ফাঁসফোঁস করিয়া সকলকে সে চলিয়া যাইতে বলে, কেন বিরক্ত করছ আমায়? অনেক তোষামোদে একটু ঠাণ্ডা হয় কুন্দ, তারপর গোপালের রাগের কারণটা ব্যক্ত করে। বলে, আমার যেমন পোড়া কপাল! সেনদিদিও ছেলেটাকে শশীদার সামনে নিয়ে যেতে কতবার মামা বারণ করেছে, তা কথাটা একদম ভুলেই গেলাম। সাদাসিধে মানুষ বাবু আমি, ওসব ঘোরপ্যাচের কথা কি ছাই আমার মনে থাকে!

সকলে বলে, হ্যাঁ লো কুন্দ, ও ছেলেকে আনার পর থেকে বুঝি শশী এমন রেগে আছে, বাপের সঙ্গে কথা কয় না, বিবাগী হয়ে বেরিয়ে যাবে বলে?

নয়তো কী? কুন্দ বলে।

একটু হাসে কুন্দ কে জানিত তলে তলে এমন বাকা মন আমাদের ঠোট কাটা কুন্দর বলে, এই ছেলেটাকে নিয়ে বাপ-বেটার কত কী চলেছে তোমরা কী জানবে টের পাই আমি। কী হয় দেখবার জন্যেই তো দুজনে একত্তর খেতে বসেছে দেখে ছেলেটাকে নিয়ে গেলাম। অমন গাল খাব তা ভাবিনি ছোটমামি। আর এখনি হয়েছে কী, একে নিয়ে কী ভীষণ কাণ্ড হয় দেখো, যেমন-তেমন মায়ের ছেলে তো নয় এ।

তার ওপরে মাই খাচ্ছে তোর, না রে কুন্দ? ও ছেলে দেবেই তো ঘরে আগুন!

জ্বর বোধ হয় একটু হইয়াছিল ছেলেটার, গোলাপি বর্ণ তাহার আরও লালিম হইয়া উঠিয়াছে, তাকাইলে চোখ ফেরানো যায় না এমন আশ্চর্য সুন্দর শিশু, তাকে কেন্দ্র করিয়া এক বাড়িতে এতবড় একটা ঝড় উঠিবার উপক্রম হইয়াছে এ যেন বিশ্বাস করা যায় না। কুন্দর চারিদিকে সমবেত মায়েরা দুর্ভাগা ছেলেটাকে ঈর্ষা করে, বাৎসল্য ব্যাকুলও হয়। এর সঙ্গে এক বাড়িতে বাস করিতে চাহে না, কী কঠোর মনটা শশীর, মেহলেশশূন্য অন্তঃকরণ।

সেদিন রাত্রে বিনিদ্র গোপাল কী সব ভাবিল সে-ই জানে, পরদিন সকালে কুন্দকে সে চালান করিয়া দিল তার খুড়-শ্বশুরের বাড়ি রাজাতলায়, সঙ্গে গেল তার স্বামীপুত্র এবং সেনদিদির ছেলে।

কাজটা করিয়া গোপাল যেন অনেকটা নিশ্চিত হইল। রাগের কারণ দূর হইল, আর তো শশীর রাগ থাকিবে না। সেনদিদির ছেলে পৃথিবীতে আসিয়াছে বলিয়া শশী রাগ করে নাই, তাকে বাড়িতে আনা হইয়াছে বলিয়া সে গৃহত্যাগ করিয়া যাইতেছে। এ অন্যায় আবদার শশীর অসঙ্গত ব্যবহার, তবু মাথা নিচু করিয়া গোপাল যখন তাহার অভিযোগের প্রতিকার করিল, বাড়ি ছাড়িয়া যাইতে কি আর শশী পরিবে!

পরের মুখে খবরটা ঠিকমতো শশীর কানে পৌঁছেবে না আশঙ্কা করিয়া চোখ-কান বুজিয়া নিজেই গোপাল তাহাকে শোনাইয়া দিল। বলিল, কুন্দকে আজ শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিলাম শশী।

শশী বলিল, রাজাতলায়?

গোপাল বলিল, হ্যাঁ। যামিনীর ছেলেটাকেও ওর সঙ্গে দিয়ে দিলাম।

যামিনীর ছেলে প্রসঙ্গ উঠিলে শশী মুখ খোলে না। গোপাল আবার বলিল, কুন্দ এখন ওখানেই থাকবে বলে দিয়েছি এখানে আসবার ওদের কোনো দরকার নেই।

শশীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিয়াই কাজটা সে যে হাসিল করিয়াছে এমনিভাবে গলা নামাইয়া গোপাল জাবাব বলিল, আসল কথা কী জানিস বাবা, এক ঢিলে দুটো পাখি মেরেছি। কুন্দকেও সরালাম, পরের ছেলে ঘাড়ে করার দায় থেকেও রেহাই পেলাম। যা খুশি করুক গিয়ে এবার, আমি কিছু জানি না–কেঁদেকেটে চিঠি লেখে দু-চার টাকা পাঠিয়ে দেব, বাস্, ফুরিয়ে গেল সম্পর্ক।

তাই যদি ইচ্ছা ছিল গোপালের, বিপিনের কাছ হইতে সেনদিদির ছেলের ভার গ্রহণ করিবার তার কী প্রয়োজন ছিল শশী তা জানিতে চায় নাই তাই রক্ষা, জবাব গোপাল দিতে পারিত না। শশীকে গোপাল ছাড়িতে পারে না, সেনদিদির ছেলেকে ফেলিতে পারে না, অনেক ভাবিয়া চারিদিক রক্ষা করার জন্য পাকা রাজনীতিকের মতো সে যে চাল চালিয়াছে তার সমর্থনের জন্য এরকম দুটো-একটা বানানো পাকা কথা না বলিলে চলিবে কেন ছেলের সঙ্গে তর্ক করিয়া অখণ্ড যুক্তি দাঁড় করানোর জন্য তো এসব বলা নয়, এ শুধু তাকে জানানো যে হার গোপাল মানিয়াছে, ওরে পাথরের পুত্র-দেবতা, এবার তুই তোর ভীষ্মের প্রতিজ্ঞ ছাড়।

সেনদিদির ছেলেকে সরাইয়া নেওয়ার জন্য শুধু নয়, তাকে ধরিয়া রাখার জন্য গোপালকে এমন উতলা হইয়া উঠিতে দেখিলে হয়তো শশী মত বদলাইয়া ফেলিত, আবার হয়তো বাতিল হইয়া যাইত তাহার গ্রামত্যাগের কল্পনা। এখন বড় দেরি হইয়া গিয়াছে। মন তো শশীর কখন চলিয়া গিয়াছে দূরতর দেশে নবতর জীবনযাপনে, এখন শুধু বেঁচেকা ঘাড়ে সেখানে পৌছনো বাকি-তাও দুচারদিনের মধ্যেই ঘটিবে।

সারাদিন গোপালের নিশ্চিন্ত প্রফুল্লভাব শশীকে পীড়া দিল। সে বুঝিতে পারিল গোপাল ধরিয়া লইয়াছে তাদের মধ্যে সমস্ত গোলমাল মিটিয়া গিয়াছে, দিনগুলি অতঃপর যেমন সহজভাবে কাটিতেছিল তেমনিভাবে কাটিতে থাকিবে। এমন একটা জটিল ব্যাপারের এত সহজে এরকম মনোমতো পরিণতি ঘটিবে, গোপালকে ইহা বিশ্বাস করিতে দেখিয়া আশ্চর্যও শশী কম হইল না। তার কাছে কী প্রত্যাশা করে গোপাল? এমন আকুল আগ্রহে কেন সে তাকে ধরিয়া রাখতে চায়? মতে তাদের কখনও মিল হইবে না, প্রতিদিন খিটিমিটি বাঁধিবে, স্নেহ মমতা শ্রদ্ধা ভক্তি পাহাড়কে চাপা দিয়া স্তুপাকার হইয়া উঠিবে অশান্তির হিমালয়। তবু শশীকে গ্রামে বসিয়া এই আত্মবিরোধময় সংকীর্ণ জীবন যাপন করিতে হইবে? এতবড় বিপুল পৃথিবী পড়িয়া থাকিতে তাদের দুটি বিরোধী ব্যক্তিত্বকে অর্থহীন অব্যবহার্য মেহের মোহ আশ্রয় করিয়া থাকিতে হইবে এ ক্ষুদ্র গৃহকোণে?

সেনদিদির ছেলেকে বাড়িতে আনার জন্য মনে মনে শশীর যত বড়ো আঘাতই লাগিয়া থাক, গৃহত্যাগের কারণ হিসাবে আজ তা বহুগুণে তুচ্ছ হইয়া গিয়াছে। গ্রাম ছাড়িয়া যাইতে যে গভীর দুঃখ জাগিয়াছে শশীর মধ্যে, ও-ধরনের মানসিক বিতৃষ্ণার অজুহাত তার কাছে খাটানো চলে না; আরও বড় লোভ, আর বড় আকর্ষণ দরকার হয়। অথচ গোপালের পক্ষে তা ধারণা করাও অসম্ভব। শশী চলিয়া গেলে তার যাওয়ার ঐ একটি কারণের কথাই গোপাল জানিয়া রাখিবে—সেনদিদির ছেলেকে বাড়ি আনা।

শীতলবাবু ডাকিয়াছিলেন। অমূল্যর সঙ্গে সন্ধ্যার পর শশী তার বাড়ি গিয়াছিল। অমূল্যকে জলটল খাওয়াইয়া শীতলবাবু সকাল সকাল ছাড়িয়া দিলেন, শশকে ছাড়িলেন রাত্রির আহারের পর, অনেক রাত্রে। শীতলবাবু আর এক বিপদ হইয়াছে শশীর, দুবেলা ডাকেন আর গেলেই কথায় কথায় পাগল করিয়া তোলেন শশীকে। বাড়ি ফিরিয়া শশী দেখিল আহারের স্থানে পাশাপাশি দুখানা আসন পাতা আছে এবং যে গোপাল আটটায় খাইতে বসে সে আজ তার প্রতীক্ষায় এগারোটা পর্যন্ত না-খাইয়া বসিয়া আছে।

এত দেরি করলে যে শশী? চট করে মুখহাত ধুয়ে এসো, বসে পড়ি আমরা।

শশী বলিল, আপনি বসুন, আমি খেয়ে এসেছি। শীতলবাবু না-খাইয়ে ছাড়লেন না।

গোপাল ক্ষুন্ন হইয়া বলিল, আজ রান্নার একটু আয়োজন করতে বলেছিলাম বাবা, ভাবলাম পরের ছেলে একটি বাড়িতে এসে আছে, আজবাদে কাল চলে যাবে, একদিন একটু আয়োজন-পত্ৰ করি খাওয়ার। তুমি খেয়ে আসবে বাইরে থেকে, তা জানতাম না।

শশী জিজ্ঞাসা করিল, পরের ছেলে কে?

গোপাল বলিল, অমূল্যবাবুর কথা বলছি। আহা, ডেকেডুকে এনে চলে যেতে বললে বড় লাগবে বেচারির মনে।

শশী বলিল, অমূল চলে যাবে কেন? ওকেই তো হাসপাতালে কাজ দেওয়া হয়েছে?

গোপাল সভয়ে বলিল, তুই থাকলে ও আবার কী করতে থাকবে শশী, অ্যাঁ?

আমি পরশু রওনা হব ভাবছি।–শশী বলিল।

পরশু? গোপালের মুখে আর কথা ফুটিল না। শশী ঘরে চলিয়া গেলে সে একেবারে বাহিরের দাওয়ায় গিয়া অন্ধকারে কাঠের বেঞ্চিটাতে বসিয়া রহিল। একজন মুনীষ দাওয়ায় শয়নের আয়োজন করিতেছিল, সে এক ছিলুম তামাক সাজিয়া দিল গোপালকে, তারপর মনিবের সামনে শুইয়া পড়িতে না পারিয়া বিছানো চাটাইটির উপর উবু হইয়া বসিয়া শ্রান্তিবশত জোরে একটা নিশ্বাস ফেলিল। আজ আবার ব্রহ্মচারীকে মনে পড়িতেছে গোপালের, সেনদিদির মৃত্যুর পর মনে যে গভীর বিষাদ ও বৈরাগ্য আসিয়াছিল, ব্রহ্মচারীর মুখে নীরস আধ্যাত্মিক কাহিনী শুনিতে শুনিতে এক আশ্চর্য উপায়ে তার ঘোরটা কাটিয়া গিয়াছিল। আজ বড় অবসন্ন মনে হইতেছে নিজেকে। বিচিত্ৰ কাণ্ডকারখানা ভরা দীর্ঘ জীবনটা আজ অকারণ, অর্থহীন মনে হইতেছে-কোনো কাজেই লাগিল না! শশীর জন্মের দিনটি হইতে তারি পানে চোখ রাখিয়া কত কল্পনাই গোপাল করিয়াছে—যার ডগাটি আকাশে ঠেকিয়া প্রায় হইয়াছে আকাশ-কুসুম খেলখাপড়া শিখিয়া এ কী রীতিনীতি শিখিয়াছে শশী? বাগান, বাড়ি, জমিজমা, ধনসম্পদ, আত্মীয়পরিজন-এত সব যে গোপাল একত্র করিয়াছে, এ কী তার নিজের জন্য? তার আর কতদিন বাকি। এসব তুচ্ছ করিয়া শশী যদি চলিয়া যায়, সমস্ত জীবনটাই গোপালের ব্যর্থ হইয়া যাইবে না?

এত রাত্রে সে একবার অমূল্যের ঘরে যায়। অমূল্যকে জাগাইয়া বলে, একটা কথা শুধোই বাবু তোমাকে। শশী পরশু চলে যাবে আমায় যে বলনি?

রাতদুপুরে ঘুমন্ত মানুষকে তুলিয়া গোপালের এই কৈফিয়ত দাবি করা অমূল্যকে ভড়কাইয়া দেয়। সে বলে, আমি জানতাম না, কবে যাবে শশী, আমায় কিছু বলেনি।

গোপাল অসন্তোষের সুরে বলে, আর সব বললে, একথাটা বললে না? কী যেন মতলব ছিল বাবু তোমার, তাই গোপন করেছিলে।

অমূল্য জিভ কাটিয়া বলে, আজ্ঞে না, সে কী কথা!

গোপাল বলিল, সে কী কথা! আমার ছেলে দেশছাড়া হবে চিরকালের জন্যে আর তুমি তার জায়গায় জেকে বসবে, বড় ভালো মতলব তোমার! ওঠো দিকি বাবু সুখশয্যা ছেড়ে, জিনিসপত্র চুপিচুপি গুছিয়ে নাও তারপর চলো আমরা বিদেয় হই।

ডাতাকের মতো দেখায় গোপালকে, খুনে দাঙ্গাবাজের মতো শোনায় কথাবার্তা। অমূল্যের ঘরে যে বিচিত্র, নাটকীয় কথোপকথন চলে, কিছুই শান্ত শশীর চেতনায় পৌঁছায় না; জীবন সম্বন্ধে যে অমন তীব্রভাবে সচেতন, সে হইয়া থাকে পুতুলের মতো চেতনাহীন। তাকেই বাৎসল্য করে বলিয়া মধ্যরাত্রে গোপাল আজ যে বিচিত্র দৃশ্যের অবতারণা করে, যেসব অদ্ভুত কথা বলে, তা দেখিলে ও শুনিলে একটা অভিজ্ঞতা জন্মিয়া যাইত শশীর। চাপা গলায় খানিকক্ষণ অমূল্যের প্রতি তর্জনগর্জন করিয়া গরম মাথাটা বোধ হয় একটু ঠাণ্ডা হয় গোপালের, সে ঘরে যায়।

পরদিন খুব ভোরে শশীকে সে ডাকিয়া তুলিল। শশী উঠিয়া দেখিল মুনীষের মাথায় বাক্স বিছানা চাপাইয়া কোথায় যাইবার জন্য গোপাল প্রস্তুত হইয়া আছে।

গোপাল সহজভাবেই বলিল, পরশু তোর যাওয়া হয় না শশী, আমি আজ বাবার কাছে কাশী যাচ্ছি,–সাত-আট দিন আশ্রমে থাকব। একজনের বাড়ি না থাকলে চলবে না। আমি ফিরে এলে যা হয় করিস।

শশী বলিল, হঠাৎ কাশী যাবেন কেন?

গোপাল পালটা জবাব দিয়া বলিল, হ্যাঁরে শশী, চিরকাল সংসারে হাঙ্গামা নিয়ে হয়রান হয়ে এলাম, এখন তোরা বড় হয়েছিস, মন টন ব্যাকুল হলে সাতটা দিনের ছুটিও পাব না? এতটুকু আশাও তোদের কাছে আমার করা চলবে না?

শশী মৃদুস্বরে বলিল, তা বলিনি, কোথাও কিছু নেই হঠাৎ যাচ্ছেন, তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম। কাল তো কিছু বলেননি আমাকে?

গোপাল দারুণ অভিমান করিয়া বলিল, না যদি থাকতে পারিস তো বল, যাওয়া বন্ধ করি। অদৃষ্টের লেখা কে খণ্ডবে!

শশী বলিল, বেশ তো আসুন গিয়ে-কদিন পরে গেলেও আমার কোনো অসুবিধা হবে না।

গোপালকে শশী প্রণাম করিল। সকালবেলায় স্বচ্ছ আলোয় দুজনের মুখ দেখিয়া মনে হইল না পিতা-পুত্রে কোনোদিন কোনো সামান্য বিষয়েও মতান্তর ছিল, জীবনের গতি দুজনের বিপরীতগামী।

 

সেই যে গেল গোপাল আর সে ফিরিল না। সংসার গৃহস্থ মানুষ সে, সমস্ত জীবন ধরিয়া ফলপুষ্পশস্যদাত্রী ভূমিখণ্ড, সিন্দুক ভরা সোনারুপা, কতকগুলি মানুষের সঙ্গে পরিবারিক ও আরও কতকগুলি মানুষের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক, দায়িত্ব, বাধ্যবাধকতা প্রভৃতি যতকিছু অর্জন করিয়াছিল সব সে দিয়া গেল শশীকে, মরিয়া গেলে যেমন সে দিত। কুন্দ কয়েকদিন পরে ফিরিয়া আসিল। রাজাতলা হইয়া গোপাল সেনদিদির ছেলেকে সঙ্গে লইয়া গিয়াছে। কুন্দ সোনার হার কিনিবে বলিয়া দুশো টাকাও তাহাকে দিয়া গিয়াছে। হয়তো ওটাই ছিল শেষ বাধ্যবাধকতা।

কী আর করিবে শশী, এ ভার তো ফেলিবার নয়। গভীর বিষন্নমুখে একে একে যাওয়ার আয়োজনগুলি বাতিল করিয়া দিল। দুমাসের মাহিনা পকেটে পুরিয়া অমূল্য ফিরিয়া গেল, গাঁয়ে থাকিতে হইলে হাসপাতালের প্রত্যেক রোগীর নাড়ি টিপিতে না পারিলে শশীর চলিবে কেন? কাজ আর দায়িত্ব ছিল জীবনে, কাজ আর দায়িত্বের জীবনটা আবার ভরপুর হইয়া উঠিল। নদীর মতো নিজের খুশিতে গড়া পথে কি মানুষের জীবনের স্রোত বহিতে পারে? মানুষের হাতে কাটা খালে তার গতি, এক অজানা শক্তির অনিবার্য ইঙ্গিতে? মাধ্যাকর্ষণের মতো যা চিরন্তন অপরিবর্তনীয়।

মামলা করিতে শশী বাজিতপুরে যায়, ফিরিবার পথে চোখ তুলিয়া দেখিতে পায় খালের ধারে বজ্রাহত একটা বটগাছ শুকনো ডালপালা মেলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। গাওদিয়ার ঘাটে গোবর্ধন নৌকা ভিড়ায়। নন্দলালের পাট-জমাকরা শূন্য চালাটা প্রায় ভাঙিয়া পড়িয়াছে দেখিয়া শশীর মনে হয় নন্দলালের পাপ-জমা-করা বিন্দুর দেহটাও হয়তো এতদিনে এমনিভাবে ভাঙিয়া পড়িয়াছে। জোরে আর আজকাল শশী হাঁটে না, মন্থর পদে হাঁটিতে হাঁটিতে গ্রামে প্রবেশ করে। গাছপালা বাড়িঘর ডোবা পুকুর জড়াইয়া গ্রামের সর্বাঙ্গ-সম্পূর্ণ রূপের দিকে নয়, শশীর চোখ খুঁজিয়া বেড়ায় মানুষ। যারা আছে তাদের, আর যারা ছিল। শ্রীনাথের দোকানের সামনে, বাঁধানো বকুলতলায়, কায়েতপাড়ার পথে। যামিনী কবিরাজের বাহিরের ঘরে হামানদিস্তার ঠকঠক শব্দ শশী আজও শুনিতে পায়; এ বাড়ির মানুষের ফাঁক মানুষ পূর্ণ করিয়াছে। যাদবের বাড়িটা শুধু গ্রাস করিতেছে জঙ্গলে, পরানের বাড়িতেও এখনো লোক আসে নাই। তার ওপাশে তালবন। তালবনে শশী কখনও যায় না। মাটির টিলাটির উপর উঠিয়া সূর্যাস্ত দেখিবার শখ এ জীবনে আর একবারও শশীর আসিবে না।

সমাপ্ত


© 2024 পুরনো বই