মাধবীলতা সোজাসুজি জবাব দিল, আমি কি জানি।
অর্থাৎ মাধবীলতার আপত্তি নাই। মনে মনে বড় অভিমান হয় মাধবীলতার, তাকে জিজ্ঞাসা করা কেন, কি করা উচিত? ইচ্ছা না থাকে, বাতিল করিয়া দিলেই হয়! সে তো আর পায়ে ধরিয়া সাধে নাই!
সদানন্দ অনেকবার মাধবীলতাকে ডাকিয়া পঠাইয়াছে, সে যায় নাই। কি করিবে গিয়া? সদানন্দ কি বলিবে, সে ভালো করিয়াই জানে! আর ওসব কথা শুনিবার সাধ মাধবীলতার নাই। নিজে সে অনেক ভাবিয়াছে এখনো ভাবিতেছে। ভাবিতে ভাবিতে মাথার মধ্যে যখন একটা যন্ত্রণা আরম্ভ হয়, মনে হয় মাথার ঘিলুগুলি গলিয়া গলিয়া তালুর কাছ হইতে টপটপ করিয়া ফোঁটা ফোঁটা ঝরিয়া পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে ( মোমের মতো), তখন হঠাৎ একসময় দুকানে তার তালা লাগিয়া গিয়া সমস্ত জগৎ বদলাইয়া যায়। স্তব্ধ ও শান্ত চারিদিক। ভাবনার তো কিছু নাই? আত্মগ্লানির কোনো কারণ তো খুঁজিয়া পাওয়া যায় না? সব ভালো, সব মিষ্টি, সব সুন্দর। জীবনে সুখী হওয়ার পথে একটা বাধাও আর নাই। কত আনন্দ জীবনে। আফসোস শুধু এই যে, সে জানে, আবার গোড়া হইতে সব শুরু হইবে, দুর্ভাবনা, অস্বস্তিবোধ, আত্মগ্লানি, আর মাথার অনির্দিষ্ট দুর্বোধ্য যাতনা। প্রথমে সামান্যভাবে আরম্ভ হইয়া বাড়িতে বাড়িতে কয়েকদিনে উঠিয়া যাইবে চরমে, তখন আবার দুকানে তালা লাগিয়া পাওয়া যাইবে শান্তি ও স্তব্ধতা। ব্যাপারটা মাধবীলতা ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারে না। এ কি কোনো অসুখ? মাথার অসুখ? পাগল-টাগল হইয়া যাইবে না। তো? সদানন্দ একদিন বিভূতিকে দিয়াই তাকে ডাকিয়া পাঠাইল। মাধবীলতা নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করিল, যাব?
যাবে বৈকি, বাঃ রে।
একা একা যেতে আমার কেমন ভয় করে।
ভয় আবার কিসের?
সদানন্দের সামনে নিজেকে মাধবীলতার সত্যই কেমন যেন পুতুলের মতো অসহায় মনে হয়। তাকে নিয়া যা খুশি করার ক্ষমতা যেন এই লোকটির কেমন করিয়া জন্মিয়া গিয়াছে।
আমাকে একেবারে ত্যাগ করে দিলে মাধু।
মাধবীলতা পুতুলের মতোই চাহিয়া থাকে। এই তো সবে আরম্ভ, আরো কত কথা সদানন্দ বলিবে! কিন্তু সদানন্দও কথা না বলিয়া চাহিয়া আছে দেখিয়া, খানিক পরে সে সত্যই আশ্চর্য হইয়া যায়। তখন মাধবীলতা মাথা নিচু করে, অনেক ভাবিয়া আস্তে আস্তে বলে, আপনি যদি বারণ করে–
সদানন্দ ভাবিতেছিল সেদিনকার কথা, আঙুলগুলিকে সেদিন পাখির পালকের চেয়ে কোমল করিয়া মাধবীলতার গায়ে বুলাইতে ইচ্ছা হইয়াছিল। আজ মারিতে ইচ্ছা হইতেছে। এমন কোমল, এমন মোলায়েম গা মাধবীলতার, দেখিলেই মনে হয় চামড়ার উপর বুঝি আর একটা অপাৰ্থিব আবরণ আছে (এটা সদানন্দ অনেকবার কল্পনা করিয়াছে), তাকে স্পর্শ করিবার কল্পনাতেই রোমাঞ্চ হইত, আজ কাটিয়া ছিড়িয়া রক্তপাত করিয়া দিতে ইচ্ছা হইতেছে। ইচ্ছা হইতে হইতে হঠাৎ উঠিয়া গিয়া সদানন্দ দরজা জানালা বন্ধ করিয়া দেয়। সত্যই কি মাধবীলতার শরীরটা সে ছিড়িয়া ফেলিবে নাকি? চোখ দেখিয়া মাধবীলতার সর্বাঙ্গ অসাড় হইয়া আসে। পাগল না হইয়া গেলে কি মানুষের এমন চোখ হয়? কি করিবে সদানন্দ? খুন-টুন করিয়া ফেলিবে না তো?
কাছেই বসে সদানন্দ, ডান হাত শক্ত করিয়া তার বাঁ হাতের কজির কাছে চাপিয়া ধরে। মায়ামমতা যে আজ সদানন্দের মনে এক ফোটা নাই, রাগে দুঃখে অপমানে মানুষটা গরগর করিতেছে, মাধবীলতা অনেক আগেই সেটা টের পাইয়াছিল। এতক্ষণে সে বুঝিতে পারে, ভয়ঙ্কর একটা আঘাতে দেহে মনে তাকে চিরদিনের জন্য পঙ্গু করিয়া দিবার সাধটাই সদানন্দের মনে মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়াছে। এতদিন মনে মনে সদানন্দ কি ভাবিয়াছে কে জানে, হয়তো এইরকম একটা কল্পনাই মনে মনে নাড়াচাড়া করিয়াছে। আজ আর কোনো রকমেই ঠেকানো যাইবে না। গলা টিপিয়া তাকে মারিয়া ফেলাও সদানন্দের পক্ষে আজ আশ্চর্য নয়। মাধবীলতা জানে বা হাতের কজিটা তার ভাঙিয়া গিয়াছে কিন্তু মাথার মধ্যে এমন ঝিমঝিম করিতেছে যে ব্যথাটা ভালো রকম অনুভব করিয়া উঠিতে পারিতেছে না।
বিস্ফারিত চোখ দুটি সদানন্দের চোখের সঙ্গে মিলাইবার চেষ্টা করিতে করিতে মাধবীলতা জ্ঞান হারাইয়া সদানন্দের গায়েই ঢলিয়া পড়িয়া গেল।
ঘরের কুঁজায় জল ছিল, মাথায় খানিকটা জল চাপড়াইয়া দিয়া সদানন্দ দরজা জানালা খুলিয়া দিল। খানিক তফাতে হাত গুটাইয়া বসিয়া বিড়বিড় করিতে লাগিল। বোধহয়, আত্মরক্ষার এত বড় অস্ত্ৰ আয়ত্ত করিয়া রাখার জন্য মাধবীলতাকে গালাগালি।
মাধবীলতা জ্ঞান হওয়ার পর সদানন্দ উদাসভাবে বলিল, আচ্ছা তুমি যাও মাধু।
আপনি কি করলেন আমার?
কিছুই করি নি।
মাধবীলতা সে কথা বিশ্বাস করিল না। কাঁদিতে কাদিতে চলিয়া গেল। গেল একেবারে বিভূতির কাছে। নালিশ যদি করিতে হয়, হবু স্বামীর কাছে করা ভালো।
বিভূতি শুনিয়া অবাক। অপমান করেছেন? কি অপমান করেছেন স্বামীজি তোমাকে?
মাথার মধ্যে কতকগুলো বড় অদ্ভুত প্রক্রিয়া চলিতেছিল মাধবীলতার, স্থান ও কালের কতকগুলি নিয়ম যেন চিলা হইয়া গিয়াছে। মাথার মধ্যে, অথচ ঠিক যেন মাথার মধ্যেও নয়, মাথার পিছন দিকে একটা বাড়তি অঙ্গ আছে, সেইখানে কত কি জিনিস এক সঙ্গে সরু আর মোটা হইয়া যাইতেছে, কয়েক দিন পরে পরে কানে যে তার তালা লাগে, সেই বীভৎস স্তব্ধতা সর্বব্যাপী আলোড়নের মধ্যে ঢেউ তুলিয়া এমন একটা এলোমেলো গতি লাভ করিয়াছে, যা চোখে দেখা যায়, আর এমন একটা অকথ্য ভয় (অনির্দিষ্ট ভয়ের যে এমন একটা অবর্ণনীয় রূপ থাকে, মাধবীলতার জানা ছিল না)–ব্যাপারটা বুঝিবারও নয়, বুঝাইবারও নয়। অথচ মস্তিষ্কের সাধারণ অংশটা এদিকে বেশ কাজ করিতেছে। সমস্ত ঘটনাটা অনায়াসে গড়গড় করিয়া সে বিভূতিকে বলিয়া গেল। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করিয়া হাত ধরিয়া টানিবার সময় ভয়ে অজ্ঞান হইয়া যাওয়ায় আজ কি ভাবে রাক্ষসটার হাত হইতে বাঁচিয়া গিয়াছে।
তুমি যদি এর প্রতিকার না কর–
বিভূতির মুখে মুখ গুঁজিয়া দিয়া মাধবীলতা ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল। বিভূতি কথা বলে না দেখিয়া, খানিক পরে মুখ তুলিয়া চাহিয়াই সে চমকাইয়া গেল। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করিয়া আসিয়া হাত চাপিয়া ধরিবার সময় সদানন্দের মুখ যেমন হইয়াছিল, বিভূতির মুখও তেমনি দেখাইতেছে।
একটু বোসো, আমি আসছি।
মাধবীলতা সভয়ে তার হাত চাপিয়া ধরিল, কি করবে? থাকগে, কিছু করে কাজ নেই। যা হবার তা তো হলই–
কিন্তু আর কি বিভূতিকে আটকানো যায়? হাত ছাড়াইয়া সে চলিয়া গেল। সদানন্দর ঘরে গিয়া সদানন্দের সামনে দাঁড়াইয়া বলিল, মাধুর সঙ্গে এরকম ব্যবহার করার মানে?
দ্যাখ বিভূতি, তুমি ছেলেমানুষ–
বাকি কথাগুলি সে বলিয়া উঠিতে পারি না, বিভূতির ঘুসিতে নাকটা হেঁচিয়া গেল। বিভূতি আরো মারিত, কিন্তু পিছন হইতে মহেশ তাকে জড়াইয়া ধরায় আর কিছু করিতে পারিল না।
ছেড়ে দাও বাবা, বজ্জাতটাকে আমি খুন করব।
ছি বিভূতি, ছি!
আমাকে ছি করছ? জান ও কি করেছে?
জানি বৈকি।
জান?–বিভূতি এতক্ষণ ছাড়া পাওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করিতেছিল, এবার স্তব্ধ হইয়া গেল।
নাক দিয়া রক্ত পড়া বন্ধ হইল প্রায় আধঘণ্টা পরে, সেবা বেশিরভাগ করিল শশধরের বৌ। কখন কোন্ ফাঁকে সে যে আসিয়া জুটিয়াছিল, কেউ টেরও পায় নাই। বিভূতি একদিকে ছোট একটা টুলে বসিয়া ব্যাপার দেখিতেছিল আর থাকিয়া থাকিয়া মুখ বাকাইতেছিল। এখনো তার রাগ কমে নাই, বেশ বোঝা যায় একটা হেস্তনেস্ত করিবার জন্যই সে বসিয়া আছে। মাঝখানে একবার সে একটা মন্তব্য করিতে গিয়াছিল, মহেশ হাত জোড় করিয়া বলিয়াছিল, দোহাই তোর, একটু থাম। তারপর হইতে সে চুপ করিয়া আছে।
বোঝা যায়, মহেশ ভাবিতেছে।
ভাবিবার কি আছে বিভূতি বুঝিতে পারে না। তার বিরক্তির সীমা থাকে না। মহেশ যদি সব জানেই, তবে আর এই পাষণ্ড সম্বন্ধে কৰ্তব্য স্থির করিতে তো একমুহূর্ত দেরি হওয়া উচিত নয়। এত সেবা যত্বই বা কি জন্য? ঘাড় ধরিয়া রাস্তায় বাহির করিয়া দিলেই হয়!
সদানন্দ একটু সুস্থ হইলে মহেশ বলিল, বিভূতি, বড় ঘরের রোয়াকে ভাঙা কাঠের বাক্সটা আছে না, তার থেকে বড় হাতুড়িটা নিয়ে আসবে?
হাতুড়ি দিয়ে কি করবে?
একটু কাজ আছে।
বিভূতি হাতুড়ি আনিয়া দিল। লোহায় মরিচা ধরিয়া গিয়াছে। হাতুড়ি হাতে করিয়া মহেশ চৌধুরী বলিল, প্রভু, আমার ছেলের হয়ে আমি আপনার কাছে মাপ চাইছি। ছেলে আমার প্রায়শ্চিত্ত করবে না, ওকে বলা বৃথা। ছেলের হয়ে আমি প্রায়শ্চিত্ত করছি, আপনি তাই মঞ্জুর করুন।
বলিতে বলিতে মহেশ চৌধুরী করিল কি, হাতুড়িটা দিয়া নিজের নাকের উপর সজোরে মারিয়া বসিল। সকলে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল, কেবল শশধরের বৌ আবার সেবা আরম্ভ করিয়া দিল মহেশের। সে যেন এইরকম একটা কাণ্ড ঘটিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াই প্রতীক্ষা করিতেছিল।
সদানন্দের চেয়ে মহেশের যে জোরে লাগিয়াছিল তাতে সন্দেহ নাই, রক্ত আর বন্ধ হইতে চায় না। মহেশের বারণ না মানিয়া বিভূতি পাড়ার সুবিমল ডাক্তারকে ডাকিতে পাঠাইয়া দিল। ডাক্তার আসিয়া কিন্তু করিতে পারিল না কিছুই, তেলা নাকটা পরীক্ষা পর্যন্ত নয়। মহেশ তাকে ঠেলিয়া সরাইয়া দিয়া অতিকষ্টে খোনাসুরে বলিল, না না, আমার কর্মভোগ আমায় ভোগ করতে দিন।
সুবিমল ডাক্তারের কাছে পাড়ার লোক জানিতে পারিল, সাধু সদানন্দ আর মহেশ চৌধুরীর মধ্যে ভয়ানক রকমের একটা হাতাহাতি হইয়া গিয়াছে। দুজনেই দারুণ আহত। মহেশ চৌধুরীর এখন ভয়ানক অনুতাপ হইয়াছে, বিনা চিকিৎসায় মরিয়া যাইতে চায়।
হাতাহাতি হইল কেন? প্রথমে কথা কাটাকাটি, তারপর হাতাহাতি! ও রকম তো ওদের মধ্যে লাগিয়াই আছে। অন্যদিন কথা কাটাকাটির মধ্যেই সমাপ্তি হয়, আজ হাতাহাতি পর্যন্ত গড়াইয়াছে।
কথাটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত রূপ নিল অন্যরকম। ঘটনাটা অপরাত্নের, সন্ধ্যার পর অনেকে খবর জানিতে আসিল। সদানন্দ তখন নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া বসিয়া আছে, তার দেখা কেউ পাইল না। মহেশ চৌধুরীর সমস্ত মুখটাই ফুলিয়া গিয়াছে, কথা বলিতেও কষ্ট হয়। তবু সেই সংক্ষেপে ব্যাপারটা সকলকে ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া দিল। গোয়ারগোবিন্দ একটা ছেলে আছে তার সকলে জানে তো? একটা ভুল বোঝার দরুন হঠাৎ রাগের মাথায় সে সদানন্দকে অপমান করিয়া বসে। ছেলের হইয়া মহেশ চৌধুরী তাই শাস্তি গ্রহণ করিয়াছে।
রসিক ভট্টাচার্য মহেশ চৌধুরীর বন্ধু। সে বলিল, তুমি কি উন্মাদ মহেশ?
কাল-পরশু তোমার সঙ্গে ও বিষয়ে তর্ক করা যাবে, কেমন? বলিয়া মহেশ চৌধুরী শয়ন করিতে ভিতরে গেল।
যে দশ-বারজন উৎসাহী ও কৌতুহলী পরিচিত লোকের কাছে মহেশ চৌধুরী কথাগুলি বলিল, তারা তখন ডাকাইয়া আনিল বিভূতিকে। কি হইয়াছিল? সদানন্দকে সে কি অপমান করিয়াছিল? কেন অপমান করিয়াছিল? কি দিয়া সদানন্দ মহেশ চৌধুরীকে আঘাত করিয়াছে?
কিন্তু বিভূতি তেমন ছেলেই নয়, সে সংক্ষেপে শুধু বলিল, আমি কিছু জানি না। আপনারা এবার যান তো।
সকলে দয়া করিয়া তার বাড়িতে পায়ের ধূলা দিয়াছে, সকলকে বসাইয়া রাখিয়া বাড়ির ভিতরে যাইতে মহেশ চৌধুরীর কত সঙ্কোচ, কত আফসোস! আর তার ছেলে কিনা সোজাসুজি সকলকে বিদায় দিল! ছেলেটা সত্যই গোঁয়ার।
পরদিন অনেক দূরের গ্রামে পর্যন্ত এটিয়া গেল, ছেলেটাকে বাঁচাইতে গিয়া মহেশ চৌধুরী। সদানন্দের হাতে ভয়ানক মার খাইয়াছে। একটি টু শব্দও করে নাই মহেশ চৌধুরী, সদানন্দ মার বন্ধ করিলে রক্তাক্ত শরীরে সদানন্দের পায়ে মাথা ঠেকাইয়া ছেলের হাত ধরিয়া ঘরের বাহির হইয়া আসিয়াছে। ডাক্তার ডাকা হইয়াছিল, কিন্তু মহেশ চৌধুরী বলিয়াছে, প্রভুর প্রহারের চিকিৎসা ছি!
শেষ কথাটাতে সকলে যে কি মুগ্ধ হইয়া গেল বলিবার নয়। এমন ভক্তি মহেশ চৌধুরীর যে মার খাইয়া মরিতে বসিয়াছে তবু চিকিৎসা করিবে না–গুরু মারিয়াছে বলিয়া! সকলের কানে যেন বাজিল, মারলি মারলি কলসী-কানা, তাই বলে কি প্রেম দিব না?
না জানি কত বড় মহাপুরুষ সদানন্দ, যার জন্য মহেশ চৌধুরীর এমন অলৌকিক ভক্তিভাবের উদয় হইয়াছে, এমন মহৎ প্রেরণা আসিয়াছে। সদানন্দের উপর মানুষের ভক্তিশ্রদ্ধা যেন সভয় বিস্ময়ে হু হু করিয়া বাড়িয়া গেল। অনেকের মনে হইতে লাগিল, সদানন্দ হয়তো মানুষ নয়, মানুষের রূপধারী–
ফিসফিস করিয়া অন্তরঙ্গ মানুষের কানে কানেই শুধু কথাটা বলা যায়। কয়েকটি ভাঙা কুঁড়ের ভিতরে, গেঁয়ো পথের ধারে, কয়েকটি জমকালো গাছের ছায়ায় দেবতার আবির্ভাবের কথাটা কানাকানি হয়। অকাল-বার্ধক্যের ছাপমারা কয়েকটি ক্লিষ্ট মুখে উত্তেজিত আনন্দের বিস্ময়কর আবির্ভাব ঘটে।
কয়েকটা দিন একরকম একা একা ঘরের কোণে কাটাইয়া দিবার পর সদানন্দই প্রথম কথাটা পাড়ে। বলে, আমি বরং কোথাও চলে যাই মহেশ।
মহেশ চৌধুরী বলে, আর ও কথা কেন প্রভু? সে দিন তো ক্ষমা করেছেন, ও ব্যাপার তো চুকে গেছে?
চুকে গেছে বললেই কি সব ব্যাপার চুকে যায় মহেশ?
আজ্ঞে তা যায় বৈকি। আমরা এখন ভাবব ও ঘটনাটা যেন ঘটেই নি, মন থেকে একেবারে মুছে ফেলব। মনের বাইরে তো কোনো কিছুর জের চলতে পারে না প্রভু।
মাঝে মাঝে মহেশ চৌধুরী এমনভাবে কথা বলে, মনে হয় ঠিক যেন সদানন্দকে উপদেশ দিতেছে। প্রথম প্রথম সদানন্দ অতটা খেয়াল করিত না, আজকাল মন দিয়া শোনে। উপদেশের মতোই কথাগুলি সে গ্রহণ করে এবং পালন করিবার চেষ্টাও করে। মহেশ চৌধুরীর এখনকার উপদেশ, সেদিনকার ব্যাপারটা মন হইতে মুছিয়া ফেলিতে হইবে। কথায়, ব্যবহারে, এমন ভাব দেখাইতে হইবে, যেন কিছুই ঘটে নাই। ভাবিয়া চিন্তিয়া সদানন্দ সেই চেষ্টাই করে। কয়েকদিন গম্ভীর ও বিষণভাবে ঘরের কোনায় কাটাইবার পর হঠাৎ সেদিন হাসিমুখে গিয়া হাজির হয় সান্ধ্য মজলিসে।
সকলেই উপস্থিত আছে। বিভূতি এবং মাধবীলতাও। প্রথমটা সদানন্দের ভয় হয়, বিভূতি হয়তো রাগ করিয়া উঠিয়া যাইবে, হয়তো একটা কেলেঙ্কারি করিয়া বসিবে। মাধবীলতা হয়তো তেমন কিছু করিবে না, সে সাহস তার নাই, কিন্তু কথায় ব্যবহারে সহজ ভাব কি ফুটাইয়া তুলিতে পারিবে মেয়েটা? মহেশ চৌধুরী তো বলিয়া খালাস, সব চুকিয়া বুকিয়া গিয়াছে, কিন্তু ওদের দুজনের পক্ষে কি চুকিয়া বুকিয়া যাওয়া সম্ভব?
কিছুক্ষণ কাটিয়া যাওয়ার পর সদানন্দ বুঝিতে পারে, ব্যাপারটা সত্য সত্যই সকলে মন হইতে মুছিয়া ফেলিয়াছে যতটা মুছিয়া ফেলা সম্ভব। বিভূতি আর মাধবীলতা যে একটা সঙ্কোচ আর অস্বস্তি বোধ করিতেছে, প্রথমদিকে এটা পরিষ্কার বোঝা গিয়াছিল, কিছুক্ষণ পরে দুজনেই অন্যদিনের মতো সহজভাবে সকলের হাসি-গল্পে যোগ দিয়াছে।
সদানন্দের খুশি হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু মনটা তার হঠাৎ বড় খারাপ হইয়া গেল। আর একবার সে যেন মহেশ চৌধুরীর কাছে হারিয়া গিয়াছে। অতি শোচনীয় কুৎসিত পরাজয়। সেদিনকার ব্যাপারে মহেশ চৌধুরীর কাছে সে যে ছোট হইয়া গিয়াছে, আজ এই সান্ধ্য মজলিসে আসিয়া প্রথম সেটা সদানন্দের খেয়াল হইল।
তার মনে হইতে লাগিল, এই উদ্দেশ্যই ছিল মহেশ চৌধুরীর, তাকে হীন করার জন্যই সে হাতুড়ি দিয়া সেদিন নিজের মুখে আঘাত করিয়াছিল। এখনো মহেশ চৌধুরীর মুখ অল্প অল্প ফুলিয়া আছে–কি সাংঘাতিক মানুষ মহেশ চৌধুরী।