প্ৰাণ ধুকপুক করে না গণেশের।
বিস্ময় আর উত্তেজনা অভিভূত করে রাখে তাকে, আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়তে বুঝি খেয়ালও হয় না তার। বিশ-বাইশ বছর বয়সের জীবনে এমন কাণ্ড সে চোখে দেখে নি, মনেও। ভাবে নি। এত বিরাট, এমন মারাত্মক ঘটনা, এত মানুষকে নিয়ে। এ তার ধারণায় আসে না, বোধগম্য হয় না। তবু সবই যেন সে বুঝতে পারছে, অনুভব করছে, এমনিভাবে চেতনাকে তার গ্রাস করে ফেলেছে রাজপথের জনতা আর পুলিশের কাণ্ড। সে-ই যেন ভিড় হয়ে গেছে নিজে। ভিড়ে সে আটকা পড়ে নি, বন্ধ দোকানটার কোণে যেখানে সে দাঁড়িয়েছে যেখান থেকে পাশের সরু গলিটার মধ্যে সহজেই ঢুকে পড়তে পারে যখন ইচ্ছা হবে তার এখান থেকে সরে যেতে। কিন্তু যাবে কি, সে বাঁধা পড়ে গেছে আপনিই। জনতার গৰ্জনে, গুলির আওয়াজে, বুকে আলোড়ন উঠছে, চঞ্চল হয়ে উঠছে শিরার রক্ত। ভয় ভাবনা চাপা পড়ে গেছে আড়ালে। ভয়ে নয়, নিজেকে বাঁচাবার হিসাব কষে নয়, হাঙ্গামা থেকে তফাতে সরে যেতে হয় এই অভ্যস্ত ধারণাটি শুধু একটু তাগিদ দিচ্ছে পালিয়ে যাবার। কিন্তু সে জলো তাগিদ। হাঙ্গামা যে এমন অনড় অটল ধীরস্থির হয়, বন্দুকধারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে মানুষ এদিক-ওদিক এলোমেলো ছুটোছুটি করে না, এ তার ধারণায় আসে না। এ কেমন গণ্ডগোল যেখান থেকে কেউ পালায় না! তাই, চলে যাবার কথা মনে হয়, তার পা কিন্তু অচল। কেউ না পালালে সে পালাবে কেমন করে।
তা ছাড়া, মনে তার তীব্র অসন্তোষ, গভীর কৌতূহল। এমন অঘটন ঘটছে কেন, থেমে থাকছে কেন তার গায়ের পাশের হলদি নদীতে পূর্ণিমার কোটালের জোয়ার? দেড় ক্রোশ তফাতের সমুদ্র থেকে উন্মত্ত কোলাহলে ছুটে আসছে যে মানুষ-সমান উঁচু জলের তোড়, তা তো থামে না, কিছু তো ঠেকাতে পারে না তাকে। কত পূর্ণিমা তিথিতে অনেক রাতে সে চুপিচুপি কঁপ খুলে বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে মা-বাবাকে না জাগিয়ে, দাঁড়িয়ে থেকেছে ভাটার মরা নদীর ধারে কোটালের জোয়ারের রোমাঞ্চকর আবির্ভাবের জন্য।
দিনে ভাটার নদীর কাদায় শুয়ে কত কুমির রোদ পোহায়। দেখে মনে হয়, কত যেন নিরীহ ভালোমানুষ জীব। অল্প জলে হঠাৎ তীরের মতো কি যে তীব্র বেগে জলকে লম্বা রেখায় কেটে হাঙ্গর গিয়ে শিকার ধরে। কাদা-জলে লাফায় কত অদ্ভুত রকমের মাছ। কেমন তখন বিষণ্ণ হয়ে যায়। গণেশের মন। আহা দুঃখী নদী গো, হাঙ্গর কুমির মাছ মিলে কত জীব, তবু যেন জীবনের স্পন্দন নেই, ডাইনে-বায়ে যতদূর তাকাও ততদূর তক। এই নদীতে প্রাণ আসবে, স্বয়ং পাগলা শিবঠাকুর যেন আসছেন নাচতে নাচতে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড কাপিয়ে সাদা ফেনার মুকুট পরে, তেমনিভাবে আসবে। প্রাণের জোয়ার। গণেশের প্রাণেও আনন্দ এত, যা মাপা যায় না।
সেই অভ্যস্ত, পরিচিত, অতি ভয়ানক, অতি উন্মাদনায় কোটালের জোয়ার যদি মনে ধেয়ে এল গর্জন করে, গা ছেড়ে আসবার এতদিন পরে শহরের পথে সে জোয়ার থেমে গেল, বসে পড়ল ফুটপাতে পিচের পথে। এ কেমন গতিহীন গর্জন, সাদা ফেনার বদলে এ কেমন কালো চুলের ঢেউ।
গুলি লেগেছে নাকি? না লাঠি?
ওসমান জিজ্ঞেস করে গণেশকে দ্বিধা-সংশয়ের সুরে, গভীর সমবেদনায়। দোকানের কোণে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা, ঠিক কোথা থেকে রক্ত বেরিয়ে ভিজিয়ে লাল করে দিচ্ছে গায়ের ময়লা ঘেঁড়া ফতুয়াটা ঠিক বোঝা যায় না। গুলি যদি লেগেই থাকে, যেখানেই লেগে থাক, দাঁড়িয়ে আছে কি করে ছেলেটা, ফতুয়ার বুকের দিকটা যখন চুপসে যাচ্ছে রক্তে? চোখের চাউনিটা অদ্ভুত। মরা মানুষ যেন বেঁচে উঠে তাকিয়ে আছে বিহ্বলের মতো। কুলিমজুরিই সম্ভবত করে। মোটটা নামিয়ে রেখেছে।
আঁ? কি জানি বাবু। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ শোনায় গণেশের গলা, এরা এগোবে না বাবু?
বাবু! খচ্ করে একটু আঁচড় লাগে ওসমানের বুকে। কালিবুলি মাখা এই হাফশার্ট পরনে, রংচটা সুতোওঠা নীল প্যান্ট, পায়ে জুতো নেই, দাড়ি কামায় নি সাত দিন। তবু তাকে বাবু বলে ছেলেটা। ঘৃণ্য বাবু বলে গাল দেয়! ট্রামের কাজ ছেড়ে দেবার চলতি আফসোসটা আরেকবার নাড়া খায় ওসমানের। এ আফসোস তেজী হয়েছে ওসমানের গত ধর্মঘটের সাফল্যের পর। ট্রামের সেকেণ্ড ক্লাসেও কেউ কোনোদিন তাকে বাবু বলে অপমান করে নি।
তবে হ্যাঁ, এ ছেলেটা মুটে-মজুরি করে। গা থেকে এসেছে বোধহয় নেহাত পেটের খিদের তাড়নায়। ভিখারি আর মুটে-মজুর ছাড়া সবাইকে বাবু বলা অভ্যাস হয়ে গেছে।
এরা বসে দাঁড়িয়ে থাকবে বাবু? এগোবে না?
এবার ক্ষীণ শোনায় গণেশের গলা শ্লেষ্ময় আটকানো কাশির রোগীর গলার মতো, রক্তে আটকানো যক্ষ্মা রোগীর গলারও মতো।
এগোবে না তো কি? ওসমান মৃদু হেসে বলে, নিঃসংশয়ে। পিছু হটে ছত্ৰখান হয়ে পালিয়ে যখন যায় নি সবাই, লাইন ক্লিয়ার না পাওয়া ইঞ্জিনের মতো শুধু নিয়ম আর ভদ্রতার খাতিরে থেমে থেমে যুঁসছে এগিয়ে যাবার অধীরতায়, তখন এগোবে না তো কি! এগোবার কল টিপলেই এগোবে।
তবে কিনা–গণেশ জোরে বলবার চেষ্টা করে জড়িয়ে জড়িয়ে। দোকানের বিজ্ঞাপন আঁটা দেয়ালের গায়ে পিঠ ঘষড়ে সে নেমে যায় খানিকটা হাঁটু বেঁকে। পিঠ কুঁজো হয়ে মাথাটা ঝুলে পড়ে। যে বাড়ির কোণে ছোট একখানি ঘর তার পিছনে হেলান দেবার দোকান, সেই বাড়িরই উঁচু ভিতের বাঁকানো একটু খুঁজে না আটকালে সে হয়তো তখনি ফুটপাতে আশ্রয় নিত, আরো যে মিনিটখানেক পড়ে না গিয়ে আধ-খাড়া রইল তা আর ঘটত না।
কি বলছ?
ওসমান ঝুঁকে গণেশের মুখের যত কাছে সম্ভব মুখ নিয়ে যায়। শুনতে পায় শুধু গলার ঘর্ঘর ধ্বনি। সামনের লোকেরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, জমাট বাঁধা জনতাকেও চাপ দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। হাতখানেক জায়গা দিয়েছে গণেশকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবার।
রক্তমাখা জামাটা দুহাতে একেবারেই ছিঁড়ে ফেলে ওসমান। বুকে কোথাও ক্ষতের চিহ্ন নেই, একটাও ফুটো নেই। এক ফোঁটা রক্ত বেরোয় নি বুক থেকে ছেলেটার। জামাটা তবে ভিজল কি করে রক্তে?
না, বা গালটাতেও রক্তের চাপড়া পড়েছে বটে ছেলেটার। ঝাঁকড়া চুলের ভেতর থেকে রক্তস্রাব হচ্ছে। একরাশি ঘন রুক্ষ চুলের আড়ালে আঘাতটা লুকিয়ে আছে।
একে বাঁচানো উচিত, ওসমান ভাবে।
তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বাঁচতে পারে। হয়তো। ওসমান কি করে জানবে কিরকম আঘাত ওর লেগেছে। হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচবে কিনা শেষ পর্যন্ত ঠিক জানে না বটে ওসমান, কিন্তু এটা সে ভালো করেই জানে, হাসপাতালে পৌঁছতে দেরি হলে নিশ্চয় বাঁচবে না।
বাঁচাবার চেষ্টা করতে হবে ওকে। তাকেই করতে হবে। খুন যখন বেরিয়ে আসছে গলগল করে, তাকেই ছোকরা বার বার জিজ্ঞেস করেছে, এরা এগোবে না বাবু? শহীদ হবার আগে এই একটা জবাব শুধু চেয়েছে ছেলেটা তার কাছে। ওকে বাঁচাবার চেষ্টা না করলে চলে?
অ্যাম্বুলেন্স? মোড়ের মাথায় অ্যাম্বুলেন্স আছে, কজনে ধরাধরি করে তাড়াতাড়ি ওকে নিয়েও যাওয়া যায় ওখানে, জমাট বাঁধা ভিড় ফাঁক হয়ে গিয়ে তাদের পথ দেবে, ওসমান জানে। কিন্তু ওই অ্যাম্বুলেন্সের ব্যাপারও সে জানে। বিশেষত এ ছোকরা কুলির ছেলে। অ্যাম্বুলেন্সে চাকা ঘুরতে আরম্ভ করতে করতে এ খতম হয়ে যাবে। না, ও অ্যাম্বুলেন্সের ভরসা নেই ওসমানের।
রাস্তার ধারে দাঁড় করানো পুরোনো খোলা লরিটা আটকা পড়ে গিয়েছিল শোভাযাত্রায়। ওসমান উঠে দাঁড়িয়ে হাকে, লরি কার?
জিওনলাল বলে, আমার আছে।
ইস্কো জানের দায়িক তুমি, খোদা কম। জোরসে লে চল হাসপাতাল।
এক মুহূর্তেই ইতস্তত করে জিওনলাল বলে, লে আও।
ইঞ্জিনে স্টার্ট দিয়ে স্টিয়ারিং ধরে বসে ততক্ষণে কয়েকজনের সাহায্যে ওসমান লরিতে উঠে গণেশকে কোলে নিয়ে বসেছে।
মানুষের মধ্যে আটকা পড়েছিল লরিটা, দেখতে দেখতে এবার পথ সৃষ্টি হয়ে যায় তার জন্য, হুস করে লরি ঢুকে যায় পাশের গুলিতে।
সভায় যাবার ইচ্ছা আমার ছিল না, শোভাযাত্রায় যোগ দিতে আমি চাই নি। এটা তবে কি রকম ব্যাপার হল? হেমন্ত ভাবে।
নিজের ব্যবহার বড় আশ্চর্য মনে হয় হেমন্তের নিজেরই কাছে, বিশেষত নিজের মনের চালচলন। সভায় গিয়ে দাঁড়াবার খানিক পরেই মন যেন বিনা দ্বিধায় বিনা তর্কে কোনো বিচার বিবেচনা হিসাব নিকাশ না করেই বাতিল করে দিলে এতদিনকার কঠোরভাবে মেনে চলা রীতিনীতি। এত দিন ধরে যা সে যেভাবে ভেবেছে আজ যেন ওভাবে ওসব ভাববার দরকারটাই শেষ হয়ে গেছে একেবারে। একান্ত পালনীয় বলে যা সে কঠোর নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে এসেছে এতদিন, আজ তার বিরুদ্ধ আচরণে প্রবৃত্ত হয়েছে বলে বিচলিত হবার কিছু নেই, ক্ষোভের কারণ নেই।
এত সহজে কি করে মত বদলায় মানুষের, তার? এমন আচমকা কি করে নতুন মত মেনে চলা এমন স্বাভাবিক মনে হয় মানুষের, তার? অথবা আজকের এ ব্যাপারে মতামতের প্রশ্ন নেই, প্রতিদিনকার সাধারণ জীবনে যে মতামত নিয়মকানুন খাড়া করে চলা যায়, এই বিশেষ অবস্থায় সেসব বর্জন করে চলাই কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়? বাঁধা লেগে যায় হেমন্তের এসব চিন্তায়।
না, রাজনীতি বাজে নয়, তুচ্ছ নয় হেমন্তের কাছে। অত অন্ধকার নয় তার মন। বিশেষত এদেশের রাজনীতি স্বাধীনতার সংগ্রাম, বংশানুক্রমিক সুদীর্ঘ সগ্রাম। কিন্তু সবকিছুরই যেমন সময় আছে, বয়স আছে মানুষের জীবনে, রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় আছে, বয়স আছে। অতি ভালো কাজও অসময়ে করতে চাইলে অকাজ হয়ে দাঁড়ায়, ফল হয় খারাপ। নিজের যা কর্তব্য। সেটুকু ভালোভাবে পালন করতে পারাই সার্থকতার রীতিনীতি, নিয়ম।
সভার একপাশে জায়গা নিয়ে দাঁড়াবার সময়ও বিশ্বাস তার দৃঢ় ছিল–রাজনৈতিক সভায় যোগ দেওয়া কোনো ছাত্রের উচিত নয়। ছাত্রজীবনে রাজনীতির স্থান নেই। লেখাপড়া শিখে মানুষ হবার সময় হাতে-কলমে রাজনীতি চর্চা করা তাস পিটে আড্ডা দিয়ে হৈচৈ করে সময় আর এনার্জি নষ্ট করার মতোই অন্যায়। ছাত্রের কাছে রাজনীতি শুধু অধ্যয়নের বিষয়, কোলাহলমত্ততা, দলাদলি, সংঘাত থেকে দূরে থেকে শান্ত সমাহিত চিত্তে তাপসের সংযত শোভন জীবনযাপন করবে ছাত্র।
সভায় তবে সে কেন থাকে, কি করে থাকে? শোভাযাত্রায় যোগ দেয়, ফুটপাতে বসে পড়ে যতক্ষণ দরকার বসে থাকার সঙ্কল্প নিয়ে? মত তার বদলায় নি, বিশ্বাস শিথিল হয় নি। জোরের সঙ্গে স্পষ্টভাবে শুধু মনে হয়েছে আজ এই বিশেষ অবস্থায় তার মত বা বিশ্বাসের কোনো প্রশ্ন আসে না, ওসব বিষয় বিবেচনা করার সময় এটা নয়। অন্য সময় যত খুশি নিষ্ঠার সঙ্গে ওসবের মর্যাদা রেখে চললেই হবে, এখন নয়। এখন যা করা উচিত, তার মতো হাজার হাজার সাধারণ মানুষ মিলে যা করছে, তাকেও তাই করতে হবে। তাতে সংশয়ের কিছু নেই, তর্ক নেই।
একটু কৌতূহলের বশে হেমন্ত সভায় দাঁড়িয়ে ছিল। এত সীমাহীন দলাদলি, এমন কুৎসিত আত্মকলহ যাদের মধ্যে, তারা কি করে এক সাথে মিশে সভা করে একটু দেখবে। ছেলেদের বড় একটা অংশ গোল্লায় গেছে। শুধু হৈচৈ, গুণ্ডামি, সিগারেট টানা, মেয়েদের পেছনে লাগা, শেষে পরীক্ষার হলে চুরি-চামারি, গার্ডের সঙ্গে মারামারি, গার্ডকে খুন করা। এ অধঃপতনের কারণ সে জানে। রাজনৈতিক মত্ততা এই নৈতিক অধঃপতনের জন্য দায়ী। তার মতকেই সমর্থন করে ছেলেদের মধ্যে এই মারাত্মক দুর্নীতির প্রসার নিজের কাজকে অবহেলা করে অকাজ নিয়ে মেতে থাকলে এরকম শৈথিল্য আসতে বাধ্য, ছাত্রই হোক আর যাই হোক তাদের মধ্যে। নিয়মানুবর্তিতাকে চুলোয় পাঠিয়ে, লেখাপড়া তাকে তুলে হৈচৈ-হাঙ্গামা নিয়ে মেতে থাকার জন্য রাজনীতি চর্চার চেয়ে ভালো ছুতো আর কি হতে পারে?
উচ্ছঙ্খলায় কি মিল হয়? কি মানে সে মিলের?
শীতের তাজা রোদে উজ্জ্বল দিন। কি তাজা দেখাচ্ছে এদের মুখগুলি, কত উজ্জ্বল সকলের দৃষ্টি! দুঃখ বোধ করেছিল হেমন্ত। অপচয়ে ক্ষয়ের চাপ পড়ে না, ভ্রান্ত আদর্শ কাবু করে না, এমন যে অফুরন্ত তরুণ প্রাণশক্তি আর বিশ্বাস, তার কি শোচনীয় অপব্যবহার! একবার ভেবেছিল হেমন্ত, চলে যায়। কি হবে এদের গরম গরম চিৎকার শুনে? আর যদি মতভেদ ঘটে, বাদানুবাদ হয়, হাতাহাতি মারামারি আরম্ভ হয়ে যায়, আরো তখন বেশি খারাপ হয়ে যাবে মনটা নিজের চোখে সব দেখে। তার চেয়ে কাল খবরের কাগজে পড়লেই হবে কি হল না হল সভায়।
কিন্তু চলে যেতে সে পারে নি।
প্রদীপ্ত মুখগুলি, নির্ভীক চোখগুলি আশপাশের ছাড়া-ছাড়া কথা ও আলোচনার টুকরোগুলি, সমস্বরে শ্লোগান উচ্চারণের ধ্বনিগুলি আর অনুভূতির এক অদ্ভুত দুরন্তপনা তাকে আটকে রেখেছে।
বক্তৃতা যারা দিয়েছে তাদের মধ্যে তিনজন হেমন্তের চেনা। বুকের মধ্যে তোলপাড় করেছে। তার, খানিক বক্তৃতা শুনে বাকিটা এই তিনজন চেনা ছাত্রের নতুন পরিচয় আবিষ্কার করার বিস্ময় ও উত্তেজনায়। চোখে দেখে কানে শুনেও অবিশ্বাস্য, অসম্ভব মনে হয় এখানে ওদের উপস্থিতি, আন্দোলনে অংশগ্রহণ! বিশেষভাবে শুদ্ধসত্ত্বের–যার সঙ্গে পাল্লা দিতে হওয়ায় গত পরীক্ষায় সে অনার্সে প্রথম স্থানটি পায় নি বলে আজো তার বুকে ক্ষোভ জমা হয়ে আছে। আনোয়ার ও শিবনাথের পরীক্ষার ফলও তো কত ভালো ছেলের বুকে ঈর্ষার আগুন জ্বলে দিয়েছে। ওরা রাজনীতিও করে আবার শান্তশিষ্ট ভদ্র হয়ে থাকে, ছাত্রজীবনে সাংস্কৃতিক সব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে, পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো করে কি করে?
মাকে মনে পড়ে হেমন্তের। সীতাকেও। এইখানে এভাবে তাকে পুলিশের লাঠি ও গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে বসে থাকতে দেখলে মার মুখের ভাব কিরকম হত ভাবতে গিয়ে কল্পনায় যেন কিছুতেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে চায় না মার মুখখানা, বড় বড় চোখের আতঙ্ক-বিহ্বলতার আড়ালে মুখের বাকি অংশ ঝাপসা হয়ে থাকে। আজ এত দিন পরে মার কাছে তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হল–একেবারে চরমভাবে। রাজনীতি মাথায় ঢুকলে পড়াশোনায় তার অবহেলা আসবে, সে মানুষ হবে। না, হয়তো জেলেও যেতে হবে তাকে ছমাস এক বছরের জন্য, এই হল মার ভয়, দুর্ভাবনার সীমা। মরণের সামনে সে যে মুখোমুখি দাঁড়াবে কোনোদিন আজকের মতে, এ কথা মা বোধহয় স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি কোনোকালে। রাজনৈতিক সভায় পর্যন্ত কখনো যাবে না বলে যে ছেলে কথা দিয়েছে আর সে কথা পালন করে এসেছে এত দিন অক্ষরে অক্ষরে, তার হঠাৎ এমন মতিভ্ৰম হবে যে সভা থেকে শোভাযাত্রায় যোগ দিয়েও যথেষ্ট হয়েছে মনে না করে হাঙ্গামার মধ্যে খুন। হবার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে, এ কথা জানলে রক্ত বোধহয় হিম হয়ে যাবে মার।
সে সিগারেট খেতে আরম্ভ করবে এই ভয়ে মার বুক কঁপে!
কাল জোর করে তার হাতে একটা সিগারেট খুঁজে দিয়েছিল পঙ্কজ, বলেছিল, ওগো ভালো ছেলে, একটু ধোঁয়া দাও বুদ্ধির গোড়ায়, বুদ্ধি সাফ হবে। সীতা তাকে ভালো ছেলে বলে ডাকে, বন্ধুরা ডাকটা লুফে নিয়েছে। সিগারেট হেমন্ত খায় না, পান-সুপারির নেশাটুকু পর্যন্ত তার নেই। সিগারেটটা সে পকেটে রেখে দিয়েছিল। ভাত খেয়ে জামা পরে বেরোবার সময় পকেটের সিগারেটটা হাতে লাগায় কেন, কি খেয়াল জেগেছিল তার সে নিজেই জানে না, দেশলাই খুঁজে এনে সিগারেটটা ধরিয়েছিল কাঠের চেয়ারে আরাম করে বসে। পঙ্কজের অনুকরণে টান দিয়েই কাশতে কাশতে সিগারেটটা সে ছুড়ে দিয়েছিল ঘরের কোনায়, সেখানে সেটা পুড়ছিল। মাথা ঘুরে ওঠায় একটু সামলে নেবার জন্য চেয়ারেই বসেছিল হেমন্ত।
ঘরে ঢুকে সিগারেটের গন্ধ নাকে যেতেই মা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন। শূন্য ঘর দেখেও তিনি। যে ব্যাকুল দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক খুঁজছিলেন, হেমন্ত টের পেয়েছিল। অন্য যে কোনো একজন লোক ঘরে থাকলে মা সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তি পেতেন, নিশ্চিন্ত হতেন।
বেরোস নি?
কত চেষ্টায় মা গলা কাঁপতে দেন নি, সহজভাবে কথা বলেছেন, বুঝতে পেরেছিল হেমন্ত।
এই বেরোব এবার। জল দাও তো একটু।
হেমন্ত জল খেয়ে গেলাস নামিয়ে রাখার পরও মা সোজাসুজি সিগারেটের কথা তুলতে পারেন। নি। জিজ্ঞেস করার অদম্য ইচ্ছা জোর করে চেপে রেখেছিলেন হেমন্ত কি জবাব দেবে এই ভয়ে। যদি সে বলে বসে, হ্যাঁ, সিগারেট সে ধরেছে। যদি সে রাগ করে সামান্য সিগারেট খাওয়া নিয়ে পর্যন্ত তাঁর চেচোনিতে তার বয়সের কোন্ ছেলেটা না সিগারেট খায়? আর ভীরু করুণ দৃষ্টি শুধু বার বার গিয়ে পড়ছিল ঘরের কোনায় জ্বলন্ত সিগারেটটার দিকে, হেমন্তের মুখে বুলিয়ে নিয়েই চোখ নত করছিলেন।
তারপর হঠাৎ সেই চোখ ভরে গিয়েছিল জলে। হেমন্ত তখন ব্যস্ত হয়ে বলেছিল, কাঁদতে আরম্ভ করে দিলে মা? সিগারেট আমি খাই না, তোমার ভাবনা নেই। পঙ্কজ একটা সিগারেট দিয়েছিল, হঠাৎ কি শখ হল, ধরিয়েছিলাম। খেতে পারি নি, তাই ফেলে দিয়েছি।
ও! বলে মা নিশ্চিন্ত হয়ে মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন, বলেছিলেন, কেন কেঁদেছি শুনবি হেমা? তুই সিগারেট খাস ভেবে নয়, আমায় লুকিয়ে খাস ভেবে, খাওয়া অন্যায় জেনে খাস ভেবে। আমি মনে করলাম, আমায় আসতে দেখে তুই তাড়াতাড়ি সিগারেটটা ফেলে দিয়েছিল। নইলে সিগারেট খাওয়া দোষের নয় বুঝে তুই যদি খাস হেমা, খেতে ইচ্ছা হলে—
আঁচল দিয়ে চোখের জলের সঙ্গে মুখের হাসিটুকুও যেন মা মুছে নিয়েছিলেন।
এখন আর ভাবনার কিছু নেই তো?
এমনি করেই কিন্তু হ্যাবিট জন্মায় হেমা, ইচ্ছা না থাকলেও।
মার কথা ভেবে মায়া বোধ করে হেমন্ত, কিন্তু কেমন এক বৈরাগ্য মিশে সে মায়াববাঁধের ব্যাকুলতা আর উদ্বেগকে নিরস্ত করেছে এখন। মাকে মনে হচ্ছে দূরে, বহু দূরে। এখান থেকে ট্রামে বাড়ি যেতে সময় লাগে মোটে মিনিট পনের, সেখানে মা হয়তো আকুল হয়ে আছেন। তার জন্য, কিন্তু বিরাট এক বাস্তব সত্য যেন দুস্তর ব্যবধান রচনা করে দিয়েছে রাজপথের এই শক্ত ফুটপাত আর মায়ের অগাধ স্নেহ, অসীম শুভ কামনা অনন্ত দুর্ভাবনা ভরা সেই নীড়ের মাঝখানে, শান্তি আর যুদ্ধের সময়কার জগতের মতো অতি ঘনিষ্ঠ অথচ অসীম দূরত্ব ও পার্থক্যের ব্যবধান।
এখন কি যেতে পারে না সে বাড়ি ফিরে? একেবারে প্রথম দিনের পক্ষে এই কি যথেষ্ট হয় নি, আজ আর নাইবা এগোল? নিজের মনেই মাথা নাড়ে হেমন্ত।
একা উঠে চলে যাওয়া যায় না একার প্রয়োজনে। না এলে ভিন্ন কথা ছিল, এখন আর ফিরে যাওয়া চলে না। তার না হয় মার জন্য অবিলম্বে বাড়ি ফেরা একান্ত দরকার, একা হলে আরও না হয় সে মেনে নিত সেজন্য নিজের কাছে অপমানে নিজে কালো হয়ে গিয়ে, কিন্তু এদের সকলকে হার মানাবার অধিকার তো তার নেই। সে উঠে গেলে আর একজন দুজনও যদি তার অনুসরণ করে?
সীতাকেও মনে পড়ে হেমন্তের।
মার মতোই তাকেও মনে হয় বহু দূর, কুয়াশাচ্ছন্ন। মার মতো বড় বড় চোখ নেই সীতার, তাই বোধহয় চোখ দুটি পর্যন্ত তার কল্পনার সীমান্তে সরে গেছে ধারণা হয়। সীতার মৃদু ও তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ, আচমকা ঘনিয়ে আসা গাম্ভীর্য, তিক্ত বিষাদ আর কটু অনুকম্পা ভরা কথা এবং কদাচিৎ হেমন্ত যে কোন শ্রেণীর জীব ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারছে না এমনি বিব্রত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা, এসব যেন প্রায় ভুলে যাওয়া অতীতের স্মৃতিতে পরিণত হয়ে গেছে, এসবের জন্য যে প্রতিক্রিয়া জাগত নিজের মধ্যে তাই যেন হেমন্তের অবলম্বন।
অথচ, আজকেই দেখা হয়েছিল সীতার সঙ্গে।
এস ভালো ছেলে বলে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল সীতা। বলেছিল, ক্লাস হল না বলে কষ্ট হচ্ছে? মন খারাপ? কি করব বল! সবাই তো বিদ্যালাভ করেই খুশি থাকতে পারে না, অন্যায়-টন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে চায়।
আজ যেন রীতিমতো ঝাজ ছিল সীতার কথায়, শুধু ব্যঙ্গাত্মক খোঁচা নয়। হেমন্তের মনে হয়েছিল, সে যেন শেষ পর্যন্ত সন্দিহান হয়ে উঠেছে তার মনুষ্যত্ব সম্বন্ধে। তার সঙ্গে মতে না মিলুক, তার নিরুত্তাপ রক্ষণশীল মতিগতিকে অবজ্ঞা করুক, তার একাগ্র নিষ্ঠা, নিরুপদ্রব সহনশীলতা, দুঃখী মায়ের জন্য তার ভালবাসা, এসবের জন্য খানিকটা শ্ৰদ্ধা তাকে সীতা বরাবর দিয়ে এসেছে। আজ যেন সে শ্ৰদ্ধাও সে রাখতে পারছে না মনে হয়েছিল হেমন্তের, তাকে যেন সহ্য করতে পারছে না সীতা।
অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিত বৈকি।
তবে?
বিদ্যালাভে অবহেলা করাও অন্যায়, অন্যায় সহ্য করাও অন্যায়।
তবে?
তখন হেমন্ত বুঝেছিল সীতার জ্বালার মর্ম। কিছু না বলেও সীতা তাকে প্রশ্ন করেছে, আজো তুমি নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবে তোমার আদর্শবাদী সুবিধাবাদের আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার অজুহাতে? আজো তুমি এটুকু স্বীকার করবে না যে শিক্ষার্থীকেও আজ অন্তত ভাষায় ঘোষণা করতে হবে এ অন্যায়ের দেশব্যাপী প্রতিবাদকে সে সমর্থন করে, সেটা রাজনীতিচর্চা হোক বা না হোক?
জবাব দিতেই হবে সীতার এই অনুচ্চারিত প্রশ্নের। গভীর বিষাদ অনুভব করেছিল হেমন্ত। সীতা কি বুঝবে তার কথা?
আমার কি মুশকিল জান সীতা? হেমন্ত ভূমিকা করেছিল, আমি সিরিয়াসলি কথা বললেও তুমি সিরিয়াসলি নিতে পার না।
কথা! তোমার শুধু কথা!
তা ছাড়া কি করার আছে? প্রতিবাদ যে জানানো হবে, তাও তো কথাতেই?
তখন কি হেমন্ত জানত মৰ্মে মর্মে উপলব্ধি করা কথা কত সহজে কি অনিবার্যভাবে কাজে রূপান্তরিত হতে পারে? কণ্ঠের প্রতিবাদ পরিণত হতে পারে জীবনপণ ক্রিয়ায়!
সীতা চুপ করে থাকায় আবার সে বলেছিল, কথাকে অত তুচ্ছ কোরো না সীতা। মানুষ বোবা হলে পৃথিবীটা অন্য রকম হত। ও সব বড় দার্শনিক কথায় যাব না। আমার কথাটা মন দিয়ে। শুনবে কি শান্ত হয়ে? তুমি তো জান, আমি যা বলি তাই করি। কথার প্যাচও কষি না, ফঁকিবাজি কথাও বলি না।
শুনি তোমার কথা।
তুমি কি বুঝবে আমার কথা?
পারবে বুঝিয়ে দিতে?
অতি বিশ্ৰী, অতি নীরস নীরবতা এসেছিল কিছুক্ষণের।
সাহস সঞ্চয় করে হেমন্ত বলেছিল তারপর, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে নিশ্চয়, কিন্তু তারও তো নিয়ম আছে, যুক্তি আছে? ধর তুমি আমার সঙ্গে আছ, কেউ তোমায় অপমান
করল। তখন সোজাসুজি ঘুসি মেরেই আমি সে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাব।
সে এক পুরোনো ঘটনা। আজকের বক্তব্য বুঝিয়ে দেবার জন্য তার সেই বীরত্বের ইঙ্গিত সে কেন করেছিল হেমন্ত জানে না। এই উদাহরণ দিয়ে তার বক্তব্য খুব সহজে স্পষ্ট ও পরিষ্কার করে। বলা যেত বটে কিন্তু সেটা অন্য ভাবেও বলা যেত।
আমি ভুলি নি ভালো ছেলে। কৃতজ্ঞ আছি।
সেজন্য তুলি নি কথাটা হেমন্তকে বলতে হয়েছিল চাবুকের জ্বালা হজম করে, আমার কথা শুনলেই বুঝতে পারবে। এ ক্ষেত্রে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা কর্তব্য ছিল, করেছিলাম। পরাধীন। দেশে হাজার হাজার অন্যায় চলে, তার প্রতিবাদ করতে গেলে আমি দাঁড়াই কোথায়? দেশে চল্লিশ কোটি লোক, তার মধ্যে আমরা কজন লেখাপড়া শিখছি তুমি জান। এ ক্ষেত্রে আমাদের ভালো করে লেখাপড়া শেখাটাই কার্যকরী প্রতিবাদ, লড়াই করা। শিক্ষিত লোকের কত দরকার দেশে, আমরা সামান্য যে কজন সুযোগ পেয়েছি, তারা নাই-বা গেলাম হৈচৈয়ের মধ্যে?
সীতার চাউনিতে বোধহয় ঘূণাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
সব কিছু থেকে ওভাবে গা বাঁচিয়ে কারা লেখাপড়া শেখে জান ভালো ছেলে? দেশের প্রয়োজন, দেশের কথা যারা ভাবে তারা নয়, পাস করে পেশা নিয়ে নিজে আরামে থাকার কথা যারা ভাবে তারা। স্বদেশী মার্কা মালিকের পাপের ছুতো যেমন এই যুক্তি যে ইণ্ডাষ্ট্ৰিতেই দেশের উন্নতি, তোমাদের যুক্তিটাও তাই। ছাত্র আন্দোলন যারা করে তোমার চেয়ে তারা ভালো করে লেখাপড়ার দরকার বোঝে। তারাই জোর করে বলে ছাত্রদের, ডিসিপ্লিন বজায় রাখা প্রথম কর্তব্য। ছাত্রের, শিক্ষার যতটুকু সুযোগ আছে প্ৰাণপণে তা গ্রহণ করতে হবে প্রত্যেক ছাত্ৰকে, পরীক্ষায় পাস করাটা মোটেই অবহেলার বিষয় নয়। তাই বলে জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে তাদের কোনো যোগ থাকবে না? তারা প্রকাশ করবে না তাদের রাজনৈতিক মতামত, সংঘবদ্ধ হবে না তাদের দাবি, তাদের ক্ষোভ, তাদের দেশপ্রেমের প্রকাশকে জোরালো করে তুলতে?
তার ফল তো দেখতে পাচ্ছি ছাত্রজীবনে।
তার ফল? ছাত্রদের মধ্যে দলাদলি বেড়েছে, দুৰ্ম্মতি বেড়েছে? সেটা কিসের ফল হেমন্ত? দেশকে ভালবাসার, স্বাধীনতা দাবি করার, ছাত্রদের এক করার আন্দোলন চালানো, এ সবের ফল? তলিয়ে যা বোঝবার চেষ্টা পর্যন্ত কর না, কেন তা নিয়ে তর্ক কর? খারাপটাই দেখছ, অথচ তার কারণ কি বুঝতে চাও না, মনগড়া কারণ, মনগড়া দায়িক খাড়া করে তৃপ্তি পাও–আমার কথাই ঠিক! ভালো লক্ষণগুলি তো চোখেই পড়ে না।
সে আমার দোষ নয় সীতা। খারাপ লক্ষণগুলিই চোখে পড়ে, ভালোগুলি পড়ে না, তার সোজা মানে এই যে ভালো লক্ষণ বিশেষ নেই চোখে পড়বার মতো।
তুমি আজ এস হেমন্ত।
রাগে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল হেমন্তের চিন্তা, জ্বালা ধরে গিয়েছিল বুকে। কিন্তু সে অল্পক্ষণের জন্য। সীতা তাকে শুধু সহ্যই করে এসেছে চিরকাল, আজ তার সেই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল, এটা বিশ্বাস করা কঠিন হেমন্তের পক্ষে। সীতা চায়ও না চোখ-কান বুজে সে তার মতে সায় দিক, তার কথা মেনে নিক। মতের বিরোধ তাদের আজকের নয়, অনেকবার তাদের কথা কাটাকাটিতে যে উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে তার তুলনায় আজকের তর্ক তাদের খুব ঠাণ্ডাই হয়েছে বলতে হবে। কেন তবে সে অসহ্য হয়ে উঠল আজ সীতার কাছে? এমন কোনো সিদ্ধান্তে কি সীতা এসে পৌঁছেছে তার সম্বন্ধে যার পর তার সঙ্গে ধৈর্য ধরে কথা বলা আর সম্ভব হয় না? বুদ্ধি দিয়ে কথাটা বোঝবার চেষ্টা করছিল হেমন্ত, কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি। তখন হাল ছেড়ে দিয়ে ভেবেছিল, অত জটিলতার মধ্যে যাবার তার দরকার কি? মনটা হয়তো ভালো ছিল না সীতার কোনো কারণে। মেজাজটা হয়তো বিগড়েই ছিল আগে থেকে। মন কি ঠিক থাকে মানুষের সব সময়!
সীতার তীব্র বিরাগের রহস্য যেন একটু স্বচ্ছ হয়েছে এখন। দুটো-একটা ইঙ্গিত জুটেছে রহস্যটা আয়ত্ত করার। কতকগুলি বিষয়ে বড় বেশি সে গোড়া হয়ে পড়েছিল সন্দেহ নেই। পৃথিবীটা সত্যই অনেক বদলে গেছে। কল্পনাতীত ঘটনা সত্য সত্যই আজ ঘটছে তারই চোখের সামনে; দেশের মানুষের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে, ছেলেদের মধ্যেও। নতুন ভাব, নতুন চিন্তা, নতুন আদৰ্শ, নতুন উদ্দীপনা এসেছে নতুন চেতনার লক্ষণ মোটই আর অস্পষ্ট নয়। তারই শুধু এসব চোখে পড়ে নি। নিজের পুরোনো ধারণা, পুরোনো বিশ্বাসের স্তরেই সে ধরে রেখেছিল দেশকে চোখ-কান বুজে, ভেবেছিল তার মন এগোয় নি বলে দেশটাও পিছনে পড়ে আছে তারই খাতিরে!
এই গোঁড়ামি সহ্য হয় নি সীতার। মতের অমিলকে সীতা গ্রহণ করতে পারে সহজ উদারতায়, অন্ধ গোঁড়ামি তার ধৈর্যে আঘাত করে।