উদ্ধার পর্ব ৩০ প্রবাহ

তমোময়ী নিশা, কাহাকে হাসাইয়া, কাহাকে কাঁদাইয়া, কাহারো সর্বনাশ করিয়া যাইবার সময় স্বাভাবিক হাসিটুকু হাসিয়া চলিয়া গেল। মোহাম্মদ হানিফার শিবিরে ঈশ্বর উপাসনার ধুম পড়িয়া গেল। নিশার গমন, দিবাকরের আগমন-এই সংযোগ বা শুভসন্ধি সময়ে, সকলের মুখে ঈশ্বরের নাম-সেই অদ্বিতীয় দয়াল প্রভুর নাম-নূরনবী মোহাম্মদের নাম সহস্র প্রকারে সহস্র মুখে। নিশার ঘটনা, নিশাবসান না-হইতেই গাজী রহমান প্রধান প্রধান যোধ ও মোহাম্মদ হানিফার নিকট আদ্যন্ত বিবৃত করিয়াছেন। সকলেই বন্দিগণকে দেখিতে সমুৎসুক।
আজ প্রত্যূষেই দরবার আড়ম্বরশূন্য। রাজদরবারে, সম্পূর্ণ ভ্রাতৃভাবে-ভ্রাতৃব্যবহারে-পদগৌরবে কেহই গৌরবান্বিত নহেন-সকলেই ভাই, সকলেই আত্মীয়, সকলেই সমান। ক্রমে ক্রমে সকলেই আসিলেন। মোহাম্মদ হানিফা, গাজী রহমান, মস্‌হাব কাক্কা প্রভৃতি এবং প্রধান প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ সকলেই আসিয়া সভায় যোগ দিলেন।

ক্ষণকাল পরে একজন বন্দি সৈন্যবেষ্টিত হইয়া সভামধ্যে উপস্থিত হইল।

গাজী রহমান গাত্রোত্থান করিয়া বলিলেন, “আপনি যেই হউন, মিথ্যা কথা বলিয়া পাপগ্রস্ত হইবেন না, এই আমার প্রার্থনা।”

বন্দি বলিলেন, “আমি মিথ্যা বলিব না।”

“সুখী হইলাম। আপনি কোন্ ধর্মে দীক্ষিত?”

“আমি পৌত্তলিক।”

“আপনার ধর্মে অবশ্যই আপনার বিশ্বাস আছে?”

“বিশ্বাস না থাকিলে ধর্ম কী?”

“মিথ্যা কথা কহা যে মহাপাপ, সকল ধর্মই তাহার সাক্ষ্য দিতেছে। বলুন তো? কি উদ্দেশ্যে নিশীথ সময়ে এ শিবির দিকে আসিতেছিলেন?”

“সন্ধান লইতে।”

“কী সন্ধান?”

“শত্রু-শিবিরে যে সন্ধান পাওয়া যায়, সেই-ই ভাল।”

“আপনি কি এজিদ্-পক্ষীয়?”

“আমি দামেস্ক মহারাজের সেনাপতি। আমার নাম ওত্‌বে অলীদ।”

“ভাল কথা, কিন্তু আমার-”

“আর বলিতে হইবে না, আমি বুঝিয়াছি। আপনার সন্দেহ এখনই দূর করিতেছি। আমরা ছদ্মবেশী হইয়া আসিয়াছিলাম, এই দেখুন-উপরিস্থ এ বসন কৃত্রিম।”

ওত্‌বে অলীদ কৃত্রিম বসন পরিত্যাগ করিলেন। কারুকার্যখচিত সৈন্যাধ্যক্ষের বেশ-দোলায়মান অসি বাহির হইল। সভাস্থ সকলে স্থির চক্ষে অলীদের আপাদমস্তকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন।

গাজী রহমান পুনরায় বলিলেন, “আপনি আমাদের মাননীয়। আপনার নাম আমরা পূর্বেই শুনিয়াছি। আপনার অনেক বিষয় আমরা জ্ঞাত আছি। আপনি অতি মহৎ! সেই মহৎ নাম যাহাতে রক্ষা পায়, তাহার মত কার্য করিবেন।”

“বলুন! আমি যখন বন্দি, আমার জীবন আপনাদের হস্তে, এ অবস্থায় আমার নিজের কি ক্ষমতা আছে যে তদ্দ্বারা আমি আমার মহত্ত্ব রক্ষা করিব। অলীদ এখন আপনাদের আজ্ঞানুবর্তী, আপনাদের দাস।”

“যেমন শুনিয়াছিলাম, তেমনই দেখিলাম। আপনার জীবন যখন আমাদের হস্তে ন্যস্ত করিলেন, আর কোন চিন্তা নাই। ঈশ্বর আপনার সেই মহত্ত্ব, সেই মান, সম্ভ্রম, জীবন সকলই রক্ষা করিবেন। আপনি আমাদের সকলের পূজনীয়।”

“আমি ভ্রাতৃভাবে পরাভব স্বীকারে এই তরবারি রাখিলাম। এ জীবনে আপনাদের বিনা অনুমতিতে এ হস্তে আর অস্ত্র ধরিব না, এই রাখিলাম!”

অলীদ গাজী রহমানের সম্মুখে অস্ত্র রাখিয়া দিল। গাজী রহমান বিশেষ আগ্রহে ওত্বে অলীদকে আলিঙ্গন করিলেন এবং সমাদরে উপযুক্ত স্থানে বসাইয়া পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার সঙ্গীদ্বয়ের পরিচয় কি?”

“দুইজনের মধ্যে একজন আমার সঙ্গী, অপর একজনকে আমি চিনি না। যিনি আমার সঙ্গী, তাঁহার পরিচয় তিনিই দিবেন। যদি তাঁহার কোন কথায় সন্দেহ হয়, আমাকে জিজ্ঞাসা করিলে, আমি যাহা জানি অবশ্যই বলিব।”

গাজী রহমানের ইঙ্গিতে দ্বিতীয় বন্দি (মারওয়ান) প্রহরী-বেষ্টিত হইয়া সভামণ্ডপে উপস্থিত হইল। সভাস্থ সকলের চক্ষু দ্বিতীয় বন্দির প্রতি, বন্দির চক্ষুও সকলের প্রতি। বন্দি চতুর্দিকে চাহিয়া দেখিল, শান্তভাব; রোষ, ঘৃণা, অবজ্ঞার চিহ্নের নামমাত্র সভায় নাই। পদমর্যাদার গৌরব, ক্ষমতার ন্যূনাধিক্য পরিচ্ছদের জাঁকজমক, উপবেশনের ভেদাভেদ, কিছুমাত্র সভায় নাই। সকলেই এক, সকলেই সমান, সকলেই ভ্রাতা। ভ্রাতৃভাব মূলমন্ত্রে ইহারাই যেন যথার্থ দীক্ষিত। দেখিল সভাস্থ প্রায়ই তাহার অপরিচিত। ক্রমে সকলের চক্ষুর সহিত তাহার চক্ষুর মিলন হইল। আক্কেল আলীর (বাহরাম) প্রতি চক্ষু পড়িতেই রোষের সহিত ঘৃণা, উভয়ে একত্র মিশিয়া চক্ষুকে অন্যদিকে ফিরাইয়া দিল। সেদিকে চাহিতেই দেখিল, তাঁহারই প্রিয় সহচর অলীদ ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়া হানিফার দলে মিশিয়াছেন।

মারওয়ান মনে মনে আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিল, “এ কী কথা! বেশ পরিত্যাগ-দলে আদৃত-অস্ত্র সভাতলে-এ কী কথা!”

অলীদের প্রতি বারবার চাহিতে লাগিল। কিন্তু বীরবরের বিশাল চক্ষু অন্যদিকে,-সে চক্ষু মারওয়ানের মুখ আর দেখিতে ইচ্ছা করিল না। মারওয়ান কি করিবে, কোন উপায় নাই, যেদিকে দৃষ্টি করে, সেইদিকেই সহস্র প্রহরী। সেইদিকেই সহস্র শাণিত অস্ত্রের চাক্চিক্য!
মনে মনে বলিল, “তবে কি আর শিবিরে যাইতে পারিলাম না? তবে কি আর মহারাজের সহিত দেখা হইল না? হায়! হায়! তবে কি দামেস্কের স্বাধীনতা-”

মারওয়ানের মনের কথা শেষ না-হইতেই গাজী রহমান জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়, আপনি কোন্ ধর্মাবলম্বী?”

“ধর্মের পরিচয়ে আপনার প্রয়োজন কি?”

“প্রয়োজন এমন কিছু নহে, তবে মোহাম্মদীয় হইলে আপনি অবধ্য, সহস্র প্রকারে আমাদের অনিষ্ট-চেষ্টা করিলেও আপনি ভ্রাতা-এক প্রাণ,-এক আত্মা, এক হৃদয়।”

“আমি মোহাম্মদের শিষ্য।”

“মিথ্যা কথায় কী পাপ তাহা বোধ হয় আপনার অজানা নাই; ধর্মমাত্রই মিথ্যার বিরোধী।”

“বিরোধী বটে, কিন্তু প্রাণরক্ষার জন্য বিধিও আছে।”

“তবে কি আপনি প্রাণরক্ষার জন্য মিথ্যা বলিবেন?”

“আমি মিথ্যা বলিব না। বিধি আছে, তাহাই বলিলাম।”

“বলুন, আপনি কে? আর কী কারণে রাত্রে শিবিরে আসিতেছিলেন?”

“আমি পথিক, চাকুরির আশায় আপনাদের নিকট আসিতেছিলাম।”

“আপনি কোথা হইতে আসিতেছেন?”

“আমি মস্কাট হইতে আসিতেছি।”

“আপনার সঙ্গে যাঁহারা ধৃত হইয়াছেন, তাঁহারা কি আপনার সঙ্গী?”

“আমার সঙ্গী কেহ নাই, আমি তাহাদিগকে চিনি না।”

“এ কী কথা! অলীদ মহামতি কী মিথ্যা কথা বলিয়াছেন?”

“প্রাণ বাঁচাইতে কে-না মিথ্যা বলিয়া থাকে? আমি অলীদকে চিনি না। আমার পূর্বে যদি কেহ কোন কথা বলিয়া থাকেন, তবে তাহার কথাই যে সম্পূর্ণ সত্য, এ-কথা আপনাকে কে বলিল? এ বিশ্বাস আপনার কিসে জন্মিল?”

“কিসে যে তাঁহার কথায় বিশ্বাস জন্মিল, সে-কথা শুনিয়া আপনার প্রয়োজন নাই; কিন্তু আপনার কথায় আমি নিতান্ত দুঃখিত হইলাম। এখনই আপনাকে সত্য-মিথ্যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখাইতে পারি। কিন্তু তৃতীয় বন্দির কথা না শুনিয়া কিছু বলিব না। অনর্থক আমাদের অস্থির মনকে ভ্রমপথে লইয়া যাইবেন না।”

“আমি ভ্রমপথে লইতেছি না। আপনারা নিজে ভ্রম-কূপে পড়িয়াছেন।”

“সে সত্য, কিন্তু একটি মিথ্যাকে সত্য করিয়া পরিচয় দিতে সাতটি মিথ্যার প্রয়োজন। তাহাতেও শ্রোতার মনের সন্দেহ দূর হয় কি-না সন্দেহ। আপনার পরিচয় জানিতে আমাদের বেশি আয়াস আবশ্যক করিবে না, তবে তৃতীয় বন্দির কথা না শুনিয়া আপনাকে আর কিছুই বলিব না। কিন্তু আপনার প্রতি আমার বিশেষ সন্দেহ হইয়াছে।”

এই কথা বলিয়া ইঙ্গিত করিতেই প্রহরিগণ কঠিন বন্ধনে মারওয়ানের হস্তদ্বয় তখনই বন্ধন করিল। গাজী রহমান পুনরায় বলিলেন, “তৃতীয় বন্দিকে বিশেষ সাবধান ও সতর্ক হইয়া আনিবে, ক্রমেই সন্দেহের কারণ হইতেছে।”

সভামধ্য হইতে ওমর আলী বলিতে লাগিলেন, “মন্ত্রিবর! বন্দির আকার-প্রকার কথার স্বরে আমি চিনিতে পারিয়াছি। কিন্তু বেশের পরিবর্তে একটু সন্দেহ হইয়াছে মাত্র। বন্দির গাত্রের বসন উন্মোচন করিতে আজ্ঞা করুন। আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে, এই বন্দি এজিদের প্রধানমন্ত্রী মারওয়ান। কাল অনেকক্ষণ পর্যন্ত ইহার সহিত আমার অনেক কথা হইয়াছে, হাসি-তামাশা করিতে বাকি রাখি নাই।”

গাজী রহমানের ইঙ্গিতে প্রহরিগণ মারওয়ানের সেই ছদ্মবেশ উন্মোচন করিতেই মহামূল্য মণিমুক্তাখচিত বেশের প্রতি সকলের দৃষ্টি পড়িল। ওমর আলী, আক্কেল আলী (বাহরাম) প্রভৃতি যাঁহারা বিশেষরূপে মারওয়ানকে চিনিতেন, তাঁহারা সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন-“মারওয়ান!-এই সেই মারওয়ান!”

গাজী রহমান বলিলেন, “কী ঘৃণার কথা! সর্বশ্রেষ্ঠ সচিবের এই দশা! মারওয়ানের মন এত নীচ, বড়ই দুঃখের বিষয়। ইহার সম্বন্ধে আর কেহ কোন কথা বলিলেন না। দেখি, তৃতীয় বন্দির সত্যবাদিতা এবং এই মারওয়ান সম্বন্ধে তিনিই-বা কি জানেন। এইক্ষণে ইহাকে সভার এক প্রান্তে বিশেষ সতর্কভাবে রাখিতে হইবে।”

মন্ত্রীবরের আদেশে মারওয়ান বন্ধনদশায় প্রহরী-বেষ্টিত হইয়া, সভার এক প্রান্তে রহিল।

এদিকে তৃতীয় বন্দি সভায় উপস্থিত হইল। সে কাহারো প্রতি দৃষ্টি করিল না। প্রহরিগণ যেদিকে লইয়া চলিল, সে সেইদিকে ঈশ্বরের নাম লইয়া চলিল। প্রহরিগণ গাজী রহমানের সম্মুখে লইয়া উপস্থিত করিল।

জয়নাল আবেদীনকে দেখিয়া দরবারের যাবতীয় লোকের মনে যে এক অনির্বচনীয় ভাবের উদয় হইল, সে ভাবের কথা কে বলিবে? সে কথা কে মুখে আনিবে? শত্রুর জন্য মন আকুল, একথা কে বলিবে? সকলের মনে ঐ ভাব-ঐ স্নেহপূর্ণ পবিত্র ভাব-কিন্তু মনের কথা মন খুলিয়া মুখে বলিতে কেহই সাহসী হইলেন না। মোহাম্মদ হানিফা জয়নালের মুখাকৃতি স্থিরনয়নে দেখিতে লাগিলেন। কত কথা তাঁহার মনে উদয় হইল। বন্দির মুখাকৃতি, শরীরের গঠন দেখিয়া ভ্রাতৃবর হোসেনের কথা মনে পড়িল। জয়নালের নাম হৃদয়ে জ্বলন্তভাবে জাগিতে লাগিল।

গাজী রহমান বিশেষ ভদ্রতার সহিত বলিলেন, “আপনার পরিচয় দিয়া আমাদের মনের ভ্রান্তি দূর করুন।”

জয়নাল আবেদীন সভাস্থ সকলকে অভিবাদন করিয়া বিনয় বচনে বলিতে লাগিলেন, “আমার পরিচয়ের জন্য আপনারা ব্যস্ত হইবেন না। আমার প্রার্থনা যে, আর দুইজন যাঁহারা আমার সঙ্গে ধৃত হইয়াছেন, তাঁহাদিগকে এই স্থানে আনিতে অনুমতি করুন।”

গাজী রহমান একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, “বন্দিদ্বয় এই সভা মধ্যেই আছেন। তাঁহাদিগকে আপনার কি প্রয়োজন, তাহা স্পষ্টভাবে বলিতে হইবে।”

“আমার প্রয়োজন অনেক। তবে গত রাত্রে আমার সহিত যখন তাঁহাদের দেখা হয়, তখন একজনকে আমি বিশেষরূপে চিনিয়াছি। কিন্তু রাত্রের দেখা, তাহাতেই কিছু সন্দেহ আছে।”

“তবে কি আপনি তাঁহাদের সঙ্গী নহেন?”

“আমি কাহারো সঙ্গী নহি, আমি নিরাশ্রয়।”

গাজী রহমান অঙ্গুলি দ্বারা অলীদকে নির্দেশ করিয়া বলিলেন, “দেখুন ঐ এক বন্দি।”

জয়নাল আবেদীন ওত্‌বে অলীদকে কার্‌বালার প্রান্তরে দেখিয়াছিলেন মাত্র; তাহাকে বিশেষরূপে চিনিতে না পারিয়া বলিলেন, “আমি ইহাকে ভালরূপে চিনিতে পারিলাম না। আমি যে পাপাত্মা জাহান্নামীর কথা বলিয়াছি, নিশীথ সময়ে সেই প্রস্তর-খণ্ডের নিকট যাহাকে দেখিয়াছি-চাকুরি করিতে যে মদিনা হইতে দামেস্কে আসিতেছে, তাহাও শুনিয়াছি-তাহাকেই আমার বেশি প্রয়োজন।”

গাজী রহমানের আদেশে প্রহরিগণ বন্ধন অবস্থায় মারওয়ানকে সকলের সম্মুখে উপস্থিত করিল।

জয়নাল আবেদীন বলিলেন, “রে পামর! তোকে গত নিশীথেই চিনিয়াছিলাম। চিনিয়া কি করিব, আমি নিরস্ত্র!”

মারওয়ান বন্দি অবস্থাতেই বলিল, “আমি সশস্ত্র থাকিলেই-বা কী করিলাম! কী ভ্রম! কী ভ্রম! সুযোগ-সুবিধা মত তোমাকে পাইয়াও যখন আমার এই দশা, তখন আর আশা কি? কি ভ্রম!!”

“আরে নরাধম! ঈশ্বর কী না করিতে পারেন, তাঁহার ক্ষমতা তুই কি বুঝবি পামর?”

“আমি বুঝি বা না-বুঝি মনের দুঃখ মনেই রহিয়া গেল। যদি চিনিতাম, যে তুমিই-”

সভাস্থ সকলে মহা চঞ্চলচিত্ত হইয়া উঠিতেই, গোলযোগের সম্ভাবনা দেখিয়া জয়নাল আবেদীন বলিতে লাগিলেন, “সভাস্থ মহোদয়গণ! আমার পরিচয়-”

“আমার পরিচয়”-এই দুইটি শব্দ জয়নালের মুখ হইতে বহির্গত হইতেই সকলে নীরব হইলেন। সকলেই সমুৎসুকে জয়নালের মুখপানে চাহিয়া রহিলেন।

জয়নাল বলিলেন, “আমরা এক সময়ে বন্দি-অথচ পরস্পর শত্রুভাব। ইহা কম আশ্চর্যের কথা নহে। অগ্রে এই পাপাত্মার পরিচয় দিয়া শেষে আমার কথা বলিতেছি। ইহার নাম জগৎরাষ্ট্র। এই পাপাত্মার মন্ত্রণাতেই মহাত্মা হাসানবংশ একেবারে বিনাশ। প্রভু হোসেনের বংশও সমূলে ধ্বংস হইবার উপক্রম হইয়াছিল, ঈশ্বর রক্ষা করিয়াছেন। সে কথা এই দুরাচার নিজমুখে স্বীকার করিয়াছে। ‘কী ভ্রম! কী ভ্রম!’ ঐ ভ্রমই মঙ্গলের মূল কারণ। এই নরাধমই সকল ঘটনার মূল। সেই সকল সাংঘাতিক ঘটনার বিষয় যাহা আমি মাতার নিকট শুনিয়াছি, আর যাহা স্বচক্ষে দেখিয়াছি, সংক্ষেপে বলিতেছি। আমি আপনাদের নিকট বিচারপ্রার্থী।”

সভাস্থ সকলে বিশেষ মনোযোগের সহিত শুনিতে লাগিলেন। জয়নাল গম্ভীরস্বরে বলিতে লাগিলেন, “এই নরাধম, এই পাপাত্মাই এজিদ্ পক্ষ হইতে আপনার নাম স্বাক্ষর করিয়া, মহাত্মা হাসানের নিকট মক্কা-মদিনার কর চাহিয়া পাঠাইয়াছিল। এই পামরই হাসান বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে, পবিত্রভূমি মদিনার স্বাধীনতাসূর্য হরণ করিয়া চিরপরাধীনতার অন্ধকার অমানিশায় আবরণ করিতে, সসৈন্যে মদিনায় আসিয়াছিল। যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া মায়মুনার যোগে জায়েদার সাহায্যে হীরকচূর্ণ দ্বারা, মহাত্মা হাসানের জীবন অকালে বিনাশ করিয়াছে! এই দুরাচারই কুফা নগরের আবদুল্লাহ্ জেয়াদকে টাকায় বশীভূত করিয়া মহাবীর মোস্‌লেমের জীবন মিথ্যা ছলনায় কৌশলে শেষ করিয়াছে! এই নারকীই র্কাবালা প্রান্তরে মহা সংগ্রাম ঘটাইয়াছে। কৌশলে ফোরাত কূল বন্ধ করিয়া, শত সহস্র যোধকে শুষ্ককণ্ঠ করিয়া বিনাশ করিয়াছে। কি দুঃখের কথা।-তীক্ষ্ণ তীর দ্বারা দুগ্ধপোষ্য বালকের বক্ষঃভেদ করাইয়া জগৎ কাঁদাইয়াছে। অন্যায় যুদ্ধে মহাবীর আবদুল ওহাবকে বধ করিয়াছে। কত বলিব, এই পাপাত্মাই সর্বশ্রেষ্ঠ বীর-”

জয়নালের চক্ষু জলে পরিপূর্ণ হইল। পুনরায় করুণস্বরে বলিলেন, “আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর কাসেমের জীবনলীলা শেষ করিয়াছে। এই পাপাত্মাই পতিপরায়ণা সখিনা দেবীর আত্মহত্যার কারণ। আর কত বলিব। এই জাহান্নামী কাফের মারওয়ানই পুণ্যাত্মা পিতা প্রভু হোসেনের জীবন-”

জয়নালের মুখে আর কথা সরিল না,-চক্ষুদ্বয় জলে ভাসিতে লাগিল। মোহাম্মদ হানিফা হৃদয়-বেগ সম্বরণে অধীর হইয়া-“হা ভ্রাতঃ হোসেন! হা ভ্রাতঃ হোসেন! বাবা জয়নাল! হানিফার অন্তরাত্মা শীতল কর বাপ!” এই কথা বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে জয়নালকে বক্ষে ধারণ করিলেন। শোকাবেগ ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতে লাগিল।

সভাস্থ আর আর সকলে-ক্রোধে, রোষে, দুঃখে, শোকে, একপ্রকার জ্ঞানহারা উন্মত্তের ন্যায় হইয়া, সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “এ কি সেই মারওয়ান? এ কি সেই মারওয়ান? মার শয়তানকে। ভাই সকল, আর দেখ কী?”

গাজী রহমান বহুবিধ চেষ্টা করিয়াও সভাস্থ সকলের সে উগ্রমূর্তি, সে বিকট ভাব পরিবর্তন করিতে পারিলেন না, কেহই তাঁহার কথা শুনিল না। শেষে মোহাম্মদ হানিফার কথা পর্যন্ত কেহ গ্রাহ্য করিল না। “মার শয়তানকে” বলিতে বলিতে পাদুকাঘাত, মুষ্ট্যাঘাত, অস্ত্রাঘাত, যত প্রকার আঘাত প্রচলিত আছে, বজ্রাঘাতের ন্যায় মারওয়ানের শরীরে পড়িতে লাগিল। চক্ষের পলকে মারওয়ান-দেহ ধুলায় লুটাইয়া শোণিত-ধারে সভাতল রঞ্জিত করিল।

মারওয়ান অস্ফুটস্বরে বলিল, “জয়নাল আবেদীন! আমি তোমার ভালও করিয়াছি, মন্দও করিয়াছি। আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইল। কিন্তু সম্মুখে মহা ভীষণ রূপ। এমন ভয়ঙ্কর মূর্তি আমি কখনো দেখি নাই। আমাকে রক্ষা কর।”

জয়নাল আবেদীন বলিলেন, “মারওয়ান, ঈশ্বরের নাম কর। এ সময়ে তিনি ভিন্ন রক্ষার ক্ষমতা আর কাহারো নাই। জ্বলন্ত বিশ্বাসের সহিত সেই দয়াময়ের নাম মুখে উচ্চারণ কর। তাঁহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর।”

মারওয়ান আর্তনাদসহকারে বিকৃতস্বরে বলিল, “আমি মারওয়ান, আমি মারওয়ান-দামেস্ক-রাজমন্ত্রী মারওয়ান। আমাকে মারিয়ো না। দোহাই তোমার, আমাকে মারিও না। অগ্নিময় লৌহদণ্ডে আমাকে আঘাত করিয়ো না। আমি ও অগ্নি-সমুদ্রে প্রবেশ করিতে পারিব না। আমি মিনতি করিয়া দু’খানি পায়ে ধরিয়া বলিতেছি ও অগ্নি-সমুদ্রে আমাকে নিক্ষেপ করিয়ো না। দোহাই তোমার, রক্ষা কর। দোহাই তোমাদের, আমায় রক্ষা কর। আমি এজিদের প্রধানমন্ত্রী-আমাকে আর মারিও না। প্রাণ গেল-আমি যাইতেছি। ঐ আগুনে প্রবেশ করিতেছি-রক্ষা কর।”

বিকট চিৎকার করিতে করিতে মারওয়ানের প্রাণপাখি দেহপিঞ্জর হইতে অদৃশ্যভাবে উড়িয়া গেল। রক্তমাখা দেহ সভাতলে পড়িয়া রহিল।
মোহাম্মদ হানিফা, গাজী রহমান, ওমর আলী, মস্হাব কাক্কা প্রভৃতিকে বলিতে লাগিলেন, “ভ্রাতৃগণ! এখন আর চিন্তা কি? এখন প্রস্তুত হও, যাহার জন্য এতদিন সঙ্কুচিত ছিলাম, যাহার জীবনের আশঙ্কা করিয়া এতদিন নানা সন্দেহে সন্দিহান হইয়াছিলাম, আজ সে জীবনের জীবন-নয়নের পুত্তলি,-হৃদয়ের ধন,-অমূল্যনিধি হস্তে আসিয়াছে। ঈশ্বর আজ তাহাকে আমাদের হস্তগত করাইয়াছেন, আর ভাবনা কি? এখনই প্রস্তুত হও। এখনই সজ্জিত হও। এখনই এজিদ্বধে যাত্রা করিব। শুন, ঐ শুন, এজিদ্-শিবিরে যুদ্ধের বাজনা বাজিতেছে। রহমানের স্বীকৃত বাক্য রক্ষা হইল। ঈশ্বরই চারিদিক পরিষ্কার করিয়া দিলেন। ক্ষণকাল বিলম্বও আর সহ্য হইতেছে না। শীঘ্র প্রস্তুত হও। অদ্যই দুরাত্মার জীবন শেষ করিয়া পরিজনদিগকে বন্দিগৃহ হইতে উদ্ধার করিব।”

সকলে মনের আনন্দে যুদ্ধসাজে ব্যাপৃত হইলেন। মোহাম্মদ হানিফা জয়নালকে ওত্‌বে অলীদের পরিচয় দিয়া বলিলেন, “এই অলীদ কোন সময় বলিয়াছিলেন যে, এজিদের জন্য অনেক করিয়াছি! হাসান-হোসেনের প্রতি অনেক অত্যাচার করিয়াছি। আমি উহা পারিব না। সেই কথা কয়েকটা আমার হৃদয়ে গাঁথা রহিয়াছে। আমি সেই কারণেই ইহাকে মস্‌হাব কাক্কার হস্ত হইতে রক্ষা করিয়াছি। এই অলীদ যদি এ প্রকারে আমাদের হস্তগত না হইতেন, তাহা হইলেও আমি কখনোই ইহার প্রাণের প্রতি হস্তক্ষেপ করিতে সম্মত হইতাম না। জানিত পক্ষে কাহাকেও আক্রমণ করিতে দিতাম না। এই মহাত্মা প্রকাশ্যে পৌত্তলিক, অন্তরে মুসলমান!”

জয়নাল আবেদীন বলিলেন, “আর প্রকাশ গোপন, দ্বিভাবের প্রয়োজন কি?”

অলীদ গাত্রোত্থান করিয়া বলিলেন, “হজরত! আমি অকপটে বলিতেছি, আপনি আমাকে সত্যধর্মে দীক্ষিত করুন।”

জয়নাল “বিস্মিল্লাহ্” বলিয়া ওত্বে অলীদকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করিলেন। মুহূর্তমধ্যে অলীদের অন্তরে সে সত্যধর্মের জ্বলন্ত বিশ্বাস, “ঈশ্বর এক-সেই এক ভিন্ন আর কেহ উপাস্য নাই”-অক্ষয়রূপে নিহিত হইল।

মোহাম্মদ হানিফা অলীদকে সাদরে আলিঙ্গন করিয়া বলিলেন, “ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন, নূরনবী মোহাম্মদের প্রতি অটল ভক্তি হউক, দয়াময় আপনাকে জান্নাতবাসী করুন-এই আশীর্বাদ করি।”

জয়নাল আবেদীনও অলীদের পরকাল উদ্ধারহেতু অনেক আশীর্বাদ করিলেন।

এদিকে মহাঘোর নিনাদে যুদ্ধ-বাজনা বাজিয়া উঠিল। সৈন্যগণ, সৈন্যাধ্যক্ষগণ, মরার আনন্দে সজ্জিত হইয়া শিবির-বহির্ভাগে দণ্ডায়মান হইলেন। ওমর আলী, মস্হাব কাক্কা প্রভৃতি মনোমত বেশ-ভূষায় ভূষিত ও নানা অস্ত্রে সজ্জিত হইয়া, জয়নাল আবেদীনকে ঘিরিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। তখন মোহাম্মদ হানিফা বলিতে লাগিলেন, “ভ্রাতৃগণ! আজ সকলকেই ভ্রাতৃ সম্বোধনে বলিতেছি, আমাদের বংশের সমুজ্জ্বল রত্ন, ইমাম বংশের মহামূল্য মণি, মদিনার রাজা-প্রাণাধিক জয়নাল আবেদীনকে ঈশ্বর কৃপায় আমরা প্রাপ্ত হইয়াছি। ভবিষ্যৎ ভাবনা জয়নালের জীবনের আশঙ্কা, সদা চিন্তিত অন্তর হইতে প্রশমিত হইয়া বিশেষ আশার সঞ্চার হইয়াছে। এ নিদারুণ দুঃখ-সিন্ধু হইতে শীঘ্রই উদ্ধার পাইবার ভরসাও হৃদয়ে জন্মিয়াছে। আজ হৃদয়ে মহাতেজ প্রবেশ করিয়াছে, আনন্দে বক্ষঃ স্ফীত হইয়া বাহুদ্বয় মহাবলে বলীয়ান বোধ হইতেছে! ভ্রাতৃগণ! আমাদের পরিশ্রম সার্থক হইল। আমি দিব্যচক্ষে দেখিতেছি, প্রকৃতি আজ আমাদের সানুকূলে থাকিয়া অলক্ষিতভাবে নানাবিধ শুভচিহ্ন, শুভযাত্রার শুভলক্ষণ দেখাইতেছেন। নিশ্চয় আশা হইতেছে যে, এই যাত্রায় এজিদ্-বধ করিয়া পরিজনবর্গকে বন্দিগৃহ হইতে উদ্ধার করিতে পারিব। ভ্রাতৃগণ! এই শুভ সময়ে এই আনন্দ উচ্ছ্বাস সময়ে, আমার একটি মনোসাধ পূর্ণ করি, জগৎপূজিত মদিনার সিংহাসন আজ সজীব করি। আমাদের সকলের নয়নের, জগতের যাবতীয় ইসলাম চক্ষের পুত্তলি-হৃদয়ের ধন, অমূল্য মণিকে আমরা ভক্তির সহিত আজই শিরে ধারণ করি। ভ্রাতৃগণ! মনের হর্ষে প্রাণাধিক জয়নাল আবেদীনকে আজই এই স্থানে-এই দামেস্ক-প্রান্তরে মদিনার রাজপথে অভিষেক করি।”

সমস্বরে সম্মতিসূচক আনন্দধ্বনির প্রতিধ্বনিতে গগন আচ্ছন্ন করিল! মোহাম্মদ হানিফা ‘বিস্মিল্লাহ্’ বলিয়া রাজমুকুট, মণিমুক্তাখচিত তরবারি জয়নাল আবেদীনের সম্মুখে রাখিয়া দিলেন। ওমর আলী, মস্হাব কাক্কা, গাজী রহমান প্রভৃতি যথারীতি অভিবাদন করিয়া, ঈশ্বরের গুণানুবাদ সহিত জয়নাল আবেদীনের জয় ঘোষণা করিলেন। ভিন্ন ভিন্ন দেশীয় প্রাচীন রাজগণ নতশিরে অভিবাদন করিয়া উপঢৌকনাদি জয়নালের সম্মুখে রাখিয়া অন্তরের সহিত আশীর্বাদ করিলেন। মদিনা এবং নানা দেশ বিদেশীয় সৈন্যগণ অবনতমস্তকে নবীন রাজার সম্মুখে অস্ত্রাদি রাখিয়া সমস্বরে মদিনা-সিংহাসনের জয় ঘোষণা করিলেন।

মোহাম্মদ হানিফা পুনরায় বলিলেন, “ভ্রাতৃগণ! এখন সকলেই স্ব-স্ব অস্ত্র পুনঃ ধারণ করিয়া, প্রথমে ঈশ্বরের নাম, তাহার পর নূরনবী মোহাম্মদ নাম এবং সর্বশেষে নবীন ভূপতির জয় ঘোষণা করিয়া বীরদর্পে দণ্ডায়মান হও।”

হানিফার কথা শেষ না-হইতেই গগনভেদী শব্দ হইল, ঈশ্বরের নামের পর, নূরনবী মোহাম্মদের প্রশংসার পর, “জয় মদিনা সিংহাসনের জয়-জয় নবীন ভূপতির জয়,-জয়নাল আবেদীন মহারাজের জয়” শব্দ হইতে লাগিল।

আবার মোহাম্মদ হানিফা বীরদর্পে বীরভাবে বলিতে লাগিলেন, “ভ্রাতৃগণ! এই অসিধারণ করিলাম, বীর বেশে সজ্জিত হইলাম,-আর ফিরিয়া না তরবারি কোষে আবদ্ধ করিব না। যতদিন এজিদ্ বধ, পরিজনগণের উদ্ধার না হয়, ততদিন এই বেশ-এই বীর বেশ অঙ্গে থাকিবে। আমিও আজ তোমাদের সঙ্গী, আমিও আজ সৈন্য, আমিও আজ জয়নালের আজ্ঞাবহ। সকলেরই আজ এই প্রতিজ্ঞা-ধর্ম প্রতিজ্ঞা। এই যাত্রাতেই হয় এজিদ্-বধ না হয় আমাদের জীবনের শেষ। দিবা হউক, নিশা আগমন করুক; আবার সূর্যের উদয় হউক,-এজিদ্-বধ। এজিদ্-বধ না-হওয়া পর্যন্ত আমাদের এই বেশ-এই বীর বেশ। বিশ্রামের নাম করিব না, যুদ্ধে ক্ষান্ত দিব না, পশ্চাৎ হটিব না-জীবন পণ,-হানিফার জীবন পণ,-এজিদ্-বধে সকলের জীবন পণ। আজিকার যুদ্ধে বিচার নাই, ব্যূহ নাই, কোন প্রকার বিধি-ব্যবস্থা নাই, মার কাফের, জ্বালাও শিবির।-কাহারো অপেক্ষা কেহ করিবে না, কাহারো উপদেশের প্রতি কেহ লক্ষ্য রাখিবে না, আজ সকলেই সেনাপতি-সকলেই সৈন্য। সকলের মনে যেন এই কথা মুহূর্তে মুহূর্তে জাগিতে থাকে, মহাত্মা হাসান-হোসেনের পরিজনগণের উদ্ধারসাধন করিতে জীবন পণ,-দামেস্করাজ্য সমভূমি করিতে জীবন পণ।”

“ভ্রাতৃগণ! মনে কর, আজ আমাদের জীবনের শেষ দিন এবং শেষ সময়। শত্রুদল চক্ষে দেখা ভিন্ন আপন সহযোগী-সাহায্যকারী সৈন্য-সামন্তের প্রতি-এমন কি, স্ব-স্ব শরীরের প্রতি কেহ লক্ষ্য করিবে না। আজ হাসানের শোক, হোসেনের শোক, এই তরবারিতে নিবারণ করিব। আজ কাফের বধ করিয়া কারবালার প্রতিশোধ দামেস্ক-প্রান্তরে লইব। আজ কাফেরের দেহ-বিনির্গত শোণিতে লহুর নদী বহাইব,-মরুভূমে রক্তের প্রবাহ ছুটাইব। শত্রুর মনোকষ্ট দিতে আজ কাহার বাধা মানিব না-কোন কথা শুনিব না। ঐ জাহান্নামী কাফের মারওয়ানের মস্তক কাটিয়া এক বর্শায় বিদ্ধ কর। পাপীর দেহ শতখণ্ডে খণ্ডিত কর। মস্তক এবং খণ্ডিত দেহ সকল বর্শাগ্রে বিদ্ধ করিয়া ঘোষণা করিতে করিতে অগ্রে অগ্রে যাও এবং মুখে বল, “এই সেই কাফের মারওয়ান, এই সেই মন্ত্রী মারওয়ান, এই সেই এজিদের প্রিয়সখা মারওয়ান।”

হানিফার মুখের কথা থাকিতে থাকিতে, মদিনাবাসীর কয়েকজন নবীন যোধ, অসি ঘুরাইতে ঘুরাইতে ছুটিয়া আসিয়া, “এই সেই মারওয়ান, এই সেই মন্ত্রী মারওয়ান, এই সেই এজিদের প্রিয়সখা মারওয়ান, এই সেই নরাধম পিশাচ” ইত্যাদি শত শত প্রকার সম্বোধন করিয়া চক্ষের নিমিষে মারওয়ানের দেহ-এক, দুই, তিন ইত্যাদি ক্রমে গণিয়া শত খণ্ডে খণ্ডিত করিলেন। বর্শার অগ্রে বিদ্ধ করিতে ক্ষণকাল বিলম্ব হইল না।

মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “ভ্রাতৃগণ! আজ হানিফা এই অস্ত্র ধরিল, পুনরায় বলিতেছি, ধর্মতঃ প্রতিজ্ঞা করিতেছি, এজিদ্-বধ না করিয়া এই অস্ত্র আর কোষে রাখিব না। ভ্রাতৃগণ! আমার অসহায় পরিজনদিগের কথা মনে রাখিয়ো, এই আমার প্রার্থনা। গাজী রহমান উপযুক্ত সৈন্য লইয়া জয়নাল আবেদীনসহ আমাদের পশ্চাৎ আসিতে থাকুন। যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, আর ফিরিব না। আর শিবিরের আবশ্যক নাই। বিশ্রাম-উপযোগী দ্রব্যের প্রয়োজন নাই। জীবনরক্ষা হইলে আজই সুবিস্তৃত দামেস্করাজ্য লাভ হইবে। জয়নালকে সিংহাসনে বসাইতে পারিলে বিশ্রামবিলাস সকলই পাইব। আর যদি জীবন শেষ হয়, তবে কোন দ্রব্যে আবশ্যক হইবে না। ভাঙ্গ শিবির, লুটাও জিনিস।”

এই কথা বলিয়া মোহাম্মদ হানিফা অশ্বারোহণ করিলেন। সকলে সমস্বরে ঈশ্বরের নাম সপ্তবার উচ্চারণ করিয়া ঘোরনাদে মহারাজ জয়নালের জয়-ঘোষণা করিয়া দুই-এক পদ অগ্রসর হইতে লাগিলেন। মারওয়ানের খণ্ডিত দেহ একশত বর্শায় বিদ্ধ হইয়া অগ্রে অগ্রে চলিল। শিবিরের বাহির হইয়া পুনরায় ভীমনাদে ঈশ্বরের নাম করিয়া এজিদ-বধে যাত্রা করিলেন। সম্মুখে শত শত বর্শাধারী সমস্বরে বলিতে লাগিল, “এই সেই কাফের মারওয়ান, এই সেই মন্ত্রী মারওয়ান, এই সেই এজিদের প্রিয়সখা মারওয়ান।” আর মুহূর্তে মুহূর্তে ঈশ্বরের নাম এবং নবীন রাজার জয়ধ্বনিতে দামেস্ক-প্রান্তর কম্পিত হইতে লাগিল।

এজিদের মোহনিদ্রা ভাঙ্গিয়া গেল। মস্তক ঘুরিতেছে, সঙ্গে সঙ্গে মনের বেদনাও আছে। শরীর অলস, স্ফূর্তিবিহীন, দুর্বল। নিদ্রাভঙ্গ হইয়াছে, শয্যা হইতে উঠিয়া বসিতে পারে না। কিন্তু উপস্থিত ভীষণ শব্দ কর্ণকুহরে প্রবেশ করিতেই এজিদ্ সেই আরক্তিম নয়নে পরিশুষ্ক মুখে বিকৃত মস্তকে শয্যা হইতে চমকিয়া উঠিলেন। অন্তর কাঁপিতে লাগিল। মহা অস্থির হইয়া শিবিরদ্বার পর্যন্ত আসিয়া দেখিলেন যে, মহা সঙ্কটকাল উপস্থিত। কোথায় মারওয়ান? কোথায় অলীদ? এ দুঃসময়ে কাহারো সন্ধান নাই। ওমর এবং অন্যান্য সেনাপতিগণ আসিয়া অভিবাদনপূর্বক দণ্ডায়মান হইল। রাত্রের ঘটনার আভাস বলিতে সমুদয় কথা এজিদের মনে হইল। বীরদর্পে বলিতে লাগিল-“ওমর! তুমিই আজ প্রধান সেনাপতি। চিন্তা কী? মারওয়ান গিয়াছে, অলীদ গিয়াছে এজিদ্ আছে। চিন্তা কী? যাও যুদ্ধে। দাও বাধা-মার হানিফা। তাড়াও মুসলমান। ধর তরবারি! আমি এখনই আসিতেছি, আজ হানিফার যুদ্ধ-সাধ, জীবনের সাধ এখনই মিটাইতেছি।”

ওমর শিবিরের বাহিরে আসিয়া পূর্ব হইতে তুমুলরবে বাজনা বাজাইতে আদেশ করিলেন। মনের উৎসাহে আনন্দে সৈন্যগণ বিষম বিক্রমে দণ্ডায়মান হইল। এদিকে এজিদ্ স্বসাজে,-মণিময় বীরসাজে সজ্জিত হইয়া শিবিরের বাহির হইয়া বলিল, “সৈন্যগণ! মারওয়ানের জন্য দুঃখ নাই, অলীদের কথা তোমরা কেহ মনে করিয়ো না। আমার সৈন্যাধ্যক্ষ মধ্যে বিস্তর অলীদ, বহু মারওয়ান এখনো জীবিত রহিয়াছে। কোন চিন্তা নাই। বীরবিক্রমে আজ হানিফাকে আক্রমণ কর। আমি আজ পৃষ্ঠপোষক। এজিদের সৈন্য-বিক্রম, হানিফার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হাসান দেখিয়াছে, কারবালা-প্রান্তরে হোসেন দেখিয়াছে, আর আমি আজ দামেস্ক প্রান্তরে হানিফাকে দেখাইব। মার হানিফা, মার বিধর্মী, তাড়াও মুসলমান। উহারা বিষম বিক্রমে আসিতেছে, আমরাও মহাপরাক্রমে আক্রমণ করিব। হানিফার যুদ্ধের সাধ আজ মিটাইব। সমস্বরে দামেস্ক-সিংহাসনের বিজয়-ঘোষণা করিয়া ক্রমে অগ্রসর হও।”

এজিদ্ মহাবীর। এজিদের সৈন্যগণও অশিক্ষিত নহে-প্রভুর সাহসসূচক বচনে উত্তেজিত হইয়া বীরদর্পে পদনিক্ষেপ করিতে লাগিল। আজিকার যুদ্ধ চমৎকার! কোন দলে ব্যূহ নাই, শ্রেণীভেদ নাই-আত্মরক্ষার ভাবেও কেহ দণ্ডায়মান হয় নাই। উভয় দলই অগ্রসর, উভয় দলেরই সম্মুখে গমনের আশা।

এজিদ্ সৈন্যদলের পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতেছে এবং সুযোগ মত হানিফার সৈন্যদলের আগমনও দেখিতেছে-অগণিত সৈন্য, সর্বাগ্রে বর্শাধারী। বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখিল, মানবশরীরের খণ্ডিত অংশ সকল বর্শায় বিদ্ধ এবং বর্শাধারিগণের মুখে এই কথা,-“এই সেই মারওয়ান, প্রধানমন্ত্রী মারওয়ান, এজিদের প্রিয়সখা মারওয়ান।” এজিদ্ সকলই বুঝিল, মনে মনে দুঃখিতও হইল। কিন্তু প্রকাশ্যে সে দুঃখ-চিহ্ন কেহ দেখিতে পাইল না, হাবভাবেও কেহ বুঝিতে পারিল না। সদর্পে বলিল, “সৈন্যগণ! মারওয়ানের খণ্ডিতদেহ দেখিয়া কেহ ভীত হইও না, হাতে পাইয়া সকলেই সকল কার্য করিতে পারে। শীঘ্র শীঘ্র পদ নিক্ষেপ কর, বজ্রনাদে আক্রমণ কর, অশনিবৎ অস্ত্রের ব্যবহার কর। আমরাও গাজী রহমানের দেহ সহস্র খণ্ডে খণ্ডিত করিয়া শৃগাল-কুক্কুর দ্বারা ভক্ষণ করাইব। কর আঘাত, কর আঘাত।”

যেমন সম্মিলন, অমনি অস্ত্রের বর্ষণ। কী ভয়ানক যুদ্ধ! কী ভীষণ কাণ্ড! প্রান্তরময় সৈন্য, প্রান্তরময় অস্ত্র, প্রান্তরময় সমর। উভয় দলেই আঘাত-প্রতিঘাত আরম্ভ হইল। অসি, বর্শা, খ র, তরবারি সকলই চলিল। কী ভয়ানক ব্যাপার! যে যাহাকে সম্মুখে পাইতেছে, সে তাহার প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করিতেছে। পরিচয় নাই, পাত্রাপাত্র প্রভেদ নাই! সম্মিলনস্থলে উভয় দলে যে বাধা জন্মিয়াছে, তাহাতে কোন পক্ষেরই আর অগ্রসর হইবার ক্ষমতা হইতেছে না। কেবল সৈন্যক্ষয়-বলক্ষয় হইতেছে মাত্র। ওমর আলী মস্‌হাব কাক্কা প্রভৃতি দুই-এক পদ অগ্রসর হইতেছেন, কিন্তু টিকিতে পারিতেছেন না। মোহাম্মদ হানিফা এখনো তরবারি ধরেন নাই, কেবল সৈন্যদিগকে উৎসাহ দিতেছেন, মুহূর্তে মুহূর্তে ভৈরব নিনাদে দামেস্ক-প্রান্তর কাঁপাইয়া তুলিতেছেন। সৈন্যগণ সময় সময় “আল্লাহু আক্‌বার” শব্দ করিয়া গগন পর্যন্ত কাঁপাইয়া তুলিতেছেন।

এখনো মোহাম্মদ হানিফা তরবারি ধরেন নাই। দুল্‌দুলে কশাঘাত করিবার সৈন্য শ্রেণীর এক সীমা হইতে অন্য সীমা পর্যন্ত মুহূর্তে মুহূর্তে ঘুরিয়া দেখিতেছেন। যেখানে একটু মন্দভাবে তরবারি চলিতেছে, সেই খানেই সেই হইয়া দুই-চারিটি কথা কহিয়া কাফের বধে উৎসাহ দিতেছেন। কী লোমহর্ষণ সমর! কী ভয়ানক সমর! বিনা মেঘে বিজলী খেলিতেছে (অস্ত্রের চাক্চিক্য), হুহুঙ্কারে গর্জন হইতেছে (উভয় দলের সৈন্যগণের বিকট শব্দ)। অজস্র শিলার ঘর্ষণ হইতেছে (খণ্ডিত দেহ)! মুষলধারে বৃষ্টি হইতেছে (দেহ নির্গত রুধির)! কী দুর্ধর্ষ সমর!

বেতনভোগী সৈন্যগণ-ইহারা হানিফার কে, এজিদেরই-বা কে? হায় রে অর্থ! হায় রে হিংসা! হায় রে ক্রোধ! হানিফার সৈন্যগণ আজ অজ্ঞান; মদিনাবাসীরা বিহ্বল; পদতলে, অশ্ব পদতলে-নরদেহ, নরশোণিত। ক্রমেই খণ্ডিত দেহ, খণ্ডিত অশ্ব,-বিষম সমর।
দৈবাধীন ওত্‌বে অলীদ আর ওমরের যুদ্ধ কী চমৎকার দৃশ্য। এ দৃশ্য কে দেখিবে? ঈশ্বরের মহিমায় যাহার অণুমাত্র সন্দেহ আছে, সেই দেখিবে। কাল ভ্রাতৃভাব, আজ শত্রুভাব,-এ লীলার অন্ত মানুষে কী বুঝিবে? ওমর বলিল, “নিমকহারাম! নিশীথ সময়ে শিবির হইতে বাহির হইয়া শত্রু-দলে মিশিলে? প্রভাত হইতে হইতে আশ্রয়দাতা পালনকর্তা, তোমার চির উপকারকর্তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরিলে? ধিক্ তোমার অস্ত্রে! ধিক্ তোমার মুখে! নিমকহারাম! ধিক তোমার বীরত্বে!”

ওত্‌বে অলীদ বলিলেন, “ভ্রাতঃ ওমর! ক্রোধে অধীর হইয়া নীচত্ব প্রকাশ করিয়ো না, যথার্থ তত্ত্ব না জানিয়া কটুবাক্য ব্যবহার করিয়ো না। ছি ছি! তুমি প্রবীণ-প্রাচীন। সময়-গুণে তোমারও কী মতিভ্রম ঘটিল? ছি ছি ভ্রাতঃ! স্থিরভাবে কথা বল, কথায় অনিচ্ছা হয়, অস্ত্রের দ্বারা সদালাপ কর।”

“তোমার সঙ্গে কথা কী? তুমি বিশ্বাসঘাতক, তুমি নিমকহারাম, তুমি বীরকুলের কুলাঙ্গার!”

“দেখ ভাই ওমর! আমি বিশ্বাসঘাতক নহি, নিমকহারাম নহি, কুলাঙ্গারও নহি। মারওয়ানের সঙ্গে আমি বন্দি হইয়াছিলাম। পরাভব স্বীকারে আত্মসমর্পণ করিয়া সত্যধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছি। সেই একেশ্বরের জ্বলন্ত ভাব আমার হৃদয়ে নিহিত হইয়াছে, চক্ষের উপর ঘুরিতেছে; তাই বিধর্মীমাত্রই আমার শত্রু, দেখিলেই বধের ইচ্ছা হয়, কারণ সে নরাকার পশু যে নিরাকার ঈশ্বরকে সাকারে পূজা করে। আবার যাহার অধীনতা স্বীকার করিয়াছি, তাহার মিত্র-মিত্র, তাহার শত্রু-পরম শত্রু। আর কী বলিব তোমাকে গালি দিব না। তোমার কার্য তুমি কর, আমার কার্য আমি করি।”

দুইজনে কথা হইতেছে, এমন সময়ে এজিদ্ ওমরের নিকট দিয়া যাইতেই অলীদকে দেখিয়া অশ্ব-বল্গা ফিরাইল।

ওমর বলিতে লাগিল, “বাদশা নামদার! দেখুন আপনার প্রধান সেনাপতির বীরত্ব দেখুন।”

এজিদ্ দুঃখিতভাবে বলিতে লাগিল, “অলীদ! এতদিন এত যত্ন করিলাম, পদবৃদ্ধি করিলাম, কত পারিতোষিক দান করিলাম, কত অর্থ সাহায্য করিলাম, তাহার প্রতিফল, তাহার পরিণামফল বুঝি ইহাই হইল?”

“আমি নিমক হারামি করি নাই, কোন লাভের বশীভূত হইয়া আপনার শত্রুদলে মিশি নাই। শত্রু-শিবিরে যাইতেছিলাম-দৈব-নির্বন্ধে ধরা পড়িলাম। কি করি, পরাভব স্বীকার করিয়া সত্যধর্ম গ্রহণ করিয়াছি। পরকালে মুক্তির পথ পরিষ্কার করিতেই আজ কাফের বধে অগ্রসর হইয়াছি-অস্ত্র ধরিয়াছি।”

এজিদ্ রোষে অধীর হইয়া বলিল, “ওমর! এখনো অলীদ-শির মৃত্তিকায় লুণ্ঠিত হয় নাই, ইহাই আশ্চর্য।”

এজিদ্ ওমরকে সজোরে পশ্চাৎ করিয়া অলীদ প্রতি আঘাত করিল। কী দৃশ্য! কী চমৎকার দৃশ্য!!

অলীদ সে আঘাত বর্মে উড়াইয়া বলিল, “আমি আপনার প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করিব না। বিশেষ মহাবীর মোহাম্মদ হানিফা, যিনি আজ স্বয়ং যুদ্ধভার গ্রহণ করিয়া সর্বপ্রধান সেনাপতি পদে বরিত হইয়াছেন, তাঁহার নিষেধ আছে।”

এজিদ্ বলিল, “ওরে মূর্খ! একরাত্রি মূর্খদলের সহবাসে থাকিয়াই তোর দিব্যজ্ঞান জন্মিয়াছে! স্বয়ং রাজা সেনাপতি! তবে বরিত হইল কে? রাজমুকুট শোভা পাইল কাহার শিরে? রাজা স্বয়ং যুদ্ধে আসিলে ক্ষতি কি? সেনাপতি উপাধি লইয়া স্বয়ং রাজা যুদ্ধক্ষেত্রে আসিয়া থাকে রে বর্বর?”

“এজিদ্ নামদার! আমি বর্বর নহি। রাজা সেনাপতিপদ গ্রহণ করে না তাহা আমি বিশেষরূপে জানি। মোহাম্মদ হানিফা তাঁহার রাজ্যের রাজা, মদিনার কে?”

“মদিনায় আবার কোন রাজার আবির্ভাব হইল?”

মহাশয়, যিনি মদিনার রাজা,-তিনি দামেস্কের রাজা,-তিনি মুসলমান রাজ্যের রাজা-সেই রাজরাজেশ্বর, মহারাজাধিরাজ আজ রাজপদে বরিত হইয়াছেন। রাজমুকুট তাঁহারই শিরে শোভা পাইতেছে। রাজঅস্ত্র তাঁহারই কটিদেশে দুলিতেছে।”

“অলীদ, তোমার এরূপ বুদ্ধি না হইলে ভিখারীর ধর্ম গ্রহণ করিবে কেন? আমি শুনিয়াছি, মোহাম্মদ হানিফাকে মদিনার লোক রাজা বলিয়া স্বীকার করিয়াছে। সমগ্র মুসলমান রাজ্য মোহাম্মদ হানিফার নামে কম্পিত হয়,-কেমন নূতন ধার্মিক?”

“ধর্মের সঙ্গে হাসি-তামাশা কেন? আপনার জ্ঞান থাকিলে কি আজ আপনি হানিফার বিরুদ্ধে যুদ্ধডঙ্কা বাজাইতে পারিতেন? আপনি মন্ত্রীহারা, জ্ঞানহারা, আত্মহারা হইয়াছেন। অতি অল্প সময়মধ্যেই রাজ্যহারা হইবেন। আপনার জীবন হরণের জন্য মহাবীর হানিফা আছেন। আমাদের ক্ষমতার মধ্যে যাহা তাহার কথা বলিলাম। বলুন, আজিকার যুদ্ধে স্বার্থ কী?”

“হানিফার জীবন শেষ, জয়নাল আবেদীনের বধ-মদিনার সিংহাসন লাভ। আর স্বার্থের কথা কী শুনিবে? সে স্বার্থ অন্তরে-হৃদয়ে চাপা।”
“ঈশ্বরের ইচ্ছায় সকলই অন্তরে চাপা থাকিবে। আর মুখে যাহা বলিলেন, তাহা কেবল মুখেই থাকিল। বলুন তো মহাশয়, জয়নাল আবেদীনকে কী প্রকারে বধ করিবেন?”

“কেন, বন্দির প্রাণবধ করিতে আর কথা কী?”

“তবে বুঝি রাত্রের কথা মনে নাই? থাকিবে কেন, কথাগুলি সমুদয় পেয়ালায় গুলিয়া পেটে ঢালিয়াছেন?”

এজিদ্ একটু চিন্তা করিয়া বলিল, “হাঁ হাঁ মনে হইয়াছে; জয়নাল বন্দিগৃহ হইতে পলাইয়াছে। আমার রাজ্য-যাবে কোথা?”

“যেখানে যাইবার সেখানে গিয়াছে। ঐ শুনুন, সৈন্যগণ কাহার জয় ঘোষণা করিতেছে।”

“জয়নাল কি হানিফার সঙ্গে মিশিয়াছে?”

“আপনিই বিবেচনা করিয়া দেখুন, মোহাম্মদ হানিফা আজ সেনাপতি। সৈন্যগণ সহস্রমুখে প্রতি মুহূর্তে নবভূপতির জয় ঘোষণা করিতেছে। আর কী শুনিতে চাহেন?”

এজিদ্ মহাব্যস্তে বলিল, “অলীদ! তুমি আমার চিরকালের অনুগত, অধিক আর কি বলিব, ঐদিকে যখন গিয়াছ, তখন মন ফিরাও হানিফার সৈন্যশিরেই তোমার অস্ত্র বর্ষিতে থাকুক। আর কি বলিব আমার এই শেষ কথা-আমি তোমাকে দামেস্ক রাজ্যের প্রধানমন্ত্রীত্বপদ দান করিব।”

“ও-কথা মুখে আনিবেন না। আপনি আমার সহিত যুদ্ধ করুন, না হয় আমার অস্ত্রের সম্মুখ হইতে সরিয়া যাউন। আমি জয়নাল আবেদীনের দাস, মোহাম্মদ হানিফার আজ্ঞাবহ। আপনার মন্ত্রী হইয়া লাভ যাহা, তাহা তো স্বচক্ষেই দেখিতেছেন। ঐ দেখুন, বর্শার অগ্রভাগ দেখুন, আপনার এক মন্ত্রী একশত মারওয়ান-রূপ ধারণ করিয়া বর্শার অগ্রভাগে বসিয়া আছে।”

এজিদ্ মহাক্রোধে বলিল, “নিমকহারাম, কমজাৎ, কমিন আমার সঙ্গে তামাশা? ইহকালের মত তোর কথা কহিবার পথ বন্ধ করিতেছি।” সজোরে অলীদ-শির লক্ষ্য করিয়া আঘাত করিল। অলীদ সে আঘাত বাম হস্তস্থিত বর্শাদণ্ড দ্বারা উড়াইয়া সরিতেই-ওমর অলীদের গ্রীবা লক্ষ্যে আঘাত করিল। বহুদূর হইতে ওমর আলী এই ঘটনা দেখিয়া নক্ষত্রবেগে অলীদের নিকট আসিয়া দেখিলেন যে, এজিদ্ ও ওমর উভয়ে অলীদের প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করিতেছে।

ওমর আলী চক্ষু ঘূর্ণিত করিয়া বলিলেন, “এজিদ্! এদিকে কেন? মোহাম্মদ হানিফার দিকে যাও। সেদিনেও দেখিয়াছ, আজিও বলিতেছি, তোমার প্রতি কখনোই অস্ত্র নিক্ষেপ করিব না। তোমার শোণিতে হানিফার তরবারি রঞ্জিত হইবে। যাও, সেদিকে যাও,-আজ-”

ওমর আলীর কথা শেষ হইতে-না-হইতেই ওমর অলীদ প্রতি দ্বিতীয় আঘাত করিল। সঙ্গে সঙ্গে এজিদ্ অলীদের অশ্বকে বর্শা দ্বারা আঘাত করিয়া বাম পার্শ্ব হইতে দক্ষিণ পার্শ্ব পর্যন্ত পার করিয়া দিল। অশ্ব কাঁপিতে কাঁপিতে মৃত্তিকায় পড়িয়া গেল। ওমর এই সুযোগে অলীদের পৃষ্ঠে আঘাত করিল, বর্শাফলক পৃষ্ঠ ভেদ করিয়া বক্ষঃস্থল হইতে রক্তমুখে বহির্গত হইল। অলীদ ঈশ্বরের নাম করিতে করিতে শহীদ হইলেন।
ওমর আলী এজিদকে দেখিয়া একটু দূরে ছিলেন, অলীদের অবস্থা দর্শনে অসি সঞ্চালন করিয়া ভীমনাদে ওমরের দিকে আসিয়া প্রথমতঃ ওমরের অশ্বগ্রীবা লক্ষ্যে আঘাত করিতেই, বাজীরাজ শিরশূন্য হইয়া মৃত্তিকায় পড়িয়া গেল। বাম পার্শ্বে ফিরিয়া দ্বিতীয় আঘাতে এজিদের অশ্ব-মস্তক মৃত্তিকায় লুটাইয়া দিলেন। পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখেন যে, ওমর এখনো সুস্থির হইয়া দণ্ডায়মান হইতে পারে নাই; তৃতীয় আঘাতে বৃদ্ধ ওমরকে ধরাশায়ী করিলেন।

এজিদ ওমরের অবস্থা দেখিয়া তাড়াতাড়ি বল্লম হস্তে ওমর আলীর দিকে ধাইয়া যাইতেই, ওমর আলী সরিয়া গিয়া বলিলেন, “এজিদ এদিকে কেন আসিতেছ? যাও, হানিফার অস্ত্রাঘাত সহ্য কর গিয়া। ওমর আলী তোমার সৈন্য বিনাশ করিতে চলিল।”

দেখিতে দেখিতে ওমর আলী এজিদের চক্ষু হইতে অদৃশ্য হইলেন। এদিকে সিংহবিক্রমে ঘোর নিনাদে শব্দ হইতেছে, “জয়, জয়নাল আবেদীনের জয়! জয়, মদিনার সিংহাসনের জয়! জয়, নবভূপতির জয়!”

এজিদ ব্যস্ততাসহকারে চাহিতেই দেখিল যে, তাহার সৈন্যদলমধ্যে কোন দল পৃষ্ঠ দেখাইয়া মহাবেগে দৌড়িতেছে, কোন দল রণে ভঙ্গ দিয়া দাঁড়াইয়া আছে। বিপক্ষদলের আঘাতে অজ্ঞান জড় পদার্থের ন্যায় নীরবে আত্মবিসর্জন করিতেছে। আর রক্ষার উপায় নাই-কোথায় পতাকা, কোথায় বাদিত্রদল, কোথায় ধানুকী, কোথায় অশ্বারোহী, কোথায় অস্ত্র, কোথায় বেশভূষা-প্রাণ বাঁচানোই মূল কথা। এখন আর আশা নাই-এদিকে প্রহরী দ্বিতীয় অশ্বতরী যোগাইল। এজিদ ঘোড়ায় চড়িয়া দেখিল, রাজশিবির লুণ্ঠিত হইয়াছে, বিপক্ষদল অন্য অন্য শিবির লুণ্ঠন করিয়া আগুন লাগাইয়া দিয়াছে। সৈন্যগণ প্রাণভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়িয়া পলাইতেছে! মস্‌হাব কাক্কা, ওমর আলী, আক্কেল আলী প্রভৃতি তাহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইয়া অশ্বপৃষ্ঠ হইতে বর্শার আঘাতে ধরাশায়ী করিতেছে,-তরবারির আঘাতে শির উড়াইয়া দিতেছে। আবার জয়ধ্বনি, আবার সেই জনরব, এজিদ সেদিকে চাহিতেই দেখিল, অগণিত সৈন্য, সকলের হস্তেই উলঙ্গ অসি, মাঝে মাঝে ঊর্ধ্বদণ্ডে অর্ধচন্দ্র, আর পূর্ণতারা-সংযুক্ত দীন মোহাম্মদী নিশান, শুভ্র মেঘের আড়ালে উড়িতে উড়িতে জয়নাল আবেদীনের বিজয় ঘোষণা প্রকাশ করিতে করিতে নগরাভিমুখে যাইতেছে। এজিদ্ কিছুই বুঝিতে পারিল না, কেবল মধ্যে মধ্যে জয় ঘোষণায় জয়নালের নাম শুনিয়া মনে মনে সাব্যস্ত করিল যে, নিশ্চয় জয়নাল এই সৈন্য-প্রাচীরে বেষ্টিত হইয়া নগরে যাইতেছে-রাজপ্রাসাদে যাইতেছে। এখন কোথা যাই, কী করি! হতাশে চতুষ্পার্শ্বে দেখিতেই, দেখিল যে, সেই কালান্তক কাল-এজিদের মহাকাল, দ্বিতীয় আজরাইল-মোহাম্মদ হানিফা, রঞ্জিত কৃপাণহস্তে রক্তমাখা দেহে রক্তআঁখি ঘুরাইতে ঘুরাইতে, ‘কোথা এজিদ? কই এজিদ?’ বলিতে বলিতে আসিতেছেন। এজিদ প্রাণভয়ে অশ্বে কশাঘাত করিল। মোহাম্মদ হানিফাও এজিদের দ্রুতগতি অশ্বের দিকে দুল্‌দুল্ চালাইলেন।


© 2024 পুরনো বই