এক দুঃখের কথা শেষ না-হইতেই আর একটি কথা শুনিতে হইল। জয়নাল আবেদীনকে অদ্যই শূলে চড়াইয়া জেয়াদের প্রতিশোধ লইব, এজিদের এই প্রতিজ্ঞা।
জয়নাল বন্দিগৃহে নাই, একথা এজিদ্পক্ষীয় একটি প্রাণীও অবগত নহে। মারওয়ান কারাগারের বহির্দ্বারে উপস্থিত হইয়া প্রহরীকে অনুমতি করিল, “তোমরা কয়েকজন জয়নালকে ধরিয়া আন! সাবধান, আর কাহাকেও কিছু বলিয়ো না।”
মন্ত্রীবরের আজ্ঞায় প্রহরিগণ কারাগারমধ্যে প্রবেশ করিল। ক্ষণকাল পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “জয়নাল আবেদীন এ গৃহে নাই।”
মারওয়ানের মস্তক ঘুরিয়া গেল, অশ্বপৃষ্ঠে আর থাকিতে পারিল না। উদ্বিগ্নচিত্তে স্বয়ং অনুসন্ধান করিতে চলিল, কারাগৃহের প্রত্যেক কক্ষ তন্নতন্ন করিয়া দেখিল, কোন সন্ধান পাইল না। হোসেন-পরিজনের চিত্তবিকার এবং হাব-ভাব দেখিয়া নিশ্চয় বুঝিল, জয়নাল বিষয়ে ইঁহারাও অজ্ঞাত। বিলম্ব না করিয়া নগরমধ্যে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইল।
ওদিকে মোহাম্মদ হানিফা এক বিপদ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া দ্বিতীয় বিপদ সম্মুখে করিয়া বসিলেন। তিনি বলিতে লাগিলেন,-“যাহার জন্য মহাসংগ্রাম, যাহার উদ্ধার জন্য মদিনা হইতে দামেস্ক পর্যন্ত স্থানে স্থানে শোণিতপ্রবাহ, শত শত বীরবরের আত্মবিসর্জন, মদিনার সিংহাসন শূন্য,-হায়! হায়! সেই জয়নালের প্রাণবধ! ইহা অপেক্ষা দুঃখের কথা আর কী আছে? ওমর আলীকে ঈশ্বর রক্ষা করিয়াছেন, সেই ক্রোধে এজিদ্ জয়নালকে শূলে চড়াইয়া সংহার করিবে। হায়! হায়! যাহার উদ্ধার জন্য এতদূর আসিলাম, যাহার উদ্ধার জন্য এত আত্মীয়-বন্ধু হারাইলাম,-হায়! হায়! আজ স্বচক্ষে তাহার বধক্রিয়া দেখিতে হইল! কোন্ পথে কোন্ কৌশলে আনিয়া শূলে চড়াইবে, তাহার সন্ধান কী প্রকারে করি-উদ্ধারের উপায়ই-বা করি কি প্রকারে? সন্ধান করিয়া কোন ফল দেখি না। সামান্য সুযোগ পাইলে যে নিজের উদ্ধার নিজে করিতে পারিবে, সে ক্ষমতা কি তাহার মস্তকে আছে?”
“হায়! হায়! আমার সকল আশাই মিটিয়া গেল! কেন দামেস্কে আসিলাম? কেন এত প্রাণবধ করিলাম? কেন ওমর আলীকে কৌশলে উদ্ধার করিলাম? ওমর আলীর প্রাণ দিয়াও যদি জয়নালকে রক্ষা করিতে পারিতাম, তাহা হইলেও উদ্দেশ্য ঠিক থাকিত, বোধ হয়, ইমাম বংশও রক্ষা পাইত। দয়াময়! করুণাময়! জয়নালকে রক্ষা করিয়ো। আজ আমার বুদ্ধির বিপর্যয় ঘটিয়াছে! ভেরীর বাজনার সহিত ঘোষণার কথা শুনিয়া আমার মস্তকের মজ্জা শুষ্ক হইয়া যাইতেছে। ভ্রাতঃ ওমর আলী, ভ্রাতঃ আক্কেল আলী (বাহরাম), প্রিয় বন্ধু মস্হাব, চিরহিতৈষী গাজী রহমান কোথায়? তোমরা জয়নালের প্রাণ রক্ষার উপায় কর, আমি কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না, চতুর্দিক অন্ধকার দেখিতেছি!”
গাজী রহমান বলিলেন, “বাদশা নামদার! আপনি ব্যস্ত হইবেন না। ধৈর্য ধারণ করুন, পরম কারুণিক পরমেশ্বরের প্রতি নির্ভর করিলে অবশ্যই শান্তিবোধ হইবে। মনে করিলাম, আজই যুদ্ধ শেষ, জীবনের শেষ। যে কল্পনা করিয়া আজ পর্যন্ত এজিদের শিবির আক্রমণ করি নাই, সে কল্পনার ইতি এখনই হইয়া গেল। কোন উপায়ে অগ্রে জয়নালকে হস্তগত করাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। কারণ এজিদ্ রীতিনীতির বাধ্য নহে। স্বেচ্ছাচার কলঙ্করেখায় তাহার আপাদমস্তক জড়িত। এই দেখুন জেয়াদ মারা পড়িল, জয়নালের প্রাণবধের আজ্ঞা প্রচার হইল, এই সকল ভাবিয়া চিন্তিয়া স্থির করিয়াছিলাম, যেদিন জয়নাল হস্তগত হইবে, সেই দিনই এই যুদ্ধের শেষ অঙ্ক অভিনয় করিয়া এজিদ্বধ কাণ্ডে যবনিকা পতন করিব। বাদশা নামদার! যদি তাহাই না হইল, তবে আর বিলম্ব কী? ভ্রাতৃগণ! চিন্তা কী? সাজ সমরে! বন্ধুগণ! সাজ সমরে-বাজাও ডঙ্কা,-উড়াও নিশান,-ধর তরবারি-ভাঙ্গ শিবির-মার এজিদ্-চল নগরে-দাও আগুন, পুড়ুক দামেস্ক। আর ফিরিব না-জগতের মুখ আর দেখিব না। জয়নালকে হারাইয়া শুধু প্রাণ লইয়া স্বদেশেও যাইব না-এই প্রতিজ্ঞা। আজ গাজী রহমানের এই স্থির প্রতিজ্ঞা।”
মোহাম্মদ হানিফা গাজী রহমানের বাক্যে সিংহ গর্জনের ন্যায় গর্জিয়া উঠিলেন; আর-আর মহারথিগণও ঐ উৎসাহবাক্যে দ্বিগুণ উৎসাহান্বিত হইয়া “সাজ সমরে” “সাজ সমরে” মুখে বলিতে বলিতে মুহূর্তমধ্যে প্রস্তুত হইলেন। ঘোর রোলে বাজনা বাজিয়া উঠিল। মোহাম্মদ হানিফা অসি, চর্ম, তীর, খঞ্জর, কাটারি প্রভৃতিতে সজ্জিত হইয়া দুলদুলে আরোহণ করিলেন। সৈন্যগণ সমস্বরে ঈশ্বরের নাম করিয়া শিবির হইতে বহির্গত হইলেন।
সংবাদবাহিগণ এজিদ্ সমীপে করজোড়ে নিবেদন করিল, “মহরাজ! মোহাম্মদ হানিফা বহুসংখ্যক সৈন্যসহ মহাতেজে শিবিরাভিমুখে আসিতেছেন, এক্ষণে উপায়?-মন্ত্রীবর মারওয়ান শিবিরে নাই-সৈন্যগণও নিরুৎসাহ-যুদ্ধসাজের কোন আয়োজন নাই। কুফাধিপতির দুর্দশায় সকলেই ভয়ে আতঙ্কিত, উৎসাহ-উদ্যম কাহারো নাই। নৈরাশ্যের সহিত বিষাদমলিনরেখা সৈন্যগণের বদনে দেখা দিয়াছে।”
এজিদ্ মহাব্যস্ত হইয়া শিবির বহির্ভাগে গিয়া দেখিল যে, প্রান্তরের প্রস্তররাশি চূর্ণ করিয়া বালুকাকণা শূন্যে উড়াইয়া অসংখ্য সৈন্য শিবির আক্রমণে আসিতেছে।
এদিকে মন্ত্রীবর মারওয়ান ম্লানমুখ হইয়া উপস্থিত। বলিল-‘জয়নাল বন্দিগৃহে নাই, নগরেও নাই, বিশেষ সন্ধানে জানিলাম, জয়নালের কোন সন্ধান নাই। মহাবিপদ! চতুর্দিকেই বিপদ, সম্মুখেও ঘোর বিপদ! মহারাজ! সেই ঘোষণা প্রকাশেই এই আগুন জ্বলিয়াছে। মোহাম্মদ হানিফার হঠাৎ শিবির আক্রমণ করিবার কারণ আর কিছুই নহে-ঐ ঘোষণা-জয়নালের প্রাণদণ্ডের ঘোষণা।”
এজিদ্ মহা ভীত হইয়া বলিল, “এক্ষণে উপায়? সৈন্যগণের মনের গতি আজ ভাল নহে! হানিফাকে কোন কৌশলে ক্ষান্ত করিতে পারিলে কাল দেখিব। সৈন্যগণের হাবভাব দেখিয়া আজ আমি এক প্রকার হতাশ হইয়াছি।”
মারওয়ান বলিল, “এইক্ষণে সে সকল কথা বলিবার সময় নহে, শত্রুগণ প্রায় আগত। জয়নাল আবেদীন নগরে নাই, বন্দিগৃহে নাই, একথা প্রকাশ হইলে যে কথা-শূলে চড়াইয়া তাহার প্রাণবধ করিলেও সেই কথা। এখন এই উপস্থিত আক্রমণ হইতে রক্ষার উপায় করাই আবশ্যক। বিপক্ষদলের যেরূপ রুদ্রভাব, উগ্রমূর্তি দেখিতেছি, ইহাতে কি যে ঘটিবে বুঝিতেছি না, চেষ্টার ত্রুটি করিবে না।”
মারওয়ান তখনই সন্ধিসূচক নিশান উড়াইয়া দিল এবং জনৈক বিশ্বাসী দূতকে কয়েকটি কথা বলিয়া সেই বীরশ্রেষ্ঠ বীরগণের সম্মুখে প্রেরণ করিল।
মোহাম্মদ হানিফা এবং তাঁহার অপরাপর আত্মীয়গণ দূতের প্রতি একযোগে অসি উত্তোলন করিয়া বলিলেন, “রাখ্ তোর সন্ধি! রাখ্ তোর সাদা নিশান!”
গাজী রহমান ত্রস্তে মোহাম্মদ হানিফার সম্মুখীন হইয়া বলিলেন, “বাদশা নামদার! ক্ষান্ত হউন! পরাজিত শত্রু মহাবীরেরও বধ্য নহে-বিশেষ দূত। রোষপরবশ হইয়া রাজবিধি রাজপদে দলিত করিবেন না। অস্ত্র কোষে আবদ্ধ করুন। দূতবরের প্রার্থনা শুনিতেই হইবে, গ্রাহ্য করা-না-করা নামদারের ইচ্ছা।”
হানিফা লজ্জিত হইয়া হস্ত সঙ্কুচিত করিলেন; তরবারি পিধানে রাখিয়া বলিলেন, “গাজী রহমান, তুমি যথার্থই আমার বুদ্ধিবল। দুর্দমনীয় ক্রোধেই লোকে মূর্খতা প্রকাশ করে-মানুষকে নিন্দার ভাগী করে। যাহা হউক, তুমি দূতবরের সহিত কথা বল।”
এজিদ্-দূত মহা সমারোহে মোহাম্মদ হানিফাকে অভিবাদন করিয়া বলিল, “জয়নাল আবেদীনকে শূলে চড়াইয়া বধ করিবার ঘোষণা রহিত করা গেল, শূলদণ্ড এখনই উঠাইয়া ফেলিবে। আমাদের সৈন্যগণ মহাক্লান্ত,-বিনা যুদ্ধেই আজ আমরা পরাভব স্বীকার করিলাম। যদি ইহাতেই আপনারা চিরজয় মনে করেন, তবে মহারাজ এজিদ্ তাঁহার হস্তস্থিত তরবারি যাহা ভূমিতে রাখিয়া দিয়াছেন, আর তাহা হস্তে স্পর্শ করিবেন না। গলায় কুঠার বাঁধিয়া আগামীকল্য আপনার শিবিরে উপস্থিত হইয়া আত্মসমর্পণ করিবেন।”
গাজী রহমান বলিলেন, “যদি জয়নাল আবেদীনের প্রতি কোনরূপ অত্যাচার না হয় এবং তাহার প্রাণের প্রতিভূ মহারাজ এজিদ্ হউন, তবে আমরা আজকার মত কেন-যত দিন যুদ্ধ ক্ষান্ত রাখিতে ইচ্ছা করেন-সম্মত আছি। বিনা যুদ্ধে, কী দৈববিপাকে, কী অপ্রস্তুতজনিত, কী অপারগতা হেতু, পরাভব স্বীকার করিলে আমরা তাহাতে জয় মনে করি না। যে সময় তোমাদের তরবারির তেজ কম হইবে, সমর-প্রাঙ্গণ হইতে প্রাণভয়ে পলাইতে থাকিবে, শৃগাল-কুক্কুরের ন্যায় তাড়াইতে থাকিব, কোথায় নিশান, কোথায় ব্যূহ, কোথায় কে, কে স্বপক্ষ, কে বিপক্ষ জ্ঞান থাকিবে না, রক্তস্রোতে রঞ্জিত দেহ সকল ভাসিয়া যাইবে, কোন স্থানে তোমাদের সৈন্য দেহখণ্ড খণ্ডিত অশ্বদেহে শোণিত-সংযোগ জমাট বাঁধিয়া গড়াইতে থাকিবে, কোন স্থানে দ্বীপাকার ধারণ করিবে, শিরশূন্য কবন্ধ সকল রক্তের ফোয়ারা ছুটাইয়া নাচিতে নাচিতে হেলিয়া-দুলিয়া শবদেহের উপর পড়িয়া হাত-পা আছড়াইতে থাকিবে, আমরা বীরদর্পে বিজয় নিশান উড়াইয়া দামেস্ক রাজপাটে জয়নাল আবেদীনকে বসাইয়া রক্তমাখা শরীরে র িত তরবারি সকল মহারাজ জয়নাল আবেদীনের সম্মুখে রাখিয়া মহারাজাধিরাজ সম্ভাষণে নতশিরে দণ্ডায়মান হইব,-তোমাদের মধ্যে যদি কেহ জীবিত থাকে, তবে সেও আমাদের সহিত ঐ অভিষেক-ক্রিয়ায় যোগদান করিবে, নগরময় যখন অর্ধচন্দ্র আর পূর্ণ তারা চিহ্নিত পতাকা সকল উড়িতে থাকিবে, দূতবর! সেই দিন যথার্থ জয়ী হইলাম, মনে করিব। অন্য প্রকার জয়ের আশা আমাদের অন্তরে নাই। যাও দূতবর, তোমার রাজাকে গিয়া বল-আমরা যুদ্ধে ক্ষান্ত দিলাম। যেদিন তোমাদের সমর-নিশান শিবিরশিরে উড়িতে দেখিব, ভেরীর বাজনা স্বকর্ণে শুনিব, সেইদিন আমাদের তরবারির চাক্চিক্য, তীরের গতি, বর্শার চাল, অশ্বের দাপট, নিশানের ক্রীড়া সকলই দেখিতে পাইবে। আজ ক্ষান্ত দিলাম। কিন্তু পুনরায় বলিতেছি, জয়নালের প্রাণ তোমাদের রাজার প্রতিভূতে রহিল। যাও দূতবর, শিবিরে যাও। আমরা শিবিরে চলিলাম।”