উদ্ধার পর্ব ১১ প্রবাহ

এজিদের গুপ্তচরের অনুসন্ধান যথার্থ। তোগান ও তুর্কীয় ভূপতিদ্বয় সসৈন্যে মোহাম্মদ হানিফার সাহায্যে মদিনাভিমুখে যাইতেছেন এবং দিনমণি অস্তাচলে গমন করায়, গমনে ক্ষান্ত দিয়া বিশ্রাম-সুখ অনুভব করিতেছেন। প্রহরিগণ ধনু হস্তে শিবির রক্ষার্থে দণ্ডায়মান। শিবিরের চতুর্দিকে আলোকমালা সজ্জিত। ভূপতিগণ স্ব-স্ব নিরূপতি স্থানে অবস্থিত। শিবিরমধ্যে বিশ্রাম, আয়োজন, রন্ধন, কথোপকথন, স্বদেশ-বিদেশের প্রভেদ, জলবায়ুর গুণাগুণ, দ্রব্যাদির মূল্য, আচার-ব্যবহারের আলোচনা, নানা প্রকার কথা এবং আলাপের স্রোত চলিতেছে।

ওদিকে সীমার সসৈন্যে মহাবেগে আসিতেছে। সীমারের মনে আশা অনেক। হোসেনের মস্তক দামেস্কে আনিয়া পুরস্কার পাইয়াছে, আবার এই বৃহৎ কার্যে কৃতকার্য হইতে পারিলে বিশেষ পুরস্কার লাভ করিবে। ক্রমে মানমর্যাদার বৃদ্ধির সহিত পদবৃদ্ধির নিতান্তই সম্ভাবনা। যদি বিপক্ষদলের সহিত দেখা হয়, তবে প্রকাশ্যভাবে যুদ্ধ করিবে, কি নিশাচর নরপিশাচের ন্যায় গুপ্তভাবে আক্রমণ করিবে-এ চিন্তাও অন্তরে উদয় হইয়াছে। কি করিবে, আজ মহারাজ এজিদের সৈন্যাধ্যক্ষ পরিচয়ে দণ্ডায়মান হইবে, কি দস্যু নামে জগৎ কাঁপাইবে-এ পর্যন্ত মীমাংসা করিতে পারে নাই। যাইতে যাইতে আগন্তুক রাজগণের শিবির বহির্দ্বারস্থ আলোকমালা দেখিতে পাইল। স্থায়ী গৃহ নহে, চিরস্থায়ী রাজপুরী নহে,-নিশোপযোগী বস্ত্রবাস মাত্র। তাহারই সম্মুখস্থ আলোকমালার পারিপাট্য দেখিয়া সীমার আশ্চর্যান্বিত হইল। যতই অগ্রসর হইতে লাগিল, ততই নয়নের তৃপ্তি বোধ হইতে লাগিল। শিবিরের চতুষ্পার্শ্বেই প্রহরী হস্তে তীরধনু, বিশেষ সতর্কতার সহিত প্রহরীরা আপন-আপন কার্য করিতেছে। সাবধানের মার নাই! সীমারের পথপ্রদর্শক গুপ্তচরদিগের হস্তস্থিত দীপশিখা শিবির রক্ষীদিগের চক্ষে পড়িবামাত্র তাহারা পরস্পর কি কথা বলিয়া শরাসনে বাণ যোজনা করিল। সীমারদলের দক্ষিণ ও বাম পার্শ্ব দিয়া সমযোগে দুইটি শর বজ্র শব্দে চলিয়া গেল। পাষাণহৃদয় সীমারের অঙ্গ শিহরিয়া হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল। ক্রমেই সুতীক্ষ্ণ বাণ উপর্যুপরি সীমার-সৈন্য মধ্যে আসিয়া পড়িতে লাগিল। শিবিরমধ্যে সংবাদ রটিয়া গেল যে, দস্যুদল অগ্নি জ্বালিয়া শিবির লুণ্ঠন করিতে আসিতেছে। তাহাদের যে প্রকার গতি দেখিতেছি, অল্প সময়মধ্যে শিবির আক্রমণ করিবে। সকলেই অস্ত্রশস্ত্রে প্রস্তুত হইলেন। তাহাদের জ্বালিত আলোকাভায় অস্ত্রের চাক্চিক্য, অশ্বের অবয়ব, সৈন্যের সজ্জিত বেশ সকলেই দেখিতে লাগিলেন, কিন্তু তমোময়ী নিশার প্রতিবন্ধকতায় নিশ্চয়রূপে নির্ণয় করিতে পারিলেন না, দস্যু কী রাজসৈন্য। গুপ্তসন্ধানীরাও সন্ধান করিয়া কিছু স্থির করিতে পারিল না! মহা সঙ্কট! সীমারের দুইটি চিন্তার একটি নিষ্ফল হইল। দস্যুভাবে আক্রমণ করিতে আর সাহস হইল না। প্রকাশ্যভাবে আক্রমণ করিবে স্থির করিয়া রণবাদ্য বাজাইতে আরম্ভ করিল।

আর সন্দেহ কি? আগন্তুক সৈন্যদল জনৈক দূত পাঠাইয়া তত্ত্বজিজ্ঞাসুর অভিমত হইতে, কাহারো কাহারো অমত হইল। তাঁহারা বলিলেন, “এই দল প্রথমে দস্যুভাবে, শেষে প্রকাশ্য রণবাদ্য বাজাইয়া আসিয়াছে, ইহাদিগকে বিশ্বাস নাই! সমর পদ্ধতি চির প্রচলিত বিধি, এ আগন্তুক শত্রুর নিকট আশা করা যাইতে পারে না। এই দলের অধিনায়ক খ্যাতনামা বীর হইলেও এইক্ষণে তিনিও নিতান্ত নীচ প্রবৃত্তির পরিচয় দিয়াছেন, অতএব কখনোই উহার নিকট দূত পাঠান কর্তব্য নহে।”

শিবিরস্থ প্রায় সকল লোকই দেখিলেন যে, আগন্তুক দল ক্রমে তিন দলে বিভক্ত হইয়া দক্ষিণ ও বামে দুই দল চলিয়া গেলে এক দল স্থিরভাবে যথাস্থানে দণ্ডায়মান রহিল। নিশীথ সময়ে যুদ্ধ কী ভয়ঙ্কর! শিবিরস্থ মন্ত্রীদল মন্ত্রণায় বসিলেন। শেষে সাব্যস্ত হইল, এক্ষণে কেবল আত্মরক্ষা, নিশাবসান হইলে চক্ষু দেখিয়া যাহা বিবেচনা হয় যুক্তি করিব। তবে রক্ষীরা আত্মরক্ষা ও শত্রুগণের আক্রমণে বাধা জন্মাইতে কেবল তীর-ধনুক যাহা করিতে পারে, তাহাই করুক, নিশাবসান না হইলে অন্য কোন প্রকারের অস্ত্র ব্যবহার করা যাইবে না। যতক্ষণ প্রভাতবায়ু বহিয়া না যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত অবিশ্রান্ত তীর চলিতে থাকুক। ইহারা কে, কেন, আমাদের সহিত যুদ্ধ করিতে আসিল, তাহার এ পর্যন্ত কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই। সন্ধান না লইয়া, শত্রুবল না বুঝিয়া আক্রমণ বৃথা। অনিশ্চিত অপরিচিত আগন্তুক শত্রুর সহিত হঠাৎ যুদ্ধ করা শ্রেয়স্কর নহে।

সীমার প্রেরিত সৈন্যদল দুই পার্শ্ব হইতে অগ্রসর হইতে হইতে পুনঃ একত্র মিশিয়া অর্ধচন্দ্রাকৃতিভাবে শিবিরাভিমুখে যাইতে লাগিল। ক্রমেই অগ্রসর, ক্রমেই আক্রমণের উদ্যোগ!

এ যুদ্ধ দেখে কে? এ বীরগণের প্রশংসা করে কে? সীমার বাহাদুরির যশোগান মুক্তকণ্ঠে গায় কে? জাগে নক্ষত্র, জাগে নিশা, জাগে উভয় দলের সৈন্যদল। কিন্তু দেখে কে?

সীমার দল এবং তাহার অর্ধচন্দ্রাকৃতি দল অগ্রসরে ক্ষান্ত হইল। আর পদবিক্ষেপের সাহস হইল না। শিবিরের চতুর্দিক হইতে অনবরত তীর আসিতে লাগিল। সীমারপক্ষীয় বিস্তর সৈন্য তীরাঘাতে হত-আহত হইয়া ভগ্নোৎসাহ হইয়া পড়িল। উভয় দলেই দুই হস্তে নিশাদেবীকে তাড়াইয়া ঊষার প্রতীক্ষা করিতেছেন-গগনের চিহ্নিত নক্ষত্র-প্রতিও বারবার চক্ষু পড়িতেছে। দেখিতে দেখিতে শুকতারা দেখা দিল, শিবিররক্ষীদিগের তীরও তূণীরে উঠিল। কারণ প্রভাতীয় উপাসনার সময় প্রায় সমাগত; এ সময় অস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ। বিপক্ষদল তীর নিক্ষেপে ক্ষান্ত হইলেও, সীমার সৈন্য একপদ ভূমিও অগ্রসর হইতে সাহসী হইল না। সীমারের জ্বলন্ত উত্তেজনা বাণীতেও তাহাদের হস্তপদ আর উঠিল না। সকলেরই প্রভাতের প্রতীক্ষা।

শিবিরস্থ মন্ত্রীদল দেখিতেছেন, শিবিরের চতুর্দিকেই বিপক্ষ সৈন্য, আপনারা এক প্রকারে বন্দি! এ আগন্তুক শত্রুর হস্ত হইতে পরিত্রাণ না পাইলে মদিনা যাওয়া কঠিন। উভয় দলই ঊষাদেবীর প্রতীক্ষায় দণ্ডায়মান। ক্রমে প্রদীপ্ত দীপশিখার তেজ হ্রাস হইতে আরম্ভ হইল-ঘোর অন্ধকারে তরলতা প্রবেশ করিল। দেখিতে দেখিতে প্রভাতবায়ুর সহিত ক্ষণস্থায়ী ঊষাদেবী ধবল বসনে ঘোমটা টানিয়া, পূর্ব দিক হইতে রজনী-দেবীকে সরাইয়া সরাইয়া দিনমণির আগমনপথ পরিষ্কার করিয়া দিলেন! উভয় দলই পরস্পরের চক্ষে পড়িল।

সীমার পক্ষ হইতে জনৈক অশ্বারোহী সৈন্য দ্রুতবেগে শিবিরের নিকট আসিয়া বলিতে লাগিল, “তোমরা যে উদ্দেশ্যে যেখানে যাইতেছ, ক্ষান্ত হও! যদি প্রাণের আশা থাকে গমনে ক্ষান্ত হও-আর যাইতে পারিবে না। যদি চক্ষু থাকে, তবে চাহিয়া দেখ, তোমরা মহারাজ এজিদের প্রধান বীর সীমারের কৌশলে এখন বন্দি! পরের জন্য কেন প্রাণ হারাইবে? তোমাদের সহিত মহারাজ এজিদের কোন প্রকারের বাদ-বিসম্বাদ নাই। তোমাদের কোন বিষয়ে অভাব কি অনটন হইয়া থাকে, বল-আমরা অভাব পূরণ করিতে প্রস্তুত আছি। মানে মানে প্রাণ লইয়া স্ব-স্ব রাজ্যে গমন কর। মদিনাভিমুখে যাইবার কথা আর মুখে আনিয়ো না। যদি এই-সকল কথা অবহেলা করিয়া মদিনাভিমুখে যাইতে কিঞ্চিৎ অগ্রসর হও, তবে, জানিয়ো, মরণ অতি নিকট। এখন তোমাদের ভাল-মন্দের ভার তোমাদের হস্তে।”

শিবিরবাসীদের পক্ষ হইতে কেহ তাহার নিকটে আসিল না, কেহ তাহার কথায় উত্তর করিল না। কিন্তু কথা শেষের সহিত,-লাখে-লাখে ঝাঁকে-ঝাঁকে তীরসকল গগন আচ্ছন্ন করিয়া, স্বাভাবিক শন্‌শন্ শব্দে আসিতে লাগিল। আক্রমণ ও বাধার আশা, অতি অল্প সময়মধ্যেই সীমারের অন্তর হইতে অপসৃত হইয়া গেল। সীমারের সৈন্যগণ আর তিষ্ঠিতে পারিল না। আঘাত সহ্য করিতেছে, মরিতেছে, কেহ অজ্ঞান হইয়া পড়িতেছে, রক্তবমন করিতেছে, বক্ষ হইতে রক্তের ধারা ছুটিতেছে, চক্ষু উল্টাইয়া পড়িতেছে, ক্ষত-বিক্ষত হইয়া মহা অস্থির হইয়া পলাইতেছে; আবার কেহ ধরাশায়ী হইয়া নাকে-মুখে শোণিত উদ্গগীরণ করিয়া প্রাণ বিসর্জন করিতেছে।

সীমারের চাতুরী বুঝিয়া উঠা বড়ই কঠিন। সন্ধির প্রস্তাবে দূত প্রেরণ করিল। শিবিরস্থ সৈন্যগণের সুতীক্ষ্ণ তীর তূণীরে প্রবেশ করিল, ক্ষণকালের জন্য যুদ্ধ স্থগিত রহিল।

সীমার-প্রেরিত দূতের প্রার্থনা এই যে, “আমরা বহু দূর হইতে আপনাদের অনুসরণে আসিয়া মহাক্লান্ত হইয়াছি। আজিকার মত যুদ্ধ ক্ষান্ত থাকুক;-আগামী প্রভাতে আমরা প্রস্তুত হইব। যদি বিবেচনা হয়, তবে বিনাযুদ্ধে মদিনার পথ ছাড়িয়া দিব। আমার মহাক্লান্ত!”

শিবিরস্থ মন্ত্রীদল মধ্যে তুর্কীর মন্ত্রী বলিলেন, “আমরা সম্মত হইলাম, ক্লান্ত শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র উত্তোলন করিলে, অস্ত্রের অবমাননা করা হয়। আমরা ক্ষান্ত হইলাম। তোমরা পথশ্রান্তি দূর কর।”

সীমারদূত যথাবিধি অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিল।

সীমার চিন্তায় মগ্ন হইল। অনেকক্ষণের পর সীমারের কথা ফুটিল-প্রকাশ্য যুদ্ধে পারিব না। কখনই পারিব না। এই তীরের মুখে আমরা টিকিতে পারিব না। কৌশলে, না হয় অর্থে কার্যসিদ্ধি হইবে, বাহুবলের আশা বৃথা। সীমার উঠিলেন। পরিচারকগণকে বলিলেন, “আমার এই সকল যুদ্ধসাজ, অস্ত্রশস্ত্র, বেশভূষা রাখিয়া দাও, যদি কখনো অস্ত্র হস্তে লইবার উপযুক্ত হই, তবে লইব। নতুবা এই রাখিলাম। সীমার আর উহা স্পর্শ করিবে না। যুদ্ধসাজ অস্ত্রশস্ত্র আমাদের উপযুক্ত নহে, তুর্কী ও তোগানের সৈন্যগণই উহার যথার্থ অধিকারী।”


© 2024 পুরনো বই