উদ্ধার পর্ব ০৯ প্রবাহ

ওত্‌বে অলীদ সৈন্যসহ মদিনা-প্রবেশপথের প্রান্তরে হানিফার অপেক্ষায় রহিয়াছে। একদা সায়াহ্নকালে কয়েকজন অনুচরসহ নিকটস্থ শৈলশিখরে বায়ু সেবন আশায় সজ্জিত বেশে বহির্গত হইল। পাঠক! যে স্থানে মায়মুনার সহিত মারওয়ান নিশীথ সময়ে কথা কহিয়াছিল, এই সেই পর্বত। হোসেনের তরবারির চাক্চিক্য দেখিয়া যে পর্বতের গুহায় অলীদ লুকাইয়াছিল, এই সেই পর্বত! শৈলশিখরে বিহার করিবে, প্রকৃতির স্বাভাবিক শোভা দেখিয়া নয়ন পরিতৃপ্ত করিবে, এই আশাতেই এখানে অলীদের আগমন। আশার অভ্যন্তরে যে একটু স্বার্থ না আছে তাহাও নহে। স্বাভাবিক দৃষ্টির বহির্ভূত যদি কোন ঘটনা ঘটিবার লক্ষণ অনুমান হয়, প্রত্যক্ষভাবে তাহা দেখিবার জন্য দূরদর্শন যন্ত্রও সঙ্গে আনিয়াছে। অশ্বতরী সকল সমতল ক্ষেত্রে রাখিয়া জন কয়েক অনুচরসহ পর্বতে আরোহণ করিল। প্রথমে মদিনানগরের দিকে যন্ত্রাশ্রয়ে ঈক্ষণ করিয়া দেখিল, নীলবর্ণ পতাকা সকল উচ্চমঞ্চে উড়িয়া হোসেনের মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করিতেছে। অন্যদিকে দেখিল, খর্জুর বৃক্ষের শাখা সকল বাতাঘাতে উন্মত্ত ভাব ধারণ করিয়া হোসেনের শোকে মহাশোক প্রকাশ করিতেছে। তাহার পর সম্মুখ দিকে ঈক্ষণ করিতেই হস্ত কাঁপিয়া গেল। যন্ত্রটি সুবিধা মত ধরিয়া দেখিল, সন্দেহ ঘুচিল না। আবার বিশেষ মনোযোগের সহিত দেখিল, সন্দেহ ঘুচিয়া নিশ্চিত সাব্যস্ত হইল। এখন কথা-এ কা’র সৈন্য? এমন সুসাজে সুসজ্জিত হইয়া মদিনাভিমুখে আসিতেছে,-এ সৈন্যশ্রেণী কার? তুরগগুলি গায়ে গায়ে মিশিয়া নৃত্য করিতে করিতে অগ্রসর হইতেছে; অশ্বারোহীদের অশ্বপৃষ্ঠে বসিবারই কি পরিপক্বতা; অস্ত্র ধরিবারই-বা কি পারিপাট্য; বেশভূষা, কান্তি, গঠন, অতি চমৎকার, মনোহর এবং নয়নের তৃপ্তিকর। ইহারা কে? শত্রু-না মিত্র? আবার দূরদর্শন যন্ত্র চক্ষু দিয়া সঙ্গিগণকে বলিলেন, “তোমরা একজন শীঘ্র শিবিরে যাইয়া শ্রেণীবিভাগের অধ্যক্ষগণকে সংবাদ দাও যে, অর্ধচন্দ্র আর পূর্ণতারাসংযুক্ত পতাকা গগনে দেখা গিয়াছে, প্রস্তুত হও।”

আজ্ঞামাত্র একজন সহচর দ্রুতগতি তুরগপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া প্রস্থান করিল।

অলীদ আবার দূরদর্শনে মনোনিবেশ করিল। আগন্তুক সৈন্যগণ আর অগ্রগামী হইতেছে না,-শ্রেণীবদ্ধমত নানা শ্রেণীতে বিভক্ত হইয়া দণ্ডায়মান হইল। আরো দেখিল যে, একজন অশ্বারোহী দ্রুতবেগে চলিয়া আসিতেছে। তৎক্ষণাৎ তূণীর হইতে তীর বাহির করিয়া ধনুকে টঙ্কার দিল। অশ্বারোহীর প্রতি লক্ষ্য করিতেই দেখিল, সে জাতীয় চিহ্নযুক্ত শুভ্র নিশান উড়াইয়া সংবাদবাহীর পরিচয় দিতে দিতে নক্ষত্রবেগে ছুটিয়াছে। সামরিক বিধির মস্তকে পদাঘাত করিয়া দূতবরের বক্ষ লক্ষ্যে শর নিক্ষেপ করিবে, কি উত্তোলিত হস্ত ধনুর্বাণসহ সঙ্কুচিত করিবে এই চিন্তা করিতে করিতে দূতবর পর্বত পার্শ্ব হইতে চক্ষের নিমিষে তাহার শিবিরাভিমুখে চলিয়া গেল। অলীদ চক্ষু ফিরাইয়া কেবল ধাবিত অশ্বের পুচ্ছসঞ্চালন, আর নিশানের অগ্রভাগ মাত্র দেখিল।

কি করিবে এখনো কিছুই সাব্যস্ত করিতে পারেন নাই। পরিশেষে তাহার হিংসাপূর্ণ হৃদয় স্থির করিল যে, যে কৌশলেই হউক, মোহাম্মদীয়গণকে বিনাশ করাই শ্রেয়ঃ। নিশ্চয়ই মোহাম্মদ হানিফা মদিনায় আসিতেছেন। হানিফার দূতকে গুপ্তভাবে বধ করিলে কে জানিবে? কে জানিবে যে, এ কার্য একজন প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ দ্বারা সংঘটিত হইয়াছে? যে শুনিবে, সেই বলিবে, কোন দস্যু কর্তৃক এরূপ বিপরীত কাণ্ড ঘটিয়াছে। এই ভাবিয়া পুনরায় আপন আয়ত্তমত ধনুর্বাণ ধারণ করিল। মনে মনে বলিল, “পুনঃ এই পথে আসিলেই একেবারে দেখিব, দেখিব, দেখিব!” কিন্তু এই বলিতে বলিতেই তাহার কর্ণে দ্রুতগতি অশ্ব পদ-প্রতিশব্দ প্রবেশ করিল। চক্ষু ফিরাইয়া দেখিল, সেই অশ্ব, সেই নিশান, সেই দূত। দূতবরের বক্ষ লক্ষ্য করিয়া তীর নিক্ষেপ করিবে, অলীদের এই উদ্যোগেই দূতবর তাহার লক্ষ্য ছাড়াইয়া বহু দূরে সরিয়া পড়িলেন, অলীদের হাতের তীর হাতেই রহিয়া গেল। বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখিল, দূতবর আগন্তুক সৈন্যমধ্যে যাইয়া মিশিলেন। ওত্‌বে অলীদ পর্বত বিহার পরিত্যাগ করিয়া সহচরগণসহ শিবিরে আসিবার জন্য শিখর হইতে অবরোহণ করিল।

মোহাম্মদ হানিফার প্রেরিত দূত অলীদ-শিবিরে অল্প সময়মধ্যে যাহা যাহা জানিয়া গিয়াছেন, সমুদয় মোহাম্মদ হানিফার গোচর করিয়া বলিলেন, “বিনাযুদ্ধে মদিনায় যাওয়ার সাধ্য নাই। সৈন্যগণ বীরসাজে সজ্জিত-প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ ওত্‌বে অলীদ মহোদয় এক্ষণে শিবিরে নাই।”

এই সকল কথা হইতেছে, এমন সময়ে বিপক্ষ দূত শিবির দ্বারে আসিয়া উপস্থিত। মোহাম্মদ হানিফার আজ্ঞায় বিপক্ষ দূত সমাদরে আহূত হইয়া শিবিরমধ্যে প্রবেশ করিল। বিশেষ সম্মানের সহিত অভিবাদন করিয়া দূতবর বলিল, “বাদশাহ নামদার! মহারাজ এজিদের আজ্ঞা এই যে, সংস্রবশূন্য নগরে প্রবেশ করিতে, বিশেষ সৈন্যসামন্তসহ পর রাজ্যে আসিতে স্থানীয় রাজার অনুমতি আবশ্যক। আপনি সে অনুমতি গ্রহণ করেন নাই; সুতরাং আর অগ্রসর হইবেন না! আর একপদ ভূমি অগ্রসর হইলেই রাজপ্রতিনিধি মহাবীর অলীদ আপনার গমনে বাধা দিতে সৈন্যসহ অগ্রসর হইবেন। আর আপনি যদি হোসেন-পরিবারের সাহায্যের জন্য আসিয়া থাকেন, তবে ন্যূনতা স্বীকারপূর্বক স্বদেশে ফিরিয়া যাইবার প্রার্থনা করিলেও যাইতে পারিবেন না; বন্দিভাবে দামেস্কে যাইতে হইবে।”

দূতবর নিজ প্রভুর আজ্ঞা প্রকাশ করিয়া নতশিরে পুনরায় অভিবাদন করিয়া দণ্ডায়মান হইলে, গাজী রহমান বলিতে লাগিলেন, “দূতবর! তোমার রাজপ্রতিনিধি বীরবর অলীদ মহোদয়কে গিয়া বল, আপনার রাজ্যে প্রবেশ করিতে কাহারো অনুমতির অপেক্ষা করে না। হোসেনের-পরিজনকে কারাগারে হইতে উদ্ধার করাই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য এবং হাসান-হোসেনের প্রতি যিনি যে প্রকার ব্যবহার করিয়াছেন তাহার সমুচিত প্রতিবিধান করিতে আমরা কখনোই ভুলিব না। পৈতৃক দামেস্ক রাজ্য, মাবিয়ার পুত্র এজিদ্ যাহা নিজরাজ্য বলিয়া দামেস্ক সিংহাসনের অবমাননা করিয়াছে, তাহাকে সমুচিত শাস্তিবিধান করিব। মদিনায় প্রবেশ করিয়া আমাদের গতি ক্ষান্ত হইবে না। অলীদের লক্ষাধিক সৈন্য-শোণিতে আমাদের চিরপিপাসু তরবারির শোণিত-পিপাসা মিটিবে না! এজিদের এক-একটি সৈন্যশরীর শত খণ্ডিত করিলেও আমাদের তরবারির তেজ কমিবে না। ক্রোধ নিবৃত্তি হইবে না। বন্দিভাবে আমাদিগকে দামেস্কে পাঠাইতে হইবে না-এই সজ্জিতবেশে, এই বীরবেশে, বিজয় নিশান উড়াইয়া, রণভেরী বাজাইতে বাজাইতে শৃগাল-কুকুরের ন্যায় শত্রুবধ করিতে করিতে আমরা দামেস্ক নগরে প্রবেশ করিব। আমাদের বিশ্রাম-বিরাম-ক্লান্তি কিছুই নাই। এখন মদিনায় প্রবেশ করিব। তুমি শিবিরে যাইতে-না-যাইতে দেখিবে-যুদ্ধ নিশান উড়িয়াছে, আমরাও শিবিরের নিকটবর্তী।”

দূতবর নতশিরে অভিবাদন করিয়া বিদায় হইলেন। তাঁহার শিবির হইতে বহির্গত হওয়া মাত্রেই সুনীল আকাশে মোহাম্মদ হানিফার পক্ষে লোহিত ধ্বজা উড়িতে লাগিল। ঘোররবে রণভেরী বাজিয়া উঠিল। কাড়া-নাকাড়া ও ডঙ্কা ঝাঁজরি শারদীয় ঘনঘটাকে পরাজয় করিয়া চতুর্দিক আলোড়িত করিয়া তুলিল। তুরঙ্গসকল কর্ণ উচ্চ করিয়া পুচ্ছ-গুচ্ছ স্বাভাবিক ঈষৎ বক্রভঙ্গিতে হ্রেষারবে নৃত্য করিতে করিতে অগ্রসর হইতে লাগিল। পদাতিক সৈন্যরাও বীরদর্পে পদক্ষেপণ করিতে লাগিল। বহুদূর ব্যাপিয়া প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। মোহাম্মদ হানিফার অন্তরে ভ্রাতৃবিয়োগ শোক, পরিবারের কারারোধ-বেদনা বা জয়নালের উদ্ধার চিন্তার নাম এখন নাই। এখন একমাত্র চিন্তা-মদিনায় প্রবেশ ও হজরত নূরনবী মোহাম্মদের রওজা ‘জিয়ারত’ (ভক্তি দর্শন)। কিন্তু মুখের ভাব দেখিলে বোধ হয় যে তিনি নিশ্চিন্তভাবে সৈন্য-শ্রেণীকে উৎসাহের দৃষ্টান্ত সাহসের আদর্শ ও বীরজীবনের উপমা দর্শন করাইয়া মহানন্দে অশ্ব চালাইয়া যাইতেছেন। এজিদ্পক্ষেও সমর-প্রাঙ্গণ-সীমার নির্দিষ্ট লোহিত নিশান নীলাকাশে দেখা দিয়াছে। সৈন্যশ্রেণী সপ্তশ্রেণীতে পঞ্চপ্রকার ব্যূহ নির্মাণ করিয়া দণ্ডায়মান হইয়াছে। কোন ব্যূহ চতুষ্কোণে স্থাপিত, কোন ব্যূহ পশু-পক্ষীর শরীরের আদর্শে গঠিত। আক্রমণ এবং বাধা উভয়ভাবেই অটল।

গাজী রহমান বলিলেন,-“অলীদ যে প্রকারে ব্যূহ নির্মাণ করিয়া আক্রমণ এবং বাধা দিতে দণ্ডায়মান, এ সময় একটু বিবেচনার আবশ্যক হইতেছে। আমাদের সৈন্যসংখ্যা অপেক্ষা বিপক্ষসৈন্য অধিক-তাহাতে সন্দেহ নাই। সম্মুখযুদ্ধে আমাদের আম্বাজী সৈন্যগণ সুদক্ষ। এত অধিক বিপক্ষ সৈন্যের মধ্যে পড়িয়া ব্যূহ ভেদ করিলেও আমাদের বিস্তর সৈন্যক্ষয় হইবে। কিছুক্ষণের জন্য শত্রুদিগকে দ্বৈরথ যুদ্ধে আহ্বান করাই যুক্তিসঙ্গত। যদি অলীদের আর সৈন্য না থাকে তবে অবশ্যই তাহাকে রচিত ব্যূহ ভগ্ন করিয়া যুদ্ধার্থে সৈন্য পাঠাইতে হইবে। একজন আম্বাজী সৈন্য যদি দশজন কাফেরকে নরকে প্রেরণ করিয়া শহীদ হয় সেও সৌভাগ্য।”

মোহাম্মদ হানিফা গাজী রহমানের বাক্যে অশ্বগতি রোধ করিলেন। ক্রমে সৈন্যগণও প্রভুকে গমনে ক্ষান্ত দেখিয়া দণ্ডায়মান হইল।
গাজী রহমান বলিলেন, “কে দ্বৈরথ-যুদ্ধ-প্রিয়? কার অস্ত্র অগ্রে শত্রুশোণিতপানে সমুৎসুক?”

অশ্বারোহী সৈন্যগণ সমস্বরে বলিয়া উঠিল, “আমি অগ্রে যাইব।” মোহাম্মদ হানিফা সকলকে ধন্যবাদ দিয়া আশ্বস্ত করিলেন এবং বলিলেন, “প্রথম যুদ্ধ জাফরের।”

জাফর প্রভুর আদেশে নিষ্কোষিত অসিহস্তে সমরক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া বিপক্ষ সৈন্যকে যুদ্ধে আহ্বান করিলেন। আহ্বানের শব্দ অলীদ-শিবিরে প্রবেশমাত্র মুহূর্তমধ্যে বায়ুবেগে বিপক্ষদল হইতে একজন সৈন্য আসিয়া বলিতে লাগিল, “ওরে! মদিনা প্রবেশের আশা এই পরিশুষ্ক বালুকা রাশিতে বিসর্জন করিয়া পলায়ন কর। ওরে! তোরা কী সাহসে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছিস্? হাসান, হোসেন, কাসেম যখন আমাদের হাতে বিনাশ হইয়াছে, তখন তোরা কোন্ সাহসে তরবারি ধরিয়াছিস্? তোদের সৌভাগ্যসূর্য কারবালা প্রান্তরে লোহিত বসন পরিয়া ইহকালের তরে একেবারে অস্তমিত হইয়াছে। এখন তোদের অঙ্গে নীল বসনই বেশি শোভা পায়; আর্তনাদ এবং বক্ষে করাঘাত করাই তোদের এখনকার কর্তব্য; রণভেরী বাজাইয়া আবার কি সাধে তরবারি ধরিয়াছিস্? দুঃসময়ে লোকে যে বুদ্ধিহারা হইয়া আত্মহারা হয়, তাহার দৃষ্টান্ত তোরাই আজ দেখাইলি, জগৎ হাসাইলি। পিপীলিকার পালক যে জন্য উঠিয়া থাকে, তাহাই তোদের ভাগ্যে আছে। আর অধিক কি?”

আম্বাজী বীর বলিলেন, “কথার উত্তর-প্রত্যুত্তরের সময় আমাদের এখন নাই। সময় উত্তীর্ণ হইয়া যাইতেছে। যমদূত অস্থির হইতেছেন; আমার হস্তস্থিত অস্ত্র প্রতি চাহিয়া আছেন।”

“যমদূত কোথায় রে বর্বর! দেখ, যমদূত কে?” বলিয়াই অসির আঘাত! আঘাতে আঘাত উড়িয়া গেল। এজিদ্-সেনা লজ্জিত, মহা লজ্জিত হইলেন। অশ্ব ফিরাইয়া পুনরায় আঘাত করিবার ইচ্ছায় যেমন তরবারি উত্তোলন করিয়াছেন, অমনই তাঁহার বামস্কন্ধ হইতে দক্ষিণ পার্শ্ব দিয়া জাফরের সুতীক্ষ্ণ অসি, চঞ্চল চপল সদৃশ চাক্চিক্য দেখাইয়া চলিয়া গেল। অলীদ জাফরের তরবারির হাত দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইলেন। এদিকে দ্বিতীয় যোধ সমরে আগত। সে আর টিকিল না-যে তেজে আগত, সেই তেজেই খণ্ডিত। তৃতীয় সৈন্য উপস্থিত-সে আর তরবারি ধরিল না,-বর্শা ঘুরাইয়া জাফরের প্রতি নিক্ষেপ করিল। জাফর সে আঘাত ভর্মে উড়াইয়া পদাঘাতে বিপক্ষকে অশ্ব হইতে মৃত্তিকায় ফেলিয়া বর্শার দ্বারা বিদ্ধ করিলেন। চতুর্থ বীর গদাহস্তে আসিয়া জাফরকে বলিল, “কেবল তরবারি খেলা আর বর্শা ভাঁজাই শিখিয়াছ। বল তো ইহাকে কি বলে?” গদা বজ্রবৎ জাফরের মাথায় পড়িল। জাফর বামহস্তে বর্ম ধরিয়া গদার আঘাত উড়াইয়া দিলেন। কিন্তু রোষে তাঁহার চক্ষু ঘোর রক্তিমবর্ণ ধারণ করিল। মহাক্রোধে তরবারির আঘাত করিয়া বলিলেন, “যা কাফের, তোর গদা লইয়া নরকে যা।”

উভয় দলের লোকেই দেখিল যে গদাধারী যোধশরীর দ্বিখণ্ডিত হইয়া অশ্বের দুই দিকে পড়িয়া গেল।

ক্রমে দামেস্কের সত্তরজন সেনাকে একা জাফর শমনসদনে প্রেরণ করিলেন। এখনো ব্যূহ পূর্ববৎ রহিয়াছে। কিন্তু আর কেহই দ্বৈরথযুদ্ধে অগ্রসর হইতেছে না। জাফর চক্রাকারে অশ্ব চালাইতেছেন,-অশ্ব গলদ্ঘর্ম হইয়া ঘনঘন শ্বাস নিক্ষেপ করিতেছে।

ওত্‌বে অলীদ মহাক্রোধান্বিত হইয়া বলিল, “একটা লোক সত্তরজনের প্রাণ বিনাশ করিল, আর তোমরা তাহার কিছুই করিতে পারিলে না। দ্বৈরথ যুদ্ধ তোমাদের কার্য নহে! প্রথম ব্যূহের সমুদয় সৈন্য যাইয়া হানিফার সৈন্যের মস্তক আনয়ন কর।”

আজ্ঞামাত্র জাফরকে সৈন্যগণ ঘিরিয়া ফেলিল। মোহাম্মদ হানিফার আশাও পূর্ণ হইল; গাজী রহমান বলিলেন, “এ-ই সময়-এ-ই উপযুক্ত সময়!” সিংহগর্জনে মোহাম্মদ হানিফা আসিয়া জাফরের পৃষ্ঠপোষক হইলেন, অশ্বের দাপটে দামেস্ক সৈন্যগণ বহু দূরে সরিয়া দাঁড়াইল।

অলীদ দেখিলেন, মোহাম্মদ হানিফা স্বয়ং জাফরের পৃষ্ঠপোষক। দ্বিতীয় ব্যূহ ভগ্ন করিতে আদেশ করিয়া বলিলেন, “উভয়কে ঘিরিয়া কেবল তীর নিক্ষেপ কর! তরবারির আয়ত্তমধ্যে কেহ যাইয়ো না।”

আজ হানিফার মনের সাধ পূর্ণ হইল। ভ্রাতৃবিয়োগ-শোক-বহ্নি বিপক্ষ-শোণিতে শীতল করিতে লাগিলেন। দূর হইতে তীর নিক্ষেপ করিয়া কি করিবে? তরবারির আঘাতে, দুল্‌দুলের (হানিফার অশ্বের নাম) পদাঘাতে, জাফরের বর্শায় দামেস্ক-সৈন্য তৃণবৎ উড়িয়া যাইতে লাগিল,-মরুভূমিতে রক্তের স্রোত চলিল। জগৎ-লোচন রবি, সেই রক্তস্রোতের প্রতিবিম্বে আরক্তিম দেহে পশ্চিমগগনে লুক্কায়িত হইলেন। মোহাম্মদ হানিফা এবং জাফর শত্রু-বিনাশ বিরত হইয়া বেষ্টনকারী সৈন্যের এক পার্শ্ব হইতে কয়েকজনকে লোহিত বসন পরাইয়া সেই পথে নিজ শিবিরে প্রবেশ করিলেন। কার সাধ্য সম্মুখে দাঁড়ায়? কত তীর, কত বর্শা মোহাম্মদ হানিফার উদ্দেশে নিক্ষিপ্ত হইল-কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না।

ওত্‌বে অলীদ প্রথম যুদ্ধ-বিবরণ, হানিফার বাহুবলের পরিচয়, তাঁহার তরবারি-চালনের ক্ষমতা, বিস্তারিতরূপে লিখিয়া দামেস্কনগরে এজিদের নিকট কাসেদ প্রেরণ করিল।


© 2024 পুরনো বই