বিষাদ-সিন্ধু হল মীর মশাররফ হোসেন রচিত একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ও প্রাচীনতম উপন্যাসগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। হিজরি ৬১ সালে সংঘটিত কারবালার যুদ্ধ ও এর পূর্বাপর ঘটনাবলী এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। এটি যথাক্রমে ১৮৮৫, ১৮৮৭ ও ১৮৯১ সালে তিন ভাগে প্রকাশিত হয়; পরবর্তীতে সেগুলি একখন্ডে মুদ্রিত হয় ১৮৯১সালে। (উইকি)
উপক্রমণিকা
যখন আরব-গগনে ইসলাম-রবি মধ্যাকাশে উদিত, সমস্ত আরব-ভূমি ইসলাম-গৌরবে গৌরবান্বিত এবং সকলেই সেই প্রভু হজরত মোহাম্মদের পদানত হইয়াছে; সেই সময় একদা পবিত্র ঈদোৎসব-দিনে হজরত মোহাম্মদ প্রধান প্রধান শিষ্যমণ্ডলীর মধ্যে উপবেশন করিয়া ধর্মোপদেশ প্রদান করিতেছেন। এমন সময় তদীয় দৌহিত্র অর্থাৎ মহাবীর হযরত আলী-এর দুই পুত্র-হজরত হাসান ও হোসেন বালকসুলভ আগ্রহবশতঃ কাঁদিতে কাঁদিতে মাতামহের নিকট বসনভূষণ প্রার্থনা করিলেন।
হজরত স্নেহবশে দুই ভ্রাতার গণ্ডস্থলে চুম্বন করতঃ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী রূপ বসনে তোমরা সন্তুষ্ট হইবে?” হজরত হাসান সবুজ রঙের ও হজরত হোসেন লালরঙের বসন প্রার্থনা করিলেন। তন্মুহূর্তেই স্বর্গীয় প্রধান দূত জিবরাইল, প্রভু মোহাম্মদের নিকট উপস্থিত হইয়া পরম কারুণিক পরমেশ্বরের আদেশবাক্য কহিয়া অন্তর্হিত হইলেন। স্বর্গীয় সৌরভে চতুর্দিক আমোদিত হইল। প্রভু মোহাম্মদ ক্ষণকাল ম্লানমুখে নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। শিষ্যগণ তাঁহার তাদৃশ অবস্থা দেখিয়া নিতান্তই ভয়াকুল হইলেন। কী কারণে প্রভু এরূপ চিন্তিত হইলেন, কেহই তাহা কিছু স্থির করিতে না পারিয়া বিষন্ন-নয়নে তাঁহার মুখপানে চাহিয়া রহিলেন।
পবিত্র বদনের মলিনভাব দেখিয়া সকলের নেত্রই বাষ্প-পরিপ্লুত হইল। কিন্তু কেহই জিজ্ঞাসা করিতে সাহসী হইলেন না। প্রভু মোহাম্মদ শিষ্যগণের তাদৃশ অবস্থা দর্শনে মনের ভাব গোপন করিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা হঠাৎ এরূপ দুঃখিত ও বিষাদিত হইয়া কাঁদিতেছ কেন?”
শিষ্যগণ করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “প্রভুর অগোচর কী আছে? ঘনাগমে কিংবা নিশাশেষে পূর্ণচন্দ্র হঠাৎ মলিনভাব ধারণ করিলে তারাদলের জ্যোতিঃ তখন কোথায় থাকে? আমরা আপনার চির-আজ্ঞাবহ। অকস্মাৎ প্রভুর পবিত্র মুখের মলিনভাব দেখিয়াই আমাদের আশঙ্কা জন্মিয়াছে। যতক্ষণ আপনার সহাস্য আস্যের ঈদৃশ বিসদৃশ ভাব বিদ্যমান থাকিবে, ততক্ষণ ততই আমাদের দুঃখবেগ পরিবর্ধিত হইবে। আমরা বেশ বুঝিয়াছি, সামান্য বাত্যাঘাতে পর্বত কম্পিত হয় নাই, সামান্য বায়ুপ্রবাহেও মহাসমুদ্রে প্রবল তরঙ্গ উত্থিত হয় নাই। প্রভো! অনুকম্পা-প্রকাশে শীঘ্র ইহার হেতু ব্যক্ত করিয়া অল্পমতি শিষ্যগণকে আশ্বস্ত করুন।”
প্রভু মোহাম্মদ নম্রভাবে কহিলেন, “তোমাদের মধ্যে কাহারো সন্তান আমার প্রাণাধিক প্রিয়তম হাসান-হোসেনের পরম শত্রু হইবে। হাসানকে বিষপান করাইয়া মারিবে এবং হোসেনকে অস্ত্রাঘাতে নিধন করিবে, তাহারই নিদর্শনস্বরূপ আজ দুই ভ্রাতা আমার নিকট সবুজ ও লাল রঙের বসন প্রার্থনা করিয়াছে।”
এই কথা শুনিয়া শিষ্যগণ নির্বাক্ হইলেন। কাহারো মুখে একটিও কথা সরিল না। তাঁহাদের কণ্ঠ ও রসনা ক্রমে শুষ্ক হইয়া আসিল। কিছুকাল পরে তাঁহারা বলিতে লাগিলেন, “প্রভুর অবিদিত কিছুই নাই। কাহার সন্তানের দ্বারা এরূপ সাংঘাতিক কার্য সংঘটিত হইবে, শুনিতে পাইলে তাহার প্রতিকারের উপায় করিতে পারি। যদি তাহা ব্যক্ত না করেন, তবে আমরা অদ্যই বিষপান করিয়া আত্মবিসর্জন করিব। যদি তাহাতে পাপগ্রস্ত হইয়া নারকী হইতে হয়, তবে সকলেই অদ্য হইতে আপন আপন পত্নীগণকে একেবারে পরিত্যাগ করিব। প্রাণ থাকিতে আর স্ত্রী-মুখ দেখিব না, স্ত্রীলোকের নামও করিব না।”
প্রভু মোহাম্মদ কহিলেন, “ভাই সকল! ঈশ্বরের নিয়োজিত কার্যে বাধা দিতে এ জগতে কাহারো সাধ্য নাই; তাঁহার কলম রদ করিতে কাহারো ক্ষমতা নাই। তাঁহার আদেশ অলঙ্ঘনীয়। তবে তোমরা-অবশ্যম্ভাবী ঘটনা স্মরণ করিয়া কেন দুঃখিত থাকিবে? নিরপরাধিনী সহধর্মিণীগণের প্রতি শাস্ত্র-বহির্ভূত কার্য করিয়া অবলাগণের মনে কেন ব্যথা দিবে? তাহাও তো মহাপাপ! তোমাদের কাহারো মনে দুঃখ হইবে বলিয়াই আমি তাহার মূল বৃত্তান্ত প্রকাশ করিতে ইতস্তত করিতেছি। নিতান্ত পক্ষে যদি শুনিতে বাসনা হইয়া থাকে, বলিতেছি-শ্রবণ কর। তোমাদের মধ্যে এই প্রিয়তম মাবিয়ার এক পুত্র জন্মিবে; সেই পুত্র জগতে এজিদ্ নামে খ্যাত হইবে; সেই এজিদ্ হাসান-হোসেনের পরম শত্রু হইয়া প্রাণবধ করাইবে। যদিও মাবিয়া এ পর্যন্ত বিবাহ করেন নাই, তথাপি সেই অসীম জগদ্বিধান জগদীশ্বরের আজ্ঞা লঙ্ঘন হইবার নহে, কখনোই হইবে না। সেই অব্যক্ত সুকৌশলসম্পন্ন অদ্বিতীয় প্রভুর আদেশ কখনোই ব্যর্থ হইবে না।”
মাবিয়া ধর্ম সাক্ষী করিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন, “জীবন থাকিতে বিবাহের নামও করিব না; নিজে ইচ্ছা করিয়া কখনো স্ত্রীলোকের মুখ পর্যন্ত দেখিব না।”
প্রভু মোহাম্মদ কহিলেন, “প্রিয় মাবিয়া! ঈশ্বরের কার্য,-তোমার মত ঈশ্বরভক্ত লোকের এরূপ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হওয়া নিতান্ত অনুচিত। তাঁহার মহিমার পার নাই, ক্ষমতার সীমা নাই, কৌশলের অন্ত নাই।” এই সকল কথার পর সকলেই আপন আপন বাটীতে চলিয়া গেলেন।
কিছুদিন পরে একদা মাবিয়া মূত্রত্যাগ করিয়া কুলুখ (কুলুখ-ঢিল, পানির পরিবর্তে ঢিল ব্যবহার করা শাস্ত্রসঙ্গত) লইয়াছেন, সেই কুলুখ এমন অসাধারণ বিষসংযুক্ত ছিল যে, তিনি বিষের যন্ত্রণায় ভূতলে গড়াগড়ি দিতে দিতে অস্থির হইয়া পড়িলেন। বন্ধুবান্ধব সকলের কর্ণেই মাবিয়ার পীড়ার সংবাদ গেল। অনেকরূপ চিকিৎসা হইল; ক্রমশ বৃদ্ধি ব্যতীত কিছুতেই যন্ত্রণার হ্রাস হইল না। মাবিয়ার জীবনের আশায় সকলেই নিরাশ হইলেন। ক্রমে ক্রমে তদ্বিষয় প্রভু মোহাম্মদের কর্ণগোচর হইল, তিনি মহাব্যস্তে মাবিয়ার নিকটে আসিয়া ঈশ্বরের নাম করিয়া বিষসংযুক্ত স্থানে ফুৎকার প্রদানে উদ্যত হইলেন।
এমন সময় স্বর্গীয় দূত আসিয়া বলিলেন, “হে মোহাম্মদ, কী করিতেছ? সাবধান! সাবধান! ঈশ্বরের নাম করিয়া মন্ত্রপূত করিয়ো না। এ সকলই ঈশ্বরের লীলা। তোমার মন্ত্রে মাবিয়া কখনোই আরোগ্যলাভ করিবে না। সাবধান! ইহার সমুচিত ঔষধ স্ত্রী-সহবাস। স্ত্রী-সহবাসমাত্রেই মাবিয়া বিষম বিষ-যন্ত্রণা হইতে মুক্তিলাভ করিবে। উহা ব্যতীত এ বিষের যন্ত্রণা নিবারণের ঔষধ জগতে আর দ্বিতীয় নাই।” এই কথা বলিয়া স্বর্গীয় দূত অন্তর্হিত হইলেন।
প্রভু মোহাম্মদ শিষ্যগণকে বলিতে লাগিলেন, “ভাই সকল! এ রোগের ঔষধ নাই। ইহজগতে ইহার উপযুক্ত চিকিৎসা নাই। একমাত্র উপায় স্ত্রী-সহবাস। যদি মাবিয়া স্ত্রী-সহবাস করিতে সম্মত হন, তবেই প্রাণরা হইতে পারে।” মাবিয়া স্ত্রী-সহবাসে অসম্মত হইলেন। ‘আত্মহত্যা মহাপাপ’ প্রভু কর্তৃক এই উপদেশ শুনিতে লাগিলেন। পরিশেষে সাব্যস্ত হইল যে, অশীতিবর্ষীয়া কোন বৃদ্ধা স্ত্রীকে শাস্ত্রানুসারে গ্রহণ করিয়া তাহার সহিত সহবাস করিবেন। কার্যেও তাহাই ঘটিল। বিষম রোগ হইতে মাবিয়া মুক্ত হইলেন। জীবন রক্ষা হইল।
অসীম করুণাময় পরমেশ্বরের কৌশলের কণামাত্র বুঝিয়া উঠা মানবপ্রকৃতির সাধ্য নহে। সেই অশীতিবর্ষীয়া বৃদ্ধা স্ত্রী কালক্রমে গর্ভবতী হইয়া যথাসময়ে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করিলেন। মাবিয়া পূর্ব হইতে স্থিরসঙ্কল্প করিয়াছিলেন যে, যদি পুত্র হয়, তখনই তাহাকে মারিয়া ফেলিবেন; কিন্তু পুত্রের সুকোমল বদনমণ্ডলের প্রতি একবার নয়ন-গোচর করিবামাত্রই বৈরীভাব অন্তর হইতে একেবারে তিরোহিত হইল। হৃদয়ে সুমধুর বাৎসল্যভাবের আবির্ভাব হইয়া তাঁহার মন আকর্ষণ করিল। তখন পুত্রের প্রাণ হরণ করিবেন কি, নিজেই পুত্রের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। আপন প্রাণ হইতেও তিনি এজিদ্কে অধিক ভালবাসিতে লাগিলেন।
বয়োবৃদ্ধির সহিত ভালবাসাও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। কিন্তু সময়ে সময়ে সেই নিদারুণ হৃদয়বিদারক বাক্য মনে করিয়া নিতান্তই দুঃখিত হইতেন। কিছুদিন পরে মাবিয়া দামেস্ক নগরে স্থায়ীরূপে বাস করিবার বাসনা প্রভু মোহাম্মদ ও মাননীয় আলীর নিকটে প্রকাশ করিয়া অনুমতি প্রার্থনা করিলেন। আরো বলিলেন, “এজিদের কথা আমি ভুলি নাই। হাসান-হোসেনের নিকট হইতে তাহাকে দূরে রাখিবার অভিলাষেই আমি মদিনা পরিত্যাগ করিতে সঙ্কল্প করিতেছি।”
মাননীয় আলী সরলহৃদয়ে সন্তুষ্টচিত্তে জ্ঞাতি-ভ্রাতা মাবিয়ার প্রার্থনা গ্রাহ্য করিয়া নিজ অধিকৃত দামেস্ক নগর তাঁহাকে অর্পণ করিলেন। প্রভু মোহাম্মদ কহিলেন, “মাবিয়া দামেস্ক কেন, এই জগৎ হইতে অন্য জগতে গেলেও ঈশ্বরের বাক্য লঙ্ঘন হইবে না।” মাবিয়া লজ্জিত হইলেন, কিন্তু পূর্বসঙ্কল্প পরিত্যাগ করিলেন না। অল্পদিবসের মধ্যে তিনি সপরিবারে মদিনা পরিত্যাগ করিয়া দামেস্ক নগরে গমন করিলেন এবং তত্রত্য রাজসিংহাসনে উপবেশন করিয়া প্রজাপালন ও ঈশ্বরের উপাসনায় অধিকাংশ সময় যাপন করিতে লাগিলেন। এদিকে প্রভু মোহাম্মদ হিজরি ১১ সনের ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার বেলা সপ্তম ঘটিকার সময় পবিত্র-ভূমি মদিনায় পবিত্র দেহ রাখিয়া স্বর্গবাসী হইলেন।
প্রভুর দেহত্যাগের ছয় মাস পরে বিবি ফাতেমা (প্রভুকন্যা, হাসান-হোসেনের জননী, মহাবীর আলীর সহধর্মিণী) হিজরি ১১ সনে পুত্র ও স্বামী রাখিয়া জান্নাত (বেহেশ্তের নাম) বাসিনী হইলেন। মহাবীর হজরত আলী হিজরি ৪০ সনের রমজান মাসের চতুর্থ দিবস রবিবারে দেহত্যাগ করেন। তৎপরেই মহামান্য ইমাম হাসান মদিনার সিংহাসনে উপবেশন করিয়া ধর্মানুসারে রাজ্যপালন করিতে লাগিলেন। দামেস্ক নগরে এজিদ্ বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে পরিবর্ণিত ঘটনা শুরু হইল।