বৌদ্ধ মতগুলি যখন ক্রমে ক্রমে একেবারে বিলুপ্ত হইয়া গেল–বিলুপ্তই বা বলি কেন, ধ্বংস হইয়া গেল, তখন বৌদ্ধ ধর্মের কি দশা হইল ? পাদরি না থাকিলে খ্ৰীস্টানদের যে দশা হয়, ব্রাহ্মণ না থাকিলে হিন্দুদের যে দশা হয়, মৌলবি না থাকিলে মুসলমানদের যে দশ হয়, বৌদ্ধ ধর্মের ঠিক সেই দশা হইল। বাহির হইতে কেই উহা আক্রমণ করিলে রক্ষা করিবার লোক রহিল না। ভিতরে গোলযোগ হইলে, তাহার সংস্কার করিবার লোক রহিল না। রহিল কেবল মূৰ্খ পুরোহিতকুল আর অসংখ্য কৃষক বণিক ও কারিকর। মুসলমানের জোর করিয়া অনেককে মুসলমান করিয়া ফেলিল। প্রায়ই দেখা যায়, যেখানে বড় বড় বিহার ছিল, অনেক নিষ্কর জমি বিহারওয়ালারা ভোগ করিত। বিজেতারা সে সমস্ত জমি বাজেয়াপ্ত করিয়া আফগান সিপাহীদিগকে ভাগ করিয়া দিল। ওদন্তপুর ও নালন্দার জমী লইয়া মল্লিক নামে এক মুসলমান-কুলেরই উৎপত্তি হইয়াছে। বাংলার বিহারের খবর জানি না, তবে একটা খবর জানি বলিয়া বোধ হয়। বালান্ডা পরগনায় খুব ভাল মাদুর হয়, তখনও হইত, এখনও হয়। সেখানে একটি বৌদ্ধ বিহার ছিল, অনেক ভিক্ষু ছিল, পুঁথি নকল হইত, ঠাকুর-দেবতার পূজা হইত। বালা্ন্ডার একখানি ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’ এখনও নেপাল-দরবার-লাইব্রেরীতে আছে, বালান্ডার বৌদ্ধ কীর্তির এইমাত্র স্মৃতি জাগরূক আছে। এখন সেই বালান্ডায় সব মুসলমান। মুসলমানেই মাদুর বুনে, মাদুর বুনিবার জন্য এক ঘরও হিন্দু নাই। বিহারগুলি এইরূপে শুধু যে ধ্বংস হইল এমন নহে, সেখানে মুসলমান আসিয়া বসিল এবং তাহারা অনায়াসেই চারি পাশের লোককে মুসলমান করিয়া ফেলিল। তাই আজ বাংলায় অর্ধেকের উপর মুসলমান।
বাকি যাহারা ছিল, তাহারা হিন্দু হইয়া গেল। তাহাদিগকে হিন্দু করিল কে ? ব্রাহ্মণেরা। ব্ৰাহ্মণ-পণ্ডিতদের ত এ বিষয়ে কৃতিত্ব আছেই, সঙ্গে সঙ্গে আরও দুই দল ব্রাহ্মণ উহাদের সহায় হইলেন। এক দলের নেতা চৈতন্য, অদ্বৈত ও নিত্যানন্দ। আর এক দলের নেতা গৌড়ীয় শঙ্কর, ত্রিপুরানন্দ, ব্ৰহ্মানন্দ, পূর্ণানন্দ ও আগমবাগীশ। এক দল বৈষ্ণব, আর-এক দল শাক্ত।
বৈষ্ণবদিগের মধ্যে চৈতন্যদেব একটি প্রকাণ্ড সম্প্রদায় সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন। তিনি নিজে বাঙালী ছিলেন, তাহার পরিকরও প্রায় সবই বাঙালী। ইঁহারা অনেক সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন এবং বাংলা ভাষার যথেষ্ট শ্ৰীবৃদ্ধি করিয়াছিলেন। রূপ, সনাতন, জীব, গোপালভট, কবিকর্ণপুর, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী, বলদেব বিদ্যাভূষণ হইতে আরম্ভ করিয়া উপেন্দ্র গোস্বামী পর্যন্ত কত লোক যে সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন, তাহা গণিয়া শেষ করা যায় না। বাংলার ত কথাই নাই। বৃন্দাবনদাস, লোচনদাস, কৃষ্ণদাস কবিরাঙ্গ হইতে আরম্ভ করিয়া রঘুনন্দন গোস্বামী পর্যন্ত কত কত বৈষ্ণব লেখক বাংলা উংকৃষ্ট উংকৃষ্ট গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন। তাঁহারা বাংলা ভাষাকে মার্জিত কবিয়া দিয়া গিয়াছেন, নূতন জীবন দিয়া গিয়াছেন। বাংলায় বৈষ্ণবদিগের প্রধান কীর্তি— কীর্তনের পদ। বৌদ্ধদিগের চর্যাপদের অনুকরণে এই সকল পদাবলীর সৃষ্টি। পদাবলীর পদকর্তা অসংখ্য। রাধামোহন দাস ৮০০/৮৫০ পদ সংগ্ৰহ করিয় গিয়াছেন, তাঁহার দুই পুরুষ পরে বৈষ্ণবদাস ৩৩০০ পদ সংগ্ৰহ করিয়া গিয়াছেন, এখনও সংগ্ৰহ করিলে ২০,০০০ হাজারেরও অধিক হইবে। ভাবের মাধুর্যে, ভাষার লালিতে, স্বরের বৈচিত্রে এই সকল গান সকল সমাজেরই পরম আদরের জিনিস। এই সকল পদ গান করিবার জন্য নানারূপ কীর্তনের সৃষ্টি হইয়াছে। সেকালে যেমন বাংলায় নাটকের একটা স্বতন্ত্র ‘প্রবৃত্তি’ ছিল, এখনও কীর্তনের সেইরূপ নানা ‘প্রবৃত্তি’ হইয়াছে, তাহার মধ্যে দুইটি প্রধান- মনোহরশাহী ও রেনেটি। ভক্তিরত্নাকরে লেখা আছে যে, শ্ৰীখণ্ডে যখন প্রথম কীৰ্তন হয়, তখন স্বৰ্গ হইতে চৈতন্য সেখানে উপস্থিত হইয়াছিলেন। এখনও বোধ হয় ভাল কীৰ্তন জমিলে সেখানে চৈতন্য সপরিকর আবির্ভূত হন। বাংলার কীর্তন একটা সত্যসত্যই উপভোগের জিনিস। তাহার জন্য চৈতন্যদেবের ও তাঁহার সম্প্রদায়ের নিকট আমরা সম্পূর্ণরূপে ঋণী।