মুসলমান-আক্রমণের পূর্বে বাংলায় অনেক সংস্কৃত গ্রন্থ লিখিত হইয়াছিল। ভবদেব একজন প্রকাণ্ড পণ্ডিত ছিলেন। সংস্কৃতে যাহা কিছু পড়িবার ছিল, তিনি যেন সবই পড়িয়াছিলেন। বাচস্পতি মিশ্র তাঁহার প্রশস্তি লিখিয়াছেন। সেই প্রসস্তিতে যাহা লেখা আছে তাহা যদি চারিভাগের একভাগও সত্য হয়, তাহা হইলেও ভবদেব যে দেশে জন্মিয়াছিলেন সে দেশ ধন্য। তাঁহার কত পুস্তুক ছিল, আমরা এখনো জানিতে পারি নাই। তবে সামবেদীদের পদ্ধতি ছাড়া আরও তাঁহার দশ-বারোখানি গ্রন্থ পাওয়া গিয়াছে।
লোকে বলে বাংলায় বেদের চর্চা ছিল না, এ কথা সত্য। অন্য জায়গায় যেমন সমস্ত বেদটা মুখস্ত করে, বাঙালীরা তাহা করিত না, তাহারা তত আহম্মুক ছিল না। তাহারা যেটুকু পড়িত অর্থ করিয়া পড়িত; নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য যতখানি জানা দরকার সবটুকু বেশ ভাল করিয়া পড়িত। সুতরাং প্রথম বেদের ব্যখ্যা বাংলাতেই হয়। সায়ণাচার্যের দুই-তিন শত বৎসর পূর্বে নুগড়াচার্য এক নূতন ধরনের বেদব্যাখ্যা সৃষ্টি করেন। নুগড়ের পুস্তক এখনও পাওয়া যায় নাই, কিন্তু তাঁহার সম্প্রদায়ের পুস্তক অনেকগুলি পাওয়া গিয়াছে। হলায়ুধ তাঁহার সম্প্রদায়ের, গুণবিষ্ণু তাঁহার সম্প্রদায়ের। ইহাদের ব্যাখ্যা বেশ পরিষ্কার ও বেশ সুগম।
দর্শনশাস্ত্রে বৌদ্ধদের সঙ্গে সর্বদাই তাঁহাদের বিচার করিতে হইত। সুতরাং বাঙালী ব্রাহ্মণ-মাত্রকেই দর্শনশাস্ত্রের কিছু চর্চা রাখিতে হইত। শ্রীধরের লেখা প্রশস্তপাদের টীকা এখন ভারতবর্ষে খুব প্রচলিত।
স্মৃতিতে গৌড়ীয় মতই একটা স্বতন্ত্র ছিল। কাশী মিথিলা ও নেপাল দেশের প্রাচীন স্মৃতিনিবন্ধে অনেকবার গৌড়ীয় মতের নাম করিয়াছে। মনুর টীকাকার গোবিন্দরাজ যে স্মৃতিমঞ্জরী বলিয়ে এক প্রকাণ্ড স্মৃতিনিবন্ধ লিখিয়া গিয়াছেন, তাহা পড়িলে আশ্চর্য হইতে হয়। আমরা উহার যে পুঁথিখানি পাইয়াছি, তাহা খ্রীষ্টীয় ১১৪৫ সালে কপি করা। দায়ভাগকার জীমূতবাহন, জিকন, শ্রীকর প্রভৃতি অনেক স্মৃতিনিবন্ধকারের ও জোগ্লাক, অন্ধূক ভট্ট প্রভৃতি অনেক জ্যোতিষনিবন্ধকারের নাম করিয়া গিয়াছেন। তিনি নিজে যাহা করিয়া তুলিয়াছেন সেই ত একটি অদ্ভূত জিনিস। সম্পত্তি পূর্ব বংশগত ছিল, তিনি তাহাকে ব্যক্তিগত করিয়া গিয়াছেন, এ কাজটি ত ভারতে আর কেহই করিতে পারেন নাই। বল্লালও ত নিজে দুখানি বিরাট গ্রন্থ লিখিয়া গিয়াছেন, একখানি দানসাগর ও আর-একখানি অদ্ভূতসাগর। শ্রীনিবাসাচার্য্যের শুদ্ধির গ্রন্থও ত স্মৃতি ও জ্যোতিষের একখানি ভাল বই।