বাংলার চতুর্থ গৌরব বাকলের কাপড়। প্রথম অবস্থায় লোকে পাতা পরিত। কটকের জঙ্গলমহলে এখনও দু-এক জায়গায় লোকে পাতা পরিয়া থাকে। তাহার পর লোকে বাকল পরিত; গাছের ছাল পিটিয়া কাপড়ের মত নরম করিয়া লইত, তাহাই জড়াইয়া লজ্জা নিবারণ করিত এবং কাঁধের উপর একখানি ফেলিয়া উত্তরীয় করিত। সাঁচী পাহাড়ের উপর এক প্রকাণ্ড স্তূপ আছে, উহার চারিদিকে পাথরের রেলিং আছে, রেলিংএর চারিদিকে বড় বড় ফটক আছে। দুই-দুইটি থামের উপর এক-একটি ফটক। এই থামের গায়ে অনেক চিত্র আছে। এই চিত্রের মধ্যে বাকল-পরা অনেক মুনিঋষি আছেন। তাঁহাদের কাপড় পরার ধরন দেখিয়া আমরা বুঝিতে পারি, কেমন করিয়া সেখানে লোক বাকল পরিয়া থাকিত। তাহার পর লোকে আর বাকল পরিত না, বাকল হইতে সুতা বাহির করিয়া কাপড় বুনিয়া লইত; শণ, পাট, ধঞ্চে, এমন কি আতসী গাছের ছাল হইতেও সুতা বাহির করিত। এখন এই সকল সুতায় দড়ি ও থলে হয়। সেকালে উহা হইতে খুব ভাল কাপড় তৈয়ার হইত এবং অনেক কাপড় খুব ভালও হইত। বাকল হইতে যে কাপড় হইত তাহার নাম ‘ক্ষৌম’, উৎকৃষ্ট ক্ষৌমের নাম ‘দুকূল’। ক্ষৌম পবিত্র বলিয়া লোকে বড় আদর করিয়া পরিত।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের মতে বাংলাতেই এই বাকলের কাপড় বুনা হইত। বঙ্গে দুকূল হইত, উহা শ্বেত ও স্নিগ্ধ, দেখিলেই চক্ষু জুড়াইয়া যাইত। পৌণ্ড্রেও দুকূল হইত, উহা শ্যামবর্ণ ও মণির মত উজ্জ্বল। সুবর্ণকুড্যে যে দুকূল হইত তাহার বর্ণ সূর্যের মত এবং মণির মত উজ্জ্বল। এই অংশের শেষে কৌটিল্য বলিতেছেন, ইহাতেই কাশীর ও পৌন্ড্র দেশের ক্ষৌমের কথা ‘ব্যাখ্যা’ করা হইল। উহাতে বুঝা যায়, বাংলাতেই বাকলের কাপড় সকলের চেয়ে ভাল হইত এবং ‘দুকূল’ একমাত্র বাংলাতেই হইত। সুতরাং ইহা আমরা বাংলার চতুর্থ গৌরবের বিষয় বলিয়া উল্লেখ করিলাম।
এখানে আমরা কাপাসের কাপড়ের কথা বলিলাম না। কারণ, চাণক্যের মতে কাপাসের কাপড় যে শুধু বাংলাতেই ভাল হইত, এমন নয়—মথুরার কাপড়, অপরান্তের কাপড়, কলিঙ্গের কাপড়, কাশীর কাপড়, বৎসদেশের কাপড় ও মহিষদেশের কাপড়ও বেশ হইত। মথুরা, পাণ্ড্যদেশে, মহিষদেশ, নর্মদার দক্ষিণ, অপরান্ত বোম্বাই অঞ্চলে। কিন্তু চাণক্যের অনেক পরে কার্পাসের কাপড়ও বাংলার একটা প্রধান গৌরবের জিনিস হইয়াছিল। ঢাকাই মস্লিন ঘাসের উপর পাড়িয়া রাখিলে ও রাত্রিতে তাহার উপর শিশির পড়িলে, কাপড় দেখাই যাইত না। একটি আংটির ভিতর দিয়া এক থান মসলিন অনায়াসেই টানিয়া বাহির করিয়া লওয়া যাইত। তাঁতীরা অতি প্রাত্যুষে উঠিয়া একটি বাখারির কাটি লইয়া কাপাসের খেতে ঢুকিত। ফট্ করিয়া যেমন একটি কাপাসের মুখ খুলিয়া যাইত, অমনি বাখারিতে জড়াইয়া তাহার মুখের তুলাটি সংগ্রহ করিত। সেই তুলা হইতে অতি সূক্ষ্ম সুতা পাকাইত, তাহাতেই মস্লিন তৈয়ার হইত। আকবর যখন বাংলা দখল করিয়া সুবাদার নিযুক্ত করেন, তখন সুবাদারের সহিত তাঁহার বন্দোবস্ত হয় যে, তিনি বাংলার রাজস্ব-স্বরূপ বৎসরে পাঁচ লক্ষ টাকা মাত্র লইবেন, কিন্তু দিল্লীর রাজবাড়িতে যত মালদহের রেশমী কাপড় ও ঢাকার মস্লিন দরকার হইবে, সমস্ত সুবাদারকে জোগাইতে হইবে।