কবি তাঁহার কল্পনা-উৎসের যত করুণাবারি সমস্তই কেবল জনকতনয়ার পুণ্য অভিষেকে নিঃশেষ করিয়াছেন। কিন্তু আর-একটি যে ম্লানমুখী ঐহিকের-সর্বসুখবঞ্চিতা রাজবধূ সীতাদেবীর ছায়াতলে অবগুণ্ঠিতা হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন, কবি-কমণ্ডলু হইতে একবিন্দু অভিষেকবারিও কেন তাঁহার চিরদুঃখাভিতপ্ত নম্রললাটে সিঞ্চিত হইল না! হায় অব্যক্তবেদনা দেবী ঊর্মিলা, তুমি প্রত্যুষের তারার মতো মহাকাব্যের সুমেরুশিখরে একবারমাত্র উদিত হইয়াছিলে, তার পরে অরুণালোকে আর তোমাকে দেখা গেল না। কোথায় তোমার উদয়াচল, কোথায় বা তোমার অস্তশিখরী তাহা প্রশ্ন করিতেও সকলে বিস্মৃত হইল।
কাব্যসংসারে এমন দুটি-একটি রমণী আছে যাহারা কবিকর্তৃক সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হইয়াও অমরলোক হইতে ভ্রষ্ট হয় নাই। পক্ষপাতকৃপণ কাব্য তাহাদের জন্য স্থানসংকোচ করিয়াছে বলিয়াই পাঠকের হৃদয় অগ্রসর হইয়া তাহাদিগকে আসন দান করে।
কিন্তু এই কবিপরিত্যক্তাদের মধ্যে কাহাকে কে হৃদয়ে আশ্রয় দিবেন, তাহা পাঠকবিশেষের প্রকৃতি এবং অভিরুচির উপর নির্ভর করে। আমি বলিতে পারি, সংস্কৃত-সাহিত্যে কাব্যযজ্ঞশালার প্রান্তভূমিতে যে-কয়টি অনাদৃতার সহিত আমার পরিচয় হইয়াছে তাহার মধ্যে ঊর্মিলাকে আমি প্রধান স্থান দিই।
বোধ করি তাহার একটা কারণ, এমন মধুর নাম সংস্কৃত কাব্যে আর দ্বিতীয় নাই। নামকে যাঁহারা নামমাত্র মনে করেন আমি তাঁহাদের দলে নই। শেক্স্পীয়র বলিয়া গেছেন– গোলাপকে যে-কোনো নাম দেওয়া যাক তাহার মাধুর্যের তারতম্য হয় না। গোলাপ সম্বন্ধে হয়তো তাহা খাটিতেও পারে, কারণ গোলাপের মাধুর্য সংকীর্ণসীমাবদ্ধ। তাহা কেবল গুটিকতক সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষগম্য গুণের উপর নির্ভর করে। কিন্তু মানুষের মাধুর্য এমন সর্বাংশে সুগোচর নহে, তাহার মধ্যে অনেকগুলি সূক্ষ্ম সুকুমার সমাবেশে অনির্বচনীয়তার উদ্রেক করে; তাহাকে আমরা কেবল ইন্দ্রিয়দ্বারা পাই না, কল্পনাদ্বারা সৃষ্টি করি। নাম সেই সৃষ্টিকার্যের সহায়তা করে। একবার মনে করিয়া দেখিলেই হয়, দ্রৌপদীর নাম যদি ঊর্মিলা হইত তবে সেই পঞ্চবীরপতিগর্বিতা ক্ষত্রনারীর দীপ্ত তেজ এই তরুণ কোমল নামটির দ্বারা পদে পদে খণ্ডিত হইত।
অতএব এই নামটির জন্য বাল্মীকির নিকট কৃতজ্ঞ আছি। কবিগুরু ইহার প্রতি অনেক অবিচার করিয়াছেন, কিন্তু দৈবক্রমে ইহার নাম যে মাণ্ডবী অথবা শ্রুতকীর্তি রাখেন নাই সে একটা বিশেষ সৌভাগ্য। মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তি সম্বন্ধে আমরা কিছু জানি না, জানিবার কৌতূহলও রাখি না।
ঊর্মিলাকে কেবল আমরা দেখিলাম বধূবেশে, বিদেহনগরীর বিবাহসভায়। তার পরে যখন হইতে সে রঘুরাজকুলের সুবিপুল অন্তঃপুরের মধ্যে প্রবেশ করিল তখন হইতে আর তাহাকে একদিনও দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। সেই তাহার বিবাহসভার বধূবেশের ছবিটিই মনে রহিয়া গেল। ঊর্মিলা চিরবধূ– নির্বাক্কুণ্ঠিতা নিঃশব্দচারিণী। ভবভূতির কাব্যেও তাহার সেই ছবিটুকুই মুহূর্তের জন্য প্রকাশিত হইয়াছিল– সীতা কেবল সস্নেহকৌতুকে একটিবার মাত্র তাহার উপরে তর্জনী রাখিয়া দেবরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, বৎস, ইনি কে?’ লক্ষ্ণণ লজ্জিতহাস্যে মনে মনে কহিলেন,”ওহো ঊর্মিলার কথা আর্যা জিজ্ঞাসা করিতেছেন।’ এই বলিয়া তৎক্ষণাৎ লজ্জায় সে ছবি ঢাকিয়া ফেলিলেন; তাহার পর রামচরিত্রের এত বিচিত্র সুখ-দুঃখ-চিত্রশ্রেণীর মধ্যে আর একটিবারও কাহারো কৌতূহল-অঙ্গুলি্ এই ছবিটির উপরে পড়িল না। সে তো কেবল বধূ ঊর্মিলা-মাত্র।
তরুণ শুভ্রভালে যেদিন প্রথম সিন্দূরবিন্দুটি পরিয়াছিলেন, ঊর্মিলা চিরদিনই সেইদিনকার নববধূ। কিন্তু রামের অভিষেক-মঙ্গলাচরণের আয়োজনে যেদিন অন্তঃপুরিকাগণ ব্যাপৃত ছিল সেদিন এই বধূটিও কি সীমন্তের উপর অর্ধাবগুণ্ঠন টানিয়া রঘুকুললক্ষ্মীদের সহিত প্রসন্নকল্যাণমুখে মাঙ্গল্যরচনায় নিরতিশয় ব্যস্ত ছিল না? আর, যেদিন অযোধ্যা অন্ধকার করিয়া দুই কিশোর রাজভ্রাতা সীতাদেবীকে সঙ্গে লইয়া তপস্বীবেশে পথে বাহির হইলেন সেদিন বধূ ঊর্মিলা রাজহর্ম্যের কোন্ নিভৃত শয়নকক্ষে ধুলিশয্যায় বৃন্তচ্যুত মুকুলটির মতো লুণ্ঠিত হইয়া পড়িয়া ছিল তাহা কি কেহ জানে? সেদিনকার সেই বিশ্বব্যাপী বিলাপের মধ্যে এই বিদীর্যমান ক্ষুদ্র কোমল হৃদয়ের অসহ্য শোক কে দেখিয়াছিল? যে ঋষিকবি ক্রৌঞ্চবিরহিণীর বৈধব্যদুঃখ মুহূর্তের জন্য সহ্য করিতে পারেন নাই, তিনিও একবার চাহিয়া দেখিলেন না।
লক্ষ্ণণ রামের জন্য সর্বপ্রকারে আত্মবিলোপ সাধন করিয়াছিলেন, সে গৌরব ভারতবর্ষের গৃহে গৃহে আজও ঘোষিত হইতেছে, কিন্তু সীতার জন্য ঊর্মিলার আত্মবিলোপ কেবল সংসারে নহে, কাব্যেও। লক্ষ্ণণ তাঁহার দেবতাযুগলের জন্য কেবল নিজেকে উৎসর্গ করিয়াছিলেন, ঊর্মিলা নিজের চেয়ে অধিক নিজের স্বামীকে দান করিয়াছিলেন। সে কথা কাব্যে লেখা হইল না। সীতার অশ্রুজলে ঊর্মিলা একেবারে মুছিয়া গেল।
লক্ষ্ণণ তো বারো বৎসর ধরিয়া তাঁহার উপাস্য প্রিয়জনের প্রিয়কার্যে নিযুক্ত ছিলেন– নারী-জীবনের সেই বারোটি শ্রেষ্ঠ বৎসর ঊর্মিলার কেমন করিয়া কাটিয়াছিল? সলজ্জ নবপ্রেমে আমোদিত বিকচোন্মুখ হৃদয়মুকুলটি লইয়া স্বামীর সহিত যখন প্রথমতম মধুরতম পরিচয়ের আরম্ভসময় সেই মুহূর্তে লক্ষ্ণণ সীতাদেবীর রক্তচরণক্ষেপের প্রতি নতদৃষ্টি রাখিয়া বনে গমন করিলেন– যখন ফিরিলেন তখন নববধূর সুচিরপ্রণয়ালোকবঞ্চিত হৃদয়ে আর কি সেই নবীনতা ছিল? পাছে সীতার সহিত ঊর্মিলার পরম দুঃখ কেহ তুলনা করে, তাই কি কবি সীতার স্বর্ণমন্দির হইতে এই শোকাজ্জ্বলা মহাদুঃখিনীকে একেবারে বাহির করিয়া দিয়াছেন– জানকীর পাদপীঠপার্শ্বেও বসাইতে সাহস করেন নাই?
সংস্কৃত কাব্যের আর দুইটি তপস্বিনী আমাদের চিত্তক্ষেত্রে তপোবন রচনা করিয়া বাস করিতেছে। প্রিয়ংবদা আর অনসূয়া। তাহারা ভর্তৃগৃহগামিনী শকুন্তলাকে বিদায় দিয়া পথের মধ্য হইতে কাঁদিতে কাঁদিতে ফিরিয়া আসিল, নাটকের মধ্যে আর প্রবেশ করিল না, একেবারে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিল।
জানি, কাব্যের মধ্যে সকলের সমান অধিকার থাকিতে পারে না। কঠিনহৃদয় কবি তাঁহার নায়ক-নায়িকার জন্য কত অক্ষয় প্রতিমা গড়িয়া গড়িয়া নিমর্মচিত্তে বিসর্জন দেন। কিন্তু তিনি যেখানে যাহাকে কাব্যের প্রয়োজন বুঝিয়া নিঃশেষ করিয়া ফেলেন সেইখানেই কি তাহার সম্পূর্ণ শেষ হয়? দীপ্তরোষ ঋষিশিষ্যদ্বয় এবং হতবুদ্ধি রোরুদ্যমানা গৌতমী যখন তপোবনে ফিরিয়া আসিয়া উৎসুক উৎকণ্ঠিত সখী দুইটিকে রাজসভার বৃত্তান্ত জানাইল তখন তাহাদের কী হইল সে কথা শকুন্তলা নাটকের পক্ষে একেবারেই অনাবশ্যক, কিন্তু তাই বলিয়া কি সেই অকথিত অপরিমেয় বেদনা সেইখানেই ক্ষান্ত হইয়া গেল? আমাদের হৃদয়ের মধ্যে কি বিনা ছন্দে, বিনা ভাষায় চিরদিন তাহা উদ্ভ্রান্ত হইয়া ফিরিতে লাগিল না?
কাব্য হীরার টুকরার মতো কঠিন। যখন ভাবিয়া দেখি, প্রিয়ংবদা অনসূয়া শকুন্তলার কতখানি ছিল, তখন সেই কণ্বদুহিতার পরমতম দুঃখের সময়েই সেই সখীদিগকে একেবারেই অনাবশ্যক অপবাদ দিয়া সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা কাব্যের পক্ষে ন্যায়বিচারসংগত হইতে পারে, কিন্তু তাহা নিরতিশয় নিষ্ঠুর।
শকুন্তলার সুখসৌন্দর্য গৌরবগরিমা বৃদ্ধি করিবার জন্যই এই দুটি লাবণ্যপ্রতিমা নিজের সমস্ত দিয়া তাহাকে বেষ্টন করিয়াছিল। তিনটি সখী যখন জলের ঘট লইয়া অকালবিকশিত নবমালতীর তলে আসিয়া দাঁড়াইল তখন দুষ্মন্ত কি একা শকুন্তলাকে ভালোবাসিয়াছিলেন? তখন হাস্যে কৌতুকে নবযৌবনের বিলোলমাধুর্যে কাহারা শকুন্তলাকে সম্পূর্ণ করিয়া তুলিয়াছিল? এই দুইটি তাপসী সখী। একা শকুন্তলা শকুন্তলার একতৃতীয়াংশ। শকুন্তলার অধিকাংশই অনসূয়া এবং প্রিয়ংবদা, শকুন্তলাই সর্বাপেক্ষা অল্প। বারো-আনা প্রেমালাপ তো তাহারাই সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়া দিল। তৃতীয় অঙ্কে যেখানে একাকিনী শকুন্তলার সহিত দুষ্মন্তের প্রেমাকুলতা বর্ণিত আছে সেখানে কবি অনেকটা হীনবল হইয়াছিলেন– কোনোমতে অচিরে গৌতমীকে আনিয়া তিনি রক্ষা পাইলেন– কারণ, শকুন্তলাকে যাহারা আবৃত করিয়া সম্পূর্ণ করিয়াছিল তাহারা সেখানে ছিল না। বৃন্তচ্যুত ফুলের উপর দিবসের সমস্ত প্রখর আলোক সহ্য হয় না– বৃন্তের বন্ধন এবং পল্লবের ঈষৎ অন্তরাল ব্যতীত সে আলোক তাহার উপর তেমন কমনীয় কোমলভাবে পড়ে না। নাটকের ঐ ক’টি পত্রে সখীবিরহিতা শকুন্তলা এতই সুস্পষ্টরূপে অসহায় অসম্পূর্ণ অনাবৃত ভাবে চোখে পড়ে যে তাহার দিকে যেন ভালো করিয়া চাহিতে সংকোচ বোধ হয়– মাঝখানে আর্যা গৌতমীর আকস্মিক আবির্ভাবে পাঠকমাত্রেই মনে মনে আরাম লাভ করে।
আমি তো মনে করি, রাজসভায় দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে যে চিনিতে পারেন নাই তাহার প্রধান কারণ, সঙ্গে অনসূয়া-প্রিয়ংবদা ছিল না। একে তপোবনের বাহিরে, তাহাতে খণ্ডিতা শকুন্তলা, চেনা কঠিন হইতে পারে।
শকুন্তলা বিদায় লইলেন, তাহার পর সখীরা যখন শূন্য তপোবনে ফিরিয়া আসিল তখন কি তাহাদের শৈশবসহচরীর বিরহই তাহাদের একমাত্র দুঃখ? শকুন্তলার অভাব ছাড়া ইতিমধ্যে তপোবনের আর কি কোনো পরিবর্তন হয় নাই? হায়, তাহারা জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাইয়াছে, যাহা জানিত না তাহা জানিয়াছে। কাব্যের কাল্পনিক নায়িকার বিবরণ পড়িয়া নহে, তাহাদের প্রিয়তমা সখীর বিদীর্ণ হৃদয়ের মধ্যে অবতরণ করিয়া। এখন হইতে অপরাহ্নে আলবালে জলসেচন করিতে কি তাহারা মাঝে মাঝে বিস্মৃত হইবে না? এখন কি তাহারা মাঝে মাঝে পত্রমর্মরে সচকিত হইয়া অশোক-তরুর অন্তরালে প্রচ্ছন্ন কোনো আগন্তুকের আশঙ্কা করিবে না? মৃগশিশু আর কি তাহাদের পরিপূর্ণ আদর পাইবে?
এখন সেই সখীভাবনির্মুক্তা স্বতন্ত্রা অনসূয়া এবং প্রিয়ংবদাকে মর্মরিত তপোবনে তাহাদের নিজের জীবনকাহিনীসূত্রে অন্বেষণ করিয়া ফিরিতেছি। তাহারা তো ছায়া নহে; শকুন্তলার সঙ্গে সঙ্গে তাহারা এক দিগন্ত হইতে অন্য দিগন্তে অস্ত যায় নাই তো। তাহারা জীবন্ত, মূর্তিমতী। রচিত কাব্যের বহির্দেশে, অনভিনীত নাট্যের নেপথ্যে এখন তাহারা বাড়িয়া উঠিয়াছে– অতিপিনদ্ধ বল্কলে এখন তাহাদের যৌবনকে আর বাঁধিয়া রাখিতে পারিতেছে না– এখন তাহাদের কলহাস্যের উপর অন্তর্ঘন ভাবের আবেগ নববর্ষার প্রথম মেঘমালার মতো অশ্রুগম্ভীর ছায়া ফেলিয়াছে। এখন এক-এক দিন সেই অন্যমনস্কাদের উটজপ্রাঙ্গণ হইতে অতিথি আসিয়া ফিরিয়া যায়। আমরাও ফিরিয়া আসিলাম।
সংস্কৃত-সাহিত্যে আর-একটি অনাদৃতা আছে। তাহার সহিত পাঠকদের পরিচয় সাধন করাইতে আমি কুন্ঠিত। সে বড়ো কেহই নহে, সে কাদম্বরী কাহিনীর পত্রলেখা। সে যেখানে আসিয়া অতি স্বল্প স্থানে আশ্রয় লইয়াছে সেখানে তাহার আসিবার কোনোপ্রকার প্রয়োজন ছিল না। স্থানটি তাহার পক্ষে বড়ো সংকীর্ণ, একটু এ-দিকে ও-দিকে পা ফেলিলেই সংকট।
এই আখ্যায়িকায় পত্রলেখা যে সুকুমার সম্বন্ধসূত্রে আবদ্ধ হইয়া আছে সেরূপ সম্বন্ধ আর-কোনো সাহিত্যে কোথাও দেখি নাই। অথচ কবি অতি সহজে সরলচিত্তে এই অপূর্ব সম্বন্ধবন্ধনের অবতারণা করিয়াছেন। কোনোখানে এই ঊর্ণাতন্তুর প্রতি এতটুকু টান পড়ে নাই যাহাতে মুহূর্তেকের জন্য ছিন্ন হইবার আশঙ্কামাত্র ঘটিতে পারে।
যুবরাজ চন্দ্রাপীড় যখন অধ্যয়ন সম্পূর্ণ করিয়া প্রাসাদে ফিরিয়া আসিলেন তখন একদিন প্রভাতকালে তাঁহার গৃহে কৈলাস নামে এক কঞ্চুকী প্রবেশ করিল– তাহার পশ্চাতে একটি কন্যা, অনতিযৌবনা, মস্তকে ইন্দ্রগোপকীটের মতো রক্তাম্বরের অবগুণ্ঠন, ললাটে চন্দনতিলক, কটিতে হেমমেখলা, কোমলতনুলতার প্রত্যেক রেখাটি যেন সদ্য নূতন অঙ্কিত; এই তরুণী লাবণ্যপ্রভাপ্রভাবে ভবন পূর্ণ করিয়া ক্কণিতমণিনূপুরাকুলিত চরণে কঞ্চুকীর অনুগমন করিল।
কঞ্চুকী প্রণাম করিয়া ক্ষিতিতলে দক্ষিণ কর রাখিয়া জ্ঞাপন করিল, “কুমার, আপনার মাতা মহাদেবী বিলাসবতী জানাইতেছেন– এই কন্যা পরাজিত কুলুতেশ্বরের দুহিতা, বন্দিনী, পত্রলেখা ইহার নাম। এই অনাথা রাজদুহিতাকে আমি দুহিতানির্বিশেষে এতকাল পালন করিয়াছি। এক্ষণে ইহাকে তোমার তাম্বুলকরঙ্কবাহিনী করিয়া প্রেরণ করিলাম। ইহাকে সামান্য পরিজনের মতো দেখিয়ো না, বালিকার মতো লালন করিয়া নিজের চিত্তবৃত্তির মতো চাপল্য হইতে নিবারণ করিয়ো, শিষ্যার ন্যায় দেখিয়ো, সুহৃদের ন্যায় সমস্ত বিশ্রম্ভব্যাপারে ইহাকে অভ্যন্তরে লইয়ো, এবং এই কল্যাণীকে এমত সকল কার্যে নিযুক্ত করিয়ো যাহাতে এ তোমার অতিচির পরিচারিকা হইতে পারে।’ কৈলাস এই কথা বলিতেই পত্রলেখা তাঁহাকে অভিজাতপ্রণাম করিল ও চন্দ্রাপীড় তাহাকে অনিমেষলোচনে সুচিরকাল নিরীক্ষণ করিয়া “অম্বা যেমন আজ্ঞা করিলেন তাহাই হইবে’ বলিয়া দূতকে বিদায় করিয়া দিলেন।
পত্রলেখা পত্নী নহে, প্রণয়িণীও নহে, কিংকরীও নহে,পুরুষের সহচরী। এইপ্রকার অপরূপ সখীত্ব দুই সমুদ্রের মধ্যবর্তী একটি বালুতটের মতো– কেমন করিয়া তাহা রক্ষা পায়? নবযৌবন কুমারকুমারীর মধ্যে অনাদিকালের যে চিরন্তন প্রবল আকর্ষণ আছে তাহা দুই দিক হইতেই এই সংকীর্ণ বাঁধটুকুকে ক্ষয় করিয়া লঙ্ঘন করে না কেন?
কিন্তু কবি সেই অনাথা রাজকন্যাকে চিরদিনই এই অপ্রশস্ত আশ্রয়ের মধ্যে বসাইয়া রাখিয়াছেন, এই গণ্ডির রেখামাত্র-বাহিরে তাহাকে কোনোদিন টানেন নাই। হতভাগিনী বন্দিনীর প্রতি কবির ইহা অপেক্ষা উপেক্ষা আর কী হইতে পারে? একটি সূক্ষ্ম যবনিকার আড়ালে বাস করিয়াও সে আপনার স্বাভাবিক স্থান পাইল না। পুরুষের হৃদয়ের পার্শ্বে সে জাগিয়া রহিল, কিন্তু ভিতরে পদার্পণ করিল না। কোনোদিন একটা অসতর্ক বসন্তের বাতাসে এই সখীত্ব-পর্দার একটি প্রান্তও উড়িয়া পড়িল না।
অথচ সখীত্বের মধ্যে লেশমাত্র অন্তরাল ছিল না। কবি বলিতেছেন, পত্রলেখা সেই প্রথম দিন হইতে চন্দ্রাপীড়ের দর্শনমাত্রেই সেবারসসমূপজাতানন্দা হইয়া দিন নাই, রাত্রি নাই, উপবেশনে উত্থানে ভ্রমণে ছায়ার মতো রাজপুত্রের পার্শ্ব পরিত্যাগ করিল না। চন্দ্রাপীড়েরও তাহাকে দেখা অবধি প্রতিক্ষণে উপচীয়মানা মহতী প্রীতি জন্মিল। প্রতিদিন ইহার প্রতি প্রসাদ রক্ষা করিলেন এবং সমস্ত বিশ্বাসকার্যে ইহাকে আত্মহৃদয় হইতে অব্যতিরিক্ত মনে করিতে লাগিলেন।
এই সম্বন্ধটি অপূর্ব সুমধুর, কিন্তু ইহার মধ্যে নারী-অধিকারের পূর্ণতা নাই; নারীর সহিত নারীর যেরূপ লজ্জাবোধহীন সখীসম্পর্ক থাকিতে পারে পুরুষের সহিত তাহার সেইরূপ অসংকোচ অনবচ্ছিন্ন নৈকট্যে পত্রলেখার নারীমর্যাদার প্রতি কাদম্বরীকাব্যের যে একটা অবজ্ঞা প্রকাশ পায় তাহাতে কি পাঠককে আঘাত করে না? কিসের আঘাত? আশঙ্কার নহে, সংশয়ের নহে। কারণ, কবি যদি আশঙ্কা, সংশয়েরও লেশমাত্র স্থান রাখিতেন তবে সেটা আমরা পত্রলেখার নারীত্বের প্রতি কথঞ্চিৎ সম্মান বলিয়া গ্রহণ করিতাম। কিন্তু এই দুটি তরুণ-তরুণীর মধ্যে লজ্জা আশঙ্কা এবং সন্দেহের দোদুল্যমান স্নিগ্ধ ছায়াটুকু পর্যন্ত নাই। পত্রলেখা তাহার অপূর্বসম্বন্ধবশত অন্তঃপুর তো ত্যাগই করিয়াছে কিন্তু স্ত্রী পুরুষ পরস্পর সমীপবর্তী হইলে স্বভাবতই যে-একটি সংকোচে সাধ্বসে এমন-কি সহাস্য ছলনায় একটি লীলান্বিত কম্পমান মানসিক অন্তরাল আপনি বিরচিত হইতে পারে, ইঁহাদের মধ্যে সেটুকুও হয় নাই। সেই কারণেই এই অন্তঃপুরবিচ্যুতা অন্তঃপুরিকার জন্য সর্বদাই ক্ষোভ জন্মিতে থাকে।
চন্দ্রাপীড়ের সহিত পত্রলেখার নৈকট্যও অসামান্য। দিগ্বিজয়যাত্রার সময় একই হস্তীপৃষ্ঠে পত্রলেখাকে সম্মুখে বসাইয়া রাজপুত্র আসন গ্রহণ করেন। শিবিরে রাত্রিকালে চন্দ্রাপীড় যখন নিজশয্যার অনতিদূরে শয়ননিষণ্ন পুরুষসখা বৈশম্পায়নের সহিত আলাপ করিতে থাকেন তখন নিকটে ক্ষিতিতলবিন্যস্ত কুথার উপর সখী পত্রলেখা প্রসুপ্ত থাকে।
অবশেষে কাদম্বরীর সহিত চন্দ্রাপীড়ের যখন প্রণয়সংঘটন হইল তখনো পত্রলেখা আপন ক্ষুদ্র স্থানটুকুর মধ্যে অব্যাহতভাবে রহিল। কারণ, পুরুষচিত্তে নারী যতটা আসন পাইতে পারে তাহার সংকীর্ণতম প্রান্তটুকু মাত্র সে অধিকার করিয়াছিল– সেখানে যখন মহামহোৎসবের জন্য স্থান করিতে হইল, তখন ঐটুকু প্রান্ত হইতে বঞ্চিত করা আবশ্যকই হইল না।
পত্রলেখার প্রতি কাদম্বরীর ঈর্ষার আভাসমাত্রও ছিল না। এমন-কি, চন্দ্রাপীড়ের সহিত পত্রলেখার প্রীতিসম্বন্ধ বলিয়াই কাদম্বরী তাহাকে প্রিয়সখীজ্ঞানে সাদরে গ্রহণ করিল। কাদম্বরীকাব্যের মধ্যে পত্রলেখা যে অপরূপ ভূখণ্ডের মধ্যে আছে সেখানে ঈর্ষা সংশয় সংকট বেদনা কিছুই নাই, তাহা স্বর্গের ন্যায় নিষ্কন্টক, অথচ সেখানে স্বর্গের অমৃতবিন্দু কই?
প্রেমের উচ্ছ্বসিত অমৃত-পান তাহার সম্মুখেই চলিতেছে। ঘ্রাণেও কি কোনোদিনের জন্য তাহার কোনো-একটা শিরার রক্ত চঞ্চল হইয়া উঠে নাই? সে কি চন্দ্রাপীড়ের ছায়া? রাজপুত্রের তপ্তযৌবনের তাপটুকুমাত্র কি তাহাকে স্পর্শ করে নাই? কবি সে প্রশ্নের উত্তরমাত্র দিতে উপেক্ষা করিয়াছেন। কাব্যসৃষ্টির মধ্যে সে এত উপেক্ষিতা!
পত্রলেখা যখন কিয়ৎকাল কাদম্বরীর সহিত একত্রবাসের পর বার্তাসহ চন্দ্রাপীড়ের নিকট ফিরিয়া আসিল, যখন স্মিতহাস্যের দ্বারা দূর হইতেই চন্দ্রাপীড়ের প্রতি প্রীতি প্রকাশ করিয়া নমস্কার করিল, তখন পত্রলেখা প্রকৃতিবল্লভা হইলেও কাদম্বরীর নিকট হইতে প্রসাদলব্ধ আর-একটি সৌভাগ্যের ন্যায় বল্লভতরতা প্রাপ্ত হইল এবং তাহাকে অতিশয় আদর দেখাইয়া যুবরাজ আসন হইতে উত্থিত হইয়া আলিঙ্গন করিলেন।
চন্দ্রাপীড়ের এই আদর, এই আলিঙ্গনের দ্বারাই পত্রলেখা কবিকতৃক অনাদৃতা। আমরা বলি, কবি অন্ধ। কাদম্বরী এবং মহাশ্বেতার দিকেই ক্রমাগত একদৃষ্টে চাহিয়া তাঁহার চক্ষু ঝলসিয়া গেছে, এই ক্ষুদ্র বন্দিনীটিকে তিনি দেখিতে পান নাই। ইহার মধ্যে যে প্রণয়তৃষার্ত চিরবঞ্চিত একটি নারীহৃদয় রহিয়া গেছে সে কথা তিনি একেবারে বিস্মৃত হইয়াছেন। বাণভট্টের কল্পনা মুক্তহস্ত– অস্থানে অপাত্রেও তিনি অজস্র বর্ষণ করিয়া চলিয়াছেন। কেবল তাঁহার সমস্ত কৃপণতা এই বিগতনাথা রাজদুহিতার প্রতি। তিনি পক্ষপাতদূষিত পরম অন্ধতা-বশত পত্রলেখার হৃদয়ের নিগূঢ়তম কথা কিছুই জানিতেন না। তিনি মনে করিতেছেন তরঙ্গলীলাকে তিনি যে পর্যন্ত আসিবার অনুমতি করিয়াছেন সে সেই পর্যন্ত আসিয়াই থামিয়া আছে– পূর্ণচন্দ্রোদয়েও সে তাঁহার আদেশ অগ্রাহ্য করে নাই। তাই কাদম্বরী পড়িয়া কেবলই মনে হয়, অন্য সমস্ত নায়িকার কথা অনাবশ্যক বাহুল্যের সহিত বর্ণিত হইয়াছে, কিন্তু পত্রলেখার কথা কিছুই বলা হয় নাই।
জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৭